বাঁশি বাজছে আজ বিশ্বকাপের
অ্যারেনা করিন্থিয়ানসের বাইরে বেশ বড়সড় একটা জটলা। দৃশ্যটা এমনিতে অস্বাভাবিক কিছু নয়। গত কয়েক দিন বিশ্বকাপের উত্তাপ গায়ে মাখতে দর্শনার্থীরা নিয়মিতই আসছেন শহরের উপকণ্ঠে ইতেকারার এই স্টেডিয়ামে। তাই বলে এই সাতসকালে? কাছে গিয়ে দেখা গেল, বেশির ভাগই সাংবাদিক। যাঁদের কাল সকালেও স্টেডিয়ামের ঘাস দেখার অনুমতি মিলল না।
স্টেডিয়াম বাঁয়ে রেখে মিডিয়া সেন্টারে আসার পথে অনেকেই উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করলেন। এক পাশের খাড়া গ্যালারি ছাড়া ভেতরের আর কিছু দৃশ্যমান হলো না। চোখে দেখার মতো কান পেতে শোনাটাও গত কয়েক দিন জরুরি বলে বিবেচিত হয়েছে। দুই দিন আগেও যে ভেতর থেকে ভেসে আসছিল ঠুক-ঠাক আওয়াজ। না, সেই শব্দটা নেই। বিশ্বকে স্বাগত জানাতে তাহলে প্রস্তুত অ্যারেনা করিন্থিয়ানস!
না হয়ে আর উপায় কী! বিশ্বকাপের বাঁশির সুর যে এখন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে। ক্ষণগণনার পালা শেষ। মাঠের বাইরের হাজারো বিতর্ককে পেছনে ফেলে আজ পর্দা উঠছে ফুটবল মহাযজ্ঞের। অ্যারেনা করিন্থিয়ানসে ৬৮ হাজার দর্শক যেটির প্রত্যক্ষ সাক্ষী হতে যাচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে আরও কত কোটি কোটি!
কিন্তু বাংলাদেশে মাঝরাত পেরিয়ে স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায় যখন সত্যি সত্যি বিশ্বকাপ ফুটবলের বিংশতম আসরের বাঁশি বাজবে, সত্যিই কি পেছনে পড়ে যাবে সব বিতর্ক? একাকার হয়ে যাবে ফুটবল-উৎসব আর সাম্বা?
প্রশ্নটাই তো মাঝেমধ্যে অভাবনীয় মনে হয়। অথচ এটাই বাস্তবতা। ফুটবলের তীর্থভূমি ব্রাজিলে বিশ্বকাপ। সেটিই যে এমন একের পর এক নেতিবাচক খবরের খনি হয়ে দাঁড়াবে, কে ভাবতে পেরেছিল! বিমানবন্দরেই কি লেখাটা দেখেছিলাম নাকি অন্য কোথাও—ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবলের চেয়ে একটা জিনিসকেই বেশি ভালোবাসে: মানুষ। ব্রাজিলে স্বাগত।
কিন্তু বিশ্বকাপকে ব্রাজিলিয়ানরা সেভাবে স্বাগত জানাচ্ছে কই! স্বাগতিক দেশের বেশির ভাগ মানুষ বলছে, বিশ্বকাপটা এখানে না হলেই ভালো হতো—ইতিহাসেই কি কখনো হয়েছে এমন? গণমানুষের মনে এমন একটা বিতৃষ্ণা ছড়িয়ে, যেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিবহন ব্রাজিলের সব সমস্যার মূলে এই বিশ্বকাপ। আজ ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের ম্যাচেও সেই অসন্তোষ যে গ্যালারিতে আছড়ে পড়বে না, কেউই সেই গ্যারান্টি দিতে পারছেন না। এমনিতেই ব্রাজিলিয়ানরা জাতীয় দলের নিষ্ঠুর সমালোচক। কিছুটা স্বার্থপরও বটে। তাঁদের বার্তাটা বরাবরই পরিষ্কার থেকেছে—‘ভালো খেললে আছি, না খেললে নাই।’ গত শুক্রবার এই সাও পাওলোরই মুরুম্বি স্টেডিয়ামে সার্বিয়ার বিপক্ষে গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর বিরতির সময় মাঠ ছাড়ার সময় দুয়োধ্বনি শুনতে হয়েছে নেইমারদের। স্কলারির দলকে আজ তাই শুধু ক্রোয়েশিয়াকে জয় করলেই চলবে না, জয় করতে হবে ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ও।
নাকি এই দুটি এক সুতোতেই গাঁথা? ঠিক এক বছর আগে কনফেডারেশন কাপের বাতাবরণেও এমনই একটা অস্বস্তি ছিল। ব্রাজিল যে-ই মাঠে আলো ছড়াতে শুরু করল, সবকিছু উধাও। ডেভিড লুইজ এই সেদিনও আবার ফিরে গেলেন সেই সময়টায়: ‘আমরা সবাই এক হয়ে গিয়েছিলাম। দলের সঙ্গে সব জনগণ। চেলসিতে স্প্যানিশ খেলোয়াড়েরা পরে আমাকে বলছিল, ফাইনালে দর্শকদের ওভাবে জাতীয় সংগীত গাইতে দেখেই ওরা সবাই বলছিল, আজ আমাদের জেতাটা অসম্ভব।’
এই বিশ্বকাপও সব ভুলে ফুটবলের সুরে গান গাওয়াতে পারে ব্রাজিলিয়ানদের। তবে সেটির পূর্বশর্ত সেলেসাওদের ভালো পারফরম্যান্স। পরিস্থিতি দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ভালো একটা শুরু শুধু ব্রাজিলের জন্যই নয়, এই বিশ্বকাপের জন্যও জরুরি। কনফেডারেশন কাপে সেই শুরুর কাজটা করে দিয়েছিলেন নেইমার। জাপানের বিপক্ষে ম্যাচের তৃতীয় মিনিটেই দুর্দান্ত ওই ভলি গোলটিই বেঁধে দিয়েছিল পুরো টুর্নামেন্টের সুর। সেই নেইমার বিশ্বকাপ নিয়ে এমনই রোমাঞ্চিত যে, তাঁর আর একদমই তর সইছে না। ‘সেই ছোট্টটি থাকতেই যা আমার স্বপ্ন, সেটি এখন ঠিক আমার দোরগোড়ায়। আমি ব্রাজিলের নাম্বার টেন, আমি আমার নিজের দেশে বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছি।’ এমনিতেই চাপের অভাব নেই। এর সঙ্গে নিজের মনের এই রোমাঞ্চ গণমানুষের মনে ছড়িয়ে দেওয়ার বাড়তি দায়িত্বটাও চেপেছে ২২ বছর বয়সীর কাঁধে।
নেইমারের মতো আরেকজনেরও তর সইছে না। তাঁর নাম লুকা মডরিচ। ক্রোয়েশিয়া দলের সাবেক কোচ স্লাভেন বিলিচ দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছেন, রিয়াল মাদ্রিদের এই ক্রোট মিডফিল্ডারই হতে যাচ্ছেন এই বিশ্বকাপের তারকা।
প্রথম ম্যাচেই সামনে ব্রাজিল। চাইলেই তো আর কিছু করার নেই বুঝেই কি না ক্রোয়েশিয়া দেখছে এর ইতিবাচক দিকটা। স্বাগতিক দেশ প্রথম ম্যাচে নার্ভাস থাকতে বাধ্য, এটাই তো সুযোগ! বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ সবচেয়ে বড় দুটি অঘটন দেখেছে ১৯৯০ ও ২০০২ বিশ্বকাপে। প্রথমটিতে আর্জেন্টিনা হেরে গিয়েছিল ক্যামেরুনের কাছে। দ্বিতীয়বার সেনেগালের কাছে ফ্রান্স। আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স ছিল আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন। চ্যাম্পিয়নদেরও বাছাইপর্ব খেলতে হওয়ার নিয়ম চালু হওয়ার পরই নিশ্চিত হয়ে গেছে, স্বাগতিক না হলে উদ্বোধনী ম্যাচে চ্যাম্পিয়নদের হেরে যাওয়ার ঘটনা আর ঘটবে না। ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে উদ্বোধনী ম্যাচে চ্যাম্পিয়নদের বদলে স্বাগতিক দল। তবে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন না হলেই বা কী, আজ ব্রাজিল হেরে বসলে বিশ্বকাপের বড় অঘটনগুলোর মধ্যেই স্থান পেয়ে যাবে তা।
ব্রাজিলে অসন্তোষ, ‘কাতারগেট’ কেলেঙ্কারি—এসবের মধ্যে গত পরশু একটা ভালো খবর অবশ্য দিতে পেরেছে ফিফা। শেষ পর্যন্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকছেন জেনিফার লোপেজ। ‘প্রোডাকশন ইসু্যর দোহাই দিয়ে যিনি এর আগে না থাকার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। পিটবুল ও ক্লদিয়া লেইতের সঙ্গে লোপেজের ‘উই আর ওয়ান’ গান স্থানীয় সময় সোয়া তিনটায় শুরু ২৫ মিনিটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বড় আকর্ষণ। যদিও এবারের বিশ্বকাপ-সংগীত শাকিরার ‘ওয়াকা ওয়াকা’র কাছে এরই মধ্যে হেরে ভূত। শরীরে নাচন তোলা শাকিরার ওই গান ২০টিরও বেশি দেশে চার্টের এক নম্বরে উঠেছিল। ‘উই আর ওয়ান’-এর একটা দেশেও সেই সৌভাগ্য হয়নি।
ঐতিহ্যগতভাবেই বিশ্বকাপ ফুটবলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান অলিম্পিকের মতো বর্ণাঢ্য কিছু হয় না। এটা যেন করার জন্যই করা। বাতাবরণটা এমন যে, এবার সেটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটাকে ব্রাজিলীয় করার চেষ্টা এমনিতেই থাকার কথা। সেটি আরও বেশি থাকছে বিশ্বকাপকে ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে ঢুকিয়ে দিতে।
এই বিশ্বকাপ যে ব্রাজিলের জন্য শুধু ‘হেক্সা’র চ্যালেঞ্জ নয়!