নিজামের শহরে বাংলাদেশের সেই প্রথম ওয়ানডে জয়
১৯৮৬ সালে প্রথম ওয়ানডে খেলার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের আরাধ্য প্রথম জয়টি এসেছিল ১৯৯৮ সালের আজকের এই দিনে। ভারতের হায়দরাবাদে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে কেনিয়াকে হারানো সেই ম্যাচটা কাভার করেছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মন্ডল। প্রথম জয়ের দুই যুগ পূর্তির দিনে প্রথম আলো-তে তাঁর স্মৃতিচারণ-
নিজামের শহর। বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়। এই দুটো বাক্য পড়ার পর মনে হতে পারে; ক্রিকেট ব্যালকিনতে বসে কেউ রূপকথার বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করলেন! হ্যাঁ, বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয় রূপকথা মনে হতেই পারে। হওয়াটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশ এখন দেশে-বিদেশে ওয়ানডে ম্যাচ জিতছে, সিরিজ জিতছে। কত সাফল্যের গল্পগাথা! দুই যুগ আগে কেনিয়ার বিপক্ষে একটা জয়কে মনে রাখার কী আছে!
আছে। কারণ, সেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে ওয়ানডে ম্যাচে জয়ের সংখ্যাটা শূন্য থেকে ‘এক’ হয়েছিল। ওটাই প্রথম জয়। আর যেকোনো প্রথমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আবেগ লিখে বা বলে বোঝানো কঠিন। ক্রিকেট প্রেসবক্সে এক দশকের বেশি সময় অনিয়মিত। তারপরও নিজের ভেতরের সাংবাদিক সত্তাটা নেড়েচড়ে ওঠে, যখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোনো প্রথম সাফল্যের কথা শুনি, পড়ি, অথবা দেখি। রবীন্দ্রনাথের গানের সুর প্রাণে বেজে ওঠে। বলতে ইচ্ছে করে, ‘দিনের পথিক মনে রেখো/ আমি চলেছিলেম রাতে/ সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে...।’ টেস্ট, ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশের প্রথম জয় দেখার সুযোগ হয়েছিল প্রেসবক্সে বসে! ক্রিকেট–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। গুগলে সার্চ দিয়ে দেখছি, বাংলাদেশের আর কোনো সাংবাদিকের নাম এই তালিকায় নেই! এই অনুভূতিটাকেই যেন উসকে দিলেন, বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক উৎপল শুভ্র, বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের দুই যুগ পূর্তিতে কিছু একটা লিখতে বলে।
‘থাম্প কালচার’–এর এই যুগে মোবাইল-ল্যাপটপে আঙুলের ছোঁয়ায় যেখানে পুরোনো সবকিছু খুঁজে পাওয়া যায়, সেখানে ম্যাচ নিয়ে কী লিখবেন! ভারতে অনুষ্ঠিত সেই তিন জাতি টুর্নামেন্টের আগে বাংলাদেশ এশিয়া কাপ খেলেছে, অস্ট্রেলেশিয়া কাপ খেলেছে। কিন্তু কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি। ওই টুর্নামেন্টেও বাংলাদেশ ছিল ‘আন্ডারডগ’। স্বাগতিক ভারত ছাড়া অন্য দল কেনিয়া। যারা তত দিনে বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে। ওই টুর্নামেন্টে ভারতকেও হারিয়েছিল। তবে সেই কেনিয়ান ক্রিকেট হয়তো আজ জাদুঘরে চলে গেছে। আর বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রতিদিন নতুন নতুন ইতিহাস লিখছে। কিন্তু হায়দরাবাদের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়ামে কেনিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের সেই জয় জাদুঘরে নয়, দেশজ ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। সে ইতিহাস পড়তে ইচ্ছে না করলে দ্রুত পাতা উল্টে যেতে পারেন। কিন্তু অস্বীকার করতে পারবেন না।
এখনকার মতো মোবাইলে সেলফি তোলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু অনিল কাপুর, মাধুরী দীক্ষিতরা হাসিমুখে ছবি তোলার দাবি মিটিয়েছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট, মোর্শেদ আলী খান সুমন, হাসিবুল হোসেন শান্তদের।
ফ্ল্যাশব্যাকের মতো আজ কত স্মৃতি মনে পড়ছে। ম্যাচ জয়ের পর বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমের সে কী অবস্থা! বন্যার মতো বাঁধ ভেঙে যাওয়া আনন্দ-উচ্ছ্বাস। যেখানে সাংবাদিকের প্রবেশেও কেউ বাধা দেয়নি। অবশ্য এখনকার মতো আইসিসির এত কড়া নিয়মকানুনও তখন ছিল না। তাই সাংবাদিক সত্তা মনের অজান্তেই চাপা পড়ে যায় বাংলাদেশের জয়োৎসবে! ম্যাচ রিপোর্ট, ক্রিকেটারদের প্রতিক্রিয়া, গর্ডন গ্রিনিজের মতো ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের কোচিংয়ে প্রথম জয়, সেই লোকটার সাক্ষাৎকার, কত কিছুই ছিল...। কিন্তু সেই রাতটা ছিল অন্য রকম। যেখানে আবেগের ট্রাফিক জ্যামে আটকে গিয়েছিল ক্রিকেট রিপোর্টিংয়ের সবকিছু!
দিন-রাতের ম্যাচ। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয়। পত্রিকার ডেডলাইন। এত কিছু মাথায় নিয়ে স্টেডিয়াম থেকে বানজারাহিলে তাজ হোটেলে ফেরা। কিন্তু হোটেলে ফিরেই–বা কী লিখবেন! সেই মধ্যরাতেও “বাংলাদেশ, বাংলাদেশ” জয়ধ্বনিতে কাঁপছিল হোটেল লবির সামনের জায়গাটুকু। একই হোটেলে ছিলেন বলিউড তারকা অনিল কাপুর, মাধুরী দীক্ষিতের মতো মহাতারকারাও। বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের উচ্ছ্বাসকে স্বাগত জানাতে লবিতে নেমে আসেন তাঁরাও। এখনকার মতো মোবাইলে সেলফি তোলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু অনিল কাপুর, মাধুরী দীক্ষিতরা হাসিমুখে ছবি তোলার দাবি মিটিয়েছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট, মোর্শেদ আলী খান সুমন, হাসিবুল হোসেন শান্তদের।
কেনিয়ার বিপক্ষে ৬ উইকেটের সেই জয় কতটা আবেগের, কতটা আনন্দের, কতটা উচ্ছ্বাসের, এখন তা বোঝানো কঠিন। তবে গর্ডন গ্রিনিজের মতো মুডি মানুষও যখন সারা রাত জেগে ভোরের সূর্যোদয় দেখতে দেখতে সবার সঙ্গে ভাঙা ভাঙা বাংলায় গলা মেলালেন, ‘আমার সোনার বাংলা...!’ যে জয় ক্রিকেট আর রবীন্দ্রনাথের যুগলবন্দী হয় গিয়েছিল, তার প্রভাব বাংলাদেশ ক্রিকেটে চিরকালীন।