ফুটবল-জাদুঘরে ইচ্ছাপূরণের গল্প
২০১৪ বিশ্বকাপ জিতবে কারা?
কে আবার, ব্রাজিল। আরে ভাই, এটা কি কোনো প্রশ্ন হলো? আগের ১৯টি যেমন জিতেছে, এবারও ব্রাজিলই জিতবে। ১৯৩০ সালে সেই প্রথম বিশ্বকাপ থেকেই তো ছুটে চলেছে এই জয়রথ। সেবার ফাইনালে উরুগুয়েকে ৫-০ গোলে হারানোর পর দুই দেশে যুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। নিজেদের দেশে পরাজয়ের জ্বালায় উরুগুইয়ানরা ঢুকে পড়েছিল ব্রাজিলের দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে। ব্রাজিলিয়ান সেনাবাহিনীর পাল্টা-আক্রমণে পালিয়ে বাঁচে।
১৯৩৪ ইতালি বিশ্বকাপ ফাইনালে ‘কালো হীরা’ লিওনিডাস ডা সিলভার সঙ্গে হাত মেলাতে হবে বলে মুসোলিনি আগেই স্টেডিয়াম ছেড়ে চলে যান। ব্রাজিলের শিরোপা ধরে রাখা ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গেছে। চার বছর পর ফ্রান্সে ব্রাজিলের টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়।
বিশ্বযুদ্ধের কারণে এক যুগ বিরতির পর বিশ্বকাপ আবার শুরু হলো এই ব্রাজিলেই। ফাইনালে কি না উরুগুয়ে, যাদের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ পর্যন্ত হয়েছে। যুদ্ধে তো জিতেছিলই, মাঠেও ব্রাজিলই জিতল। ম্যাচ ১-১ চলার পর উরুগুইয়ান ফরোয়ার্ড গিঘিয়ার শট পোস্টে লেগে মাঠের অন্য অর্ধে চলে গেল। সেটি ধরেই অগাস্টো জয়সূচক গোলটি করলেন। দুই লাখের বেশি দর্শকের মারাকানায় তখন উৎসব আর উরুগুইয়ানরা সব অঝোরে কাঁদছে।
প্রতিটি বিশ্বকাপেই প্রতিপক্ষকে এমন কাঁদিয়ে এসেছে ব্রাজিল।আর ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা উদ্ভাসিত হয়েছেন হাসিতে। পেলে আর রোনালদো চারটি করে বিশ্বকাপ জিতেছেন। জিকো ও গারিঞ্চা তিনটি, কাকা ও লিওনিডাস দুটি।
কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? সাও পাওলোর পাকেম্বু স্টেডিয়ামে মিউজি দো ফুটেবল ঘুরে এলে বিশ্বাস হতে বাধ্য। সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকার, বিখ্যাত সব ফুটবলার সবাই তো এটাই বলছেন। শুধু মুখের কথায় বিশ্বাস না করতে চাইলে প্রামাণ্য ফুটেজও আছে।
ব্রাজিলিয়ানদের ফুটবলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যে চার্লস মিলার, সাও পাওলো শহরের মাঝখানে তাঁর নামে বড় একটা চত্বর—প্রাকা চার্লস মিলার। ফুটবল-জাদুঘরটাও সেখানেই। যেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের ইতিহাস। ছবি-জার্সি-স্মারক-ঐতিহাসিক নানা নিদর্শন...জাদুঘরে যেসব থাকে, তা তো আছেই। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে দর্শনার্থীদের এর অংশ করে নেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। বিখ্যাত সব খেলার ফুটেজ চলছে, চাইলেই দেখতে পারেন বিখ্যাত সব গোল...নেইমার পাস দেবেন আর আপনি গোল করবেন। হ্যাঁ, এটিও এখানে সম্ভব।
ব্রাজিলিয়ানদের জীবন-চিন্তা-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকা বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসও মূর্ত এখানে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্যবহৃত বল, জুলে রিমে ট্রফির রেপ্লিকা, ছবিতে-কথায় প্রতিটি বিশ্বকাপের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ফুটবল-বুটের বিবর্তনের গল্প ধরা আছে বিভিন্ন সময়ের বুটে—প্রথমটি সেই ১৯১৪ সালের। তিনতলার একটি ঘরে ‘মারাকানাজো’র সেই বিখ্যাত ফিল্মটি বিরতিহীন চলছে বড় পর্দায়। গিঘিয়া গোল করছেন, ভেঙে পড়া ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক বারবোসা সর্বস্ব হারানো মানুষের মতো ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছেন।
তাহলে একটু আগে যে বলা হলো, গিঘিয়ার শট পোস্টে লাগার পর সেটি থেকেই ব্রাজিলের জয়সূচক গোল এবং ১৯৫০ বিশ্বকাপ জয়! মজাটা সেখানেই। নিচতলার একটি আয়তাকার কক্ষে সিনেমা হলের মতো বিশাল পর্দায় ‘প্রামাণ্য’ চিত্রটা শেষ হওয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই শুরু হয়ে যাচ্ছে আবার। যেটিতে ব্রাজিল একটার পর একটা বিশ্বকাপ জিতছে আর প্রামাণ্য চিত্র যেমন হয়, তা নিয়ে কথা বলছেন সাংবাদিক-বিশেষজ্ঞ-খেলোয়াড়েরা।
যে প্রামাণ্য চিত্র আপনাকে জানাবে, ১৯৮২ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিল ব্রাজিল ও ইতালি। ব্রাজিল দুবার এগিয়ে যাওয়ার পর দুবারই সমতা আনেন পাওলো রসি। এর পর খেলার শেষ মুহূর্তে জিকোর কর্নার থেকে হেডে গোল করে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে দেন অস্কার। সেই ম্যাচের ফুটেজ শুরুর আগে-পরে পাওলো রসির প্রতিক্রিয়াও আছে। শুরুর আগে জানাচ্ছেন, ওই ম্যাচটি শুরুর আগে কেমন নার্ভাস ছিলেন। শেষ হওয়ার পর বলছেন, ফুটবল-বিধাতার এই অবিচার মানতে না পেরে তিনি সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে নেন।
বিখ্যাত এক সাংবাদিক আপনাকে ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ফাইনালের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবেন। ব্রাজিলের খেলোয়াড় তালিকায় রোনালদোর নাম না দেখে সবাই বিস্মিত। অসুস্থ হয়ে পড়ার পরও ফাইনাল খেলবেনই পীড়াপীড়ি করে রোনালদো ঠিকই নামলেন। ভালো খেলতে পারছিলেন না বলে কোচ মারিও জাগালো সাহসী এক সিদ্ধান্ত নিলেন। রোনালদোকে তুলে নামিয়ে দিলেন এডমুন্ডোকে। এডমুন্ডোর একটি গোলের ফুটেজ ভেসে ওঠার পর ওই সাংবাদিকই আপনাকে জানাবেন, সেটি ছিল ফাইনালে এডমুন্ডোর ৬ গোলের একটি!
পেলে গোল করার জন্য যেমন বিখ্যাত, তেমনি না-হওয়া দুটি গোলের জন্যও। ১৯৬২ বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়ার গোলরক্ষক একটু সামনে এগিয়ে আছেন দেখে মাঝমাঠ থেকে যে শটটি নিয়েছিলেন, সেটি অল্পের জন্য বারের ওপর দিয়ে চলে যায়। সেই বিশ্বকাপেই উরুগুয়ের গোলরক্ষককে যে ডামিটা খেলেছিলেন, সেটি ফুটবলে তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনী চিন্তার সেরা উদাহরণ বলে গণ্য। সেটিতেও শেষ পর্যন্ত গোল হয়নি। ফুটবল-জাদুঘরের ওই প্রামাণ্য চিত্রে দুটিতেই গোল হচ্ছে।
ব্রাজিলের ফুটবল নিয়ে অসাধারণ একটি বই লিখেছেন সাংবাদিক অ্যালেক্স বেলোস। তিনিও আছেন এখানে। ব্রাজিল এবারের আগে ১৯টি বিশ্বকাপই জিতে ফেলায় বেলোস বলছেন, শুধু ব্রাজিলই বিশ্বকাপ জেতে বলে এটি নিয়ে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। অন্য সব দেশের জন্য টুর্নামেন্টটা হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিতীয় হওয়ার প্রতিযোগিতা। ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার মাথা নেড়ে বলছেন, প্রতিবারই কেন ব্রাজিল জেতে এটা তাঁর চিন্তার অগম্য। ঈশ্বর নিশ্চয়ই ব্রাজিলিয়ান। ১৯৬২ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার আমারিল্ডো ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, ‘আশা করি, ফুটবলের স্বার্থে ব্রাজিল একদিন হারবে।’ বেলোস আবার দেখা দিচ্ছেন, ‘ফুটবলের নিয়মকানুন না বদলালে ব্রাজিলকে হারানো যাবে বলে মনে হয় না।’
জিজ্ঞেস করে জানলাম, নিজেদের দেশে বিশ্বকাপ হচ্ছে বলে এই ‘প্রামাণ্য চিত্র’টি ফুটবল-জাদুঘরে নতুন সংযোজন। যেটিকে প্রামাণ্য চিত্র না বলে ইচ্ছাপূরণের গল্প বলাই ভালো। তবে সেটি এমনই মুনশিয়ানার সঙ্গে বানানো যে দেখতে দেখতে আপনার মনে হতে বাধ্য, আসলে কি এমন কিছুই হয়েছিল নাকি!
মজা করেই বানানো। কিন্তু নিজেদের দেশে বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে যখন তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ খেলতে হচ্ছে, সেটি হয়ে যাচ্ছে করুণ রসের এক গল্প!