ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জার্মানির জয়টা অনেক কারণেই আলাদা। প্রথম ইউরোপিয়ান দল হিসেবে লাতিন আমেরিকায় শিরোপা জিতেছে জার্মানি। এক দশক আগে তরুণদের গড়ে তোলা ও খেলার ধরন বদলে ফেলার যে পরিকল্পনা তারা করেছিল, এবার হয়তো সেটারই সুফল পেয়েছে। এই বিশ্বকাপটা জার্মানির হাতেই সবচেয়ে মানায়।
মারাকানার ফাইনালের আগে অনেকেরই একটা কৌতূহল ছিল, ব্রাজিলের ও রকম অসহায় আত্মসমর্পণের পর আর্জেন্টিনা কী করে। ব্রাজিলের যেটা করা উচিত ছিল, আর্জেন্টিনা সেটাই করেছে। ট্যাকটিক্যালি তারা বেশ গোছানো থাকল, মাঝে মাঝে তো বলের পেছনে নয়জন পর্যন্ত রেখেছে। আশায় ছিল হুট করে সুযোগ পেয়ে যাওয়ার, বিশেষ করে লিওনেল মেসিকে ঘিরে। তিনটি সুযোগ কিন্তু আর্জেন্টিনা পেয়েছিল, সেগুলো কাজে লাগাতে না পারার জন্য শুধু নিজেদেরই দুষতে পারে তারা। টনি ক্রুসের ওই ভুল থেকে অবশ্যই গঞ্জালো হিগুয়েইনের গোল করা উচিত ছিল।
কিন্তু ফাইনালে জার্মানিই বেশি ভালো খেলেছে। শুধু ফাইনালে নয়, পুরো টুর্নামেন্টেই। আর্জেন্টিনা কিছু সুযোগ পেয়েছিল শুধু এ জন্যই যে জার্মানি নিজেদের অর্ধে বসে না থেকে প্রতিপক্ষকে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল। সে কারণেই কিছু ফাঁকফোকর তৈরি করেছিল আর্জেন্টিনা।
ঠিক এ কারণেই আমি মনে করি ফাইনালে জেরোম বোয়াটেং মাঠের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিল, তার কয়েকটি ট্যাকল তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকল। ফিলিপ লাম বরাবরের মতোই দুর্দান্ত, গোটশের গোলের ওই ক্রসটা দিয়ে আন্দ্রে শুরলে ফ্রান্সের সঙ্গে করা মিসগুলো পুষিয়ে দিয়েছে।
অনেকেরই হয়তো মনে আছে, আমি আগেই বলেছিলাম এবার গোটশের ওপর আলাদা করে চোখ রাখতে হবে। মিরোস্লাভ ক্লোসার জায়গায় ওর আসাটা একদিক দিয়ে প্রতীকী। ৩৬ বছর বয়সে ক্লোসা নিজের শেষ বিশ্বকাপ হয়তো খেলে ফেলেছে।
লোর কথাও আলাদা করে বলতে হবে। তিনি জানতেন খেলোয়াড়দের কাছ থেকে কী পাবেন। বেশ কিছু পরীক্ষাও তাঁকে দিতে হয়েছে, বিশেষ করে আলজেরিয়ার সঙ্গে শেষ ষোলোতে। কিন্তু দরকারমতো লো কৌশল বদলে ফেলেছেন। এমনকি লামকে শুরুতে ডিফেন্সিভ মিডে খেলিয়েও পরে রাইট ব্যাকে নিয়ে এসেছেন।
এই বিশ্বকাপে প্ল্যান বি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেটা ব্রাজিল কখনোই করতে পারেনি। এমনকি যে আর্জেন্টিনা শুরুতে শুধু মেসিকে ঘিরেই খেলতে চেয়েছে, তারা পর্যন্ত নিজেদের খেলা অনেকটাই বদলে ফেলতে পেরেছে। আলেসান্দ্রো সাবেলার দল গ্রুপপর্বে খুব একটা ভালো করতে পারেনি, সেখান থেকে তারা দুটি ১-০ গোলের জয় নিয়ে সেমিফাইনালে এসেছে। এরপর টাইব্রেকারে হারিয়েছে হল্যান্ডকে। বলতেই হবে, হল্যান্ডের খেলাও আমি খুব উপভোগ করেছি।
এটাও বলা উচিত, মেসি আমাকে হতাশ করেছে। গোল্ডেন বলটা ওকে দেওয়াটা অন্যায়ই হয়েছে। ওটা মেসির প্রাপ্য নয়। গ্রুপপর্বে দুর্দান্ত খেললেও নকআউট পর্বে সে আর্জেন্টিনার হয়ে একটা গোলও পায়নি। আমি জানি ও গ্রেট খেলোয়াড়, কিন্তু আমার মতে, হামেস রদ্রিগেজ বা টমাস মুলারের কেউ এটা পাওয়ার যোগ্য ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে ফিফা কিছু ব্যাপারে ভজকট পাকিয়ে ফেলে। ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনালে অলিভার কান অমন ভুল করার পরও সে গোল্ডেন বল পেয়েছিল। তবে আমার মনে হয় জার্মানি এটা নিয়ে খুব একটা আপত্তি করবে না। একবার ভাবুন, ২০১৮ ইউরোতে ওদের দলটা প্রায় কাছাকাছিই থাকবে। ২০১৬ ইউরোর অন্যতম দাবিদারও ওরা, এমনকি ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপেরও। গত ১০ বছরে জার্মানি দারুণ কিছু খেলোয়াড়ের জন্ম দিয়েছে। আমার মনে হয় না এই ধারাটা খুব শিগগির শেষ হয়ে যাবে।
এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় হতাশা ছিল ইতালি। ইংল্যান্ডের নামও অনেকেই বলবেন। তবে আমার মনে হয় ইতালির সঙ্গে প্রথমার্ধে বেশ ভালো খেলেছে ইংল্যান্ড। এমনকি রুনি সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারলে উরুগুয়ের সঙ্গেও জিতে যেত ওরা।
সবশেষে আমি মনে করি, ব্রাজিলিয়ানরা এই বিশ্বকাপ নিয়ে গর্ব করতে পারে। আয়োজন নিয়ে এত সব উদ্বেগের পরও আমরা দারুণ একটা বিশ্বকাপ উপহার দিতে পেরেছি। দলের বিপর্যয়কে একটু হলেও ভুলিয়ে দিচ্ছে এটা। আপনাদের সঙ্গে আমার বিশ্বকাপ ভাবনা ভাগাভাগি করতে পেরে আমি আনন্দিত। সবাইকে ধন্যবাদ।