জীবন-মরণ ম্যাচে সুয়ারেজের ওপর আলো

গ্রুপো ডি লা মুয়ের্তে।
শব্দবন্ধটা মেক্সিকান সাংবাদিকদের তৈরি করা। স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অনুবাদ করলে যা আপনার কাছে খুব পরিচিত শোনাবে। গ্রুপ অব ডেথ।
১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড, ব্রাজিল, ১৯৬২ বিশ্বকাপের রানার্সআপ চেকোস্লোভাকিয়া ও রোমানিয়া এক গ্রুপে পড়ে যাওয়ার পর জন্ম ওই কথাটার। এর পর থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপের ড্রয়ের পরই কোনো না কোনো গ্রুপ পেয়ে এসেছে এই অভিধা। এবার আবার গ্রুপের নামের সঙ্গে তা মিলেও গেছে—‘ডি’ ফর ডেথ!
আর কোনো গ্রুপে একের বেশি বিশ্বকাপজয়ী নেই। ‘ডি’ গ্রুপে তিন চ্যাম্পিয়ন, আগের ১৯টি বিশ্বকাপের ৭টিই জিতেছে যারা। তার পরও আজ সাও পাওলোতে ইংল্যান্ড-উরুগুয়ে ম্যাচটা দুই দলের জন্যই এমন জীবন-মরণ হয়ে দাঁড়াত না, যদি মৃত্যুকূপকে আরও ভয়াল বানিয়ে না দিত পুঁচকে কোস্টারিকা।
দক্ষিণ আমেরিকার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে। পাশের দেশে খেলা বলে বিশ্বকাপেও কিছু একটা করে ফেলার স্বপ্ন তো থাকবেই। তার ওপর এই ব্রাজিলেই যেখানে সর্বশেষ উড়েছে বিশ্বকাপ জয়ের পতাকা। ডেভিড লুগানোর কল্পনাতেও ছিল না, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ‘এটা আমাদের জীবন-মরণ লড়াই’ বলে তাতিয়ে তুলতে হবে সতীর্থদের। ড্রয়ের পর কী ভেবেছিলেন, ইন্টারনেট ঘেঁটে সেটি পাওয়া গেল। প্রথম ম্যাচে কোস্টারিকার বিপক্ষে হেসে-খেলে জয় পাওয়ার পর এই ম্যাচ হারলেও সব শেষ হয়ে যাবে না।
সেই কোস্টারিকাই যে গ্রুপ অব ডেথকে এমন নাড়িয়ে দেবে, কে ভেবেছিল! এই বিশ্বকাপে নকআউট পর্ব একটু আগেভাগেই যেন শুরু হয়ে গেল। কাল রাতে স্পেন-চিলি ছিল নকআউট, আজ ইংল্যান্ড-উরুগুয়েও তা-ই। ইতালির কাছে ইংল্যান্ডের হারাটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। কিন্তু কোস্টারিকার কাছে উরুগুয়ের হার বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আপসেটগুলোর সারিতেই থাকবে। যেটি বয়ে এনেছে উরুগুইয়ান ফুটবলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকেও এলোমেলো করে দেওয়ার শঙ্কাও।
এই বিশ্বকাপে ভালো করে ২০৩০ বিশ্বকাপ আয়োজনের দাবিটা জোরেশোরে তুলে ধরতে চেয়েছিল উরুগুয়ে। সাধারণ নিয়ম বলে, যে দেশে প্রথম বিশ্বকাপ, বিশ্বকাপের শতবার্ষিকী টুর্নামেন্টটা তাদের পাওয়াই উচিত। কিন্তু পেশাদার আধুনিক ক্রীড়া বিশ্ব এখন আর এসব ভাবাবেগে চলে না। অনেক চেষ্টা করেও তো এথেন্স ১৯৯৬ শতবার্ষিকী অলিম্পিক পায়নি।
১৯৩০ সালের ফুটবল দুনিয়া ছিল অন্যরকম। তার পরও তো উরুগুয়ে সহজে বিশ্বকাপ পায়নি। আগের দুটি অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা অবশ্যই কাজে এসেছিল। তবে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আয়োজক হতে করতে হয়েছিল আরও অনেক কিছুই। দলগুলোর আসা-যাওয়া ও হোটেল খরচ দেওয়ার পাশাপাশি নতুন একটা স্টেডিয়াম বানানোর প্রতিশ্রুতিতেই শিকে ছিঁড়েছিল শেষ পর্যন্ত। সেই বিশ্বকাপ ছিল উরুগুয়ের স্বাধীনতার শতবার্ষিকী উদ্যাপনের অংশ।
বিশ্বকাপের শতবার্ষিকী উদ্যাপনের পরিকল্পনার কথা বলে দলকে উজ্জীবিত করার চেষ্টাও হয়েছে। এই বিশ্বকাপের আগে উরুগুইয়ান ফুটবল ফেডারেশন একটি ভিডিও বানিয়েছে, যেটির শিরোনাম ‘garra’৷ উরুগুইয়ান ফুটবলের সমার্থক এই শব্দটা, যেটির আক্ষরিক অর্থ ‘নখ’। ভাবার্থ হতে পারে, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। পুঁচকে একটা দেশ। প্রথম বিশ্বকাপ জেতার সময় জনসংখ্যা ছিল ২০ লাখ। এখনো তা মাত্র ৩৪। সেই দেশের রীতিমতো অবাক করে দেওয়ার মতো ফুটবল-সাফল্যের ব্যাখ্যা হিসাবে আসে ওই শব্দটা। যেটি নাকি সব ম্যাচে উরুগুয়ের দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামে। উরুগুয়ের এক কোচ যথার্থই বলেছিলেন, ‘সব দেশের ইতিহাস আছে। আমাদের আছে ফুটবল।’
এই ভিডিওতে নানা দৃশ্যের ফাঁকে হঠাৎই উঁকি দেয় লুইস সুয়ারেজের বিতর্কিত ওই হ্যান্ডবল। গত বিশ্বকাপে ঘানার বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে গোলে ঢুকতে যাওয়া বল ঠেকাতে ‘গোলরক্ষক’ হয়ে গিয়েছিলেন সুয়ারেজ। লাল কার্ড পেয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে হয় তাঁকে। কিন্তু ঘানা পেনাল্টি মিস করায় উরুগুয়েই উঠে যায় সেমিফাইনালে। উরুগুইয়ানদের কাছে হিরো হয়ে যান সুয়ারেজ। ওই কাণ্ডও যে ‘গারা’র একটি উদাহরণ।
লিভারপুলে সুয়ারেজের আক্রমণ-সঙ্গী ড্যানিয়েল স্টারিজের কাছে যেটির প্রসঙ্গ তোলায় তিনি রীতিমতো টিটকারিই দিয়েছেন। উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচটি জিতে যা কিছু করতে হয় করবেন জানানোর পর ইংল্যান্ড স্ট্রাইকারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সুয়ারেজ যা করেছিল, তেমন কিছুও কি? স্টারিজ জবাব দিয়েছেন, ‘এসব আমার চরিত্রে নেই। ফুটবলের আইনে নেই, এমন কিছু আমি করি না।’
ফুটবলের আইনের বাইরে তো যেতে পারেনই, আইনের মধ্যে থেকেও লুইস সুয়ারেজ কী করতে পারেন, সেটি ইংল্যান্ড দলের ভালোই জানা। গত প্রিমিয়ার লিগে সুয়ারেজের এমনই পারফরম্যান্স যে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ড বলেই দিয়েছেন, সুয়ারেজ-হুমকির কোনো সমাধান তাঁর কাছে নেই। সুয়ারেজ নিজেকে শতভাগ ফিট দাবি করে এই ম্যাচে খেলবেন জানানোর পর থেকে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের শুধু তাঁকে নিয়েই কথা বলতে হচ্ছে। বিরক্ত স্টারিজের কাছে যেটিকে মনে হচ্ছে ‘অবসেশন’।
অবসেশন হোক আর যা-ই হোক, আজ ইংল্যান্ডের বড় ভয়ের নাম ওই সুয়ারেজই। বিশ্বকাপে টিকে থাকতে হলে সুয়ারেজ-কাভানির জোড়া ফলাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতেই হবে। নইলে গ্রুপের শেষ ম্যাচটি হয়ে যাবে শুধু খেলার জন্য খেলা। কাকতালীয়ভাবে কোস্টারিকার বিপক্ষে সেই ম্যাচটি আবার বেলো হরিজন্তেতে। যেখানে রচিত হয়েছে ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে বড় কলঙ্কের ইতিহাস। বিশ্বকাপে সেবারই প্রথম খেলে ইংল্যান্ড এবং বেলো হরিজন্তেতে শৌখিন আমেরিকান দলের কাছে ১-০ গোলে হেরে বসে। সাংবাদিকের পাঠানো প্রতিবেদন এমনই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল যে ইংল্যান্ডের কাগজে নাকি ছাপা হয়েছিল সেটির সংশোধিত রূপ: ইংল্যান্ড ১০-০ যুক্তরাষ্ট্র!
বেলো হরিজন্তে এবার যে কী নিয়ে অপেক্ষা করছে ইংল্যান্ডের জন্য!