কে এই টেন হাগ, তাঁর অধীনে রোনালদোর ভবিষ্যৎ কী?
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলেও সেটি আগামী রোববারের আগে আসবে না। চুক্তিতে সই হয়ে গেছে কি না, তা-ও এখনো একেবারে নিশ্চিত নয়। তবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোচ যে এরিক টেন হাগই হচ্ছেন, সেটি এই মুহূর্তে সর্বজনবিদিত গোপন খবর!
কিন্তু কে এই টেন হাগ? ইউরোপের ফুটবলের নিয়মিত খোঁজখবর রাখা মানুষের কাছে আয়াক্সের ৫২ বছর বয়সী ডাচ কোচকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার হয়তো দরকার পড়ে না, তবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে তাঁর যাওয়া না–যাওয়ার সঙ্গে যে শুধু টেন হাগের পরিচয় ছাড়াও আরও অনেক প্রশ্ন জড়িয়ে।
তাঁর অধীনে কেমন খেলবে ম্যান ইউনাইটেড? আয়াক্সের মতো বল দখলে রেখে এক স্পর্শের ফুটবলে ছোট ছোট পাসের গতিময় আক্রমণাত্মক ফুটবল কি ম্যান ইউনাইটেডেও খেলাতে পারবেন টেন হাগ? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন সম্ভবত এটি যে টেন হাগের অধীনে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর কী হবে?
এমনিতেই ম্যান ইউনাইটেডে রোনালদোর ভবিষ্যৎ নিয়ে গুঞ্জনের শেষ নেই। ইউনাইটেডের এই ৩৭ বছর বয়সী রোনালদোকে ফিরিয়ে আনা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল, সে নিয়ে প্রশ্ন দিন দিন আরও উচ্চকিত হচ্ছে। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায় নেওয়া ইউনাইটেড লিগের সেরা চারে থাকতে না পারলে আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতেই পারবে না, আর তা হলে রোনালদোও থাকবেন না বলেই গুঞ্জন।
রোনালদো থাকবেন না, এই সম্ভাবনা আরও জোরালো হচ্ছে টেন হাগের সঙ্গে ইউনাইটেডের নাম জড়ানোর পর থেকেই। ডাচ কোচের ‘টোটাল ফুটবলে’র কৌশলের সঙ্গে এই বুড়িয়ে যাওয়া রোনালদো কতটুকু মানিয়ে নিতে পারবেন, সে সংশয়ও ধোঁয়াশা তুলে দিয়েছে রোনালদোর ভবিষ্যৎ ঘিরে। এক রালফ রাংনিকের প্রেসিং ফুটবলের সঙ্গেই রোনালদো মানিয়ে নিতে পারছেন না বলে তাঁর সমালোচনা, টেন হাগের ফুটবলে তো সবাইকে আরও বেশি করে প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিতে ঝাঁপাতে হয়।
তবে ম্যানচেস্টার শহরের পত্রিকা ম্যানচেস্টার ইভনিং নিউজ জানাচ্ছে ভিন্ন খবর—গুঞ্জন মিথ্যা প্রমাণ করে রোনালদো ওল্ড ট্রাফোর্ডেই থেকে যাবেন। বাস্তবতা বলে, এই ৩৭ বছর বয়সের রোনালদোকে এত বেতনে ইউরোপের সেরা পাঁচ লিগের শীর্ষ ক্লাবগুলো নিতে চাইবে না। সে ক্ষেত্রে বড় ক্লাব বলতে এক ম্যান ইউনাইটেডই ভরসা। না হলে আবেগের মূল্য দিয়ে স্পোর্তিং লিসবনে ফেরা বা অর্থকে ভালোবেসে যুক্তরাষ্ট্রে ডেভিড বেকহামের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে যাওয়ার (যদিও ধর্ষণ মামলার কারণে রোনালদোর যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার ক্ষেত্রে ঝামেলা হতে পারে) পথই শুধু খোলা থাকবে। সব বিবেচনায় নিয়ে ম্যানচেস্টার ইভনিং নিউজ জানাচ্ছে, রোনালদো আগামী মৌসুমেও ইউনাইটেডেই থাকবেন।
যদি থাকেন, টেন হাগ তা চাইছেন বলেই থাকবেন। রোনালদো বল দখলের লড়াইয়ে হয়তো সেভাবে নামতে পারবেন না, কিন্তু এখনো গোল করায় রোনালদোকে টেক্কা দেওয়ার মতো কে আছেন এই ইউনাইটেডে? এই মৌসুমেও লিগে রোনালদোর ১২ গোলের চেয়ে বেশি শুধু লিভারপুলের তিন ফরোয়ার্ড সাদিও মানে, দিয়োগো জোতা, মোহামেদ সালাহ আর টটেনহামের সন হিউং মিনের। নতুন দেশে নতুন ক্লাবে গিয়েই অন্য অনেক কিছু যেখানে সামলাতে হবে, সেখানে টেন হাগ নিশ্চয়ই রোনালদোকে বাতিল করে দিয়ে ‘আমার দলে গোল করবে কে’ প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে বসবেন না!
তবে টেন হাগের অধীনে যে রোনালদোদের দাপট কিছু খর্ব হতে যাচ্ছে, তা মনে হয় নিশ্চিতই। ইংলিশ সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, গত নভেম্বরে যখন রালফ রাংনিকের চেয়েও আন্তোনিও কন্তে ইউনাইটেডের কোচ হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন, তখন রোনালদো ভেটো দিয়েছিলেন কন্তের ব্যাপারে। ইউনাইটেড বোর্ডেও দু-একজনের আপত্তি ছিল কন্তের ‘ডিফেন্সিভ ফুটবল’ নিয়ে, তবে রোনালদোর আপত্তি বোর্ডের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে। রাংনিককে দিয়েও তেমন লাভ না হওয়ায় ইউনাইটেড আগামী মৌসুমের জন্য যখন কোচ খুঁজছে, রোনালদোদের ড্রেসিংরুমে মরিসিও পচেত্তিনোর প্রতি আগ্রহ ছিল বলেও জানাচ্ছে ম্যানচেস্টার ইভনিং নিউজসহ আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। কিন্তু এবার আর ড্রেসিংরুমের আগ্রহ-অনাগ্রহকে পাত্তা না দিয়ে টেন হাগকেই বেছে নিয়েছে ইউনাইটেড।
কিন্তু টেন হাগই কেন? দৌড়ে স্পেন জাতীয় দলের কোচ লুইস এনরিকের নাম ছিল, কিন্তু কাতার বিশ্বকাপের আগে তিনি স্পেন দল ছাড়বেন না বলে সেই আলোচনা আর এগোয়নি। বাকি ছিলেন পচেত্তিনো আর টেন হাগ। পচেত্তিনো টটেনহামের হয়ে ইংলিশ লিগ মাতিয়ে গেলেও পিএসজিতে তাঁর পারফরম্যান্স তাঁকে দৌড়ে পিছিয়ে দিয়েছে। না মেসি-নেইমারদের তারকাখচিত ড্রেসিংরুম সামলাতে পেরেছেন, না পেরেছেন ফ্রান্সে ‘ছোট পুকুরের বড় মাছ’ পিএসজিকে শিরোপা জেতাতে। আয়াক্সও নেদারল্যান্ডসে ‘ছোট পুকুরের বড় মাছ’ই, কিন্তু টেন হাগের কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ আর দারুণ ফুটবলে আয়াক্স নিয়মিত শিরোপা জিতে গেছে। সেটিই ইউনাইটেডের নজর কেড়েছে।
২০০২ সালে খেলা ছাড়ার ১০ বছর পর কোচিংয়ে আসা টেন হাগ নিজের কোচিং দর্শনে পেপ গার্দিওলার অবদানের কথা অকপটেই স্বীকার করেন। ডাচ দ্বিতীয় বিভাগের দল গো অ্যাহেড ঈগলসকে দিয়ে তাঁর কোচিং শুরু, কিন্তু সেই দলকে প্রথম বছরেই প্রথম বিভাগে উঠিয়ে ২০১৩ সালে টেন হাগ চলে যান বায়ার্ন মিউনিখের রিজার্ভ দলের কোচ হতে। কেন? গার্দিওলার কাছ থেকে শিখতে! সে সময় গার্দিওলাই যে বায়ার্নের কোচ!
সেখানে দুই বছরে শিখেছেন, এরপর নেদারল্যান্ডসের উটরেখটে ফিরে ক্লাবটিকে প্রথম বছরে লিগে চতুর্থ ও দ্বিতীয় বছরে তৃতীয় বানিয়েছেন। আশির দশকের পর যা উটরেখটের সেরা সাফল্য। ২০১৭ সালে আয়াক্সে ডাক পাওয়া সে কারণেই। এত দিন ছোট ক্লাবে সেভাবে শিরোপা আসেনি, কিন্তু আয়াক্সে শিরোপা পেতে সময় লাগেনি টেন হাগের। পাঁচ বছরে দুটি লিগ জিতেছেন, করোনা বাধা হয়ে না দাঁড়ালে সংখ্যাটা তিন হতো। এবার লিগে ৫ ম্যাচ বাকি, দুইয়ে থাকা পিএসভির চেয়ে ৪ পয়েন্ট এগিয়ে আয়াক্স। তৃতীয় লিগ শিরোপা বুঝি হয়েই যাবে! ডাচ কাপও জিতেছেন দুবার, আগামী রোববার ফাইনালে পিএসভিকে হারালে সেখানেও সংখ্যাটা তিন হবে এবার।
তবে নেদারল্যান্ডসের ঘরোয়া ফুটবল দিয়ে তো আর সেভাবে নজরে আসার কথা নয়, টেন হাগ নজরে এসেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগে আয়াক্সের সাফল্য আর চোখধাঁধানো ফুটবলের কারণে। ২০১৮-১৯ মৌসুমে আয়াক্সকে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে তুলেছেন—১৯৯৭ সালের পর আয়াক্সের প্রথমবার ইউরোপে এমন সাফল্য। রিয়াল মাদ্রিদকে শেষ ষোলোতে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছেন রিয়ালেরই মাঠে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে। রোনালদো তত দিনে রিয়াল ছেড়ে জুভেন্টাসে, শেষ আটে সেই জুভেন্টাসকেই হারিয়েছে টেন হাগের আয়াক্স।
ঝামেলা হলো, আয়াক্স নেদারল্যান্ডসের ছোট পুকুরে বড় মাছ, ইউরোপের সাগরে তো খাবি খায়! ওই মৌসুমের সাফল্যের কারণেই একে একে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং, ম্যাটাইস ডি লিখট, ডনি ফন ডি বিকরা দলছুট হলেন। থেকে গেলেন শুধু টেন হাগ। আয়াক্সের জন্য অতটুকুই যথেষ্ট ছিল।
নতুন খেলোয়াড় নিয়ে গুছিয়ে নিতে মাঝে দুই মৌসুম সময় লেগেছে। এই মৌসুমে আবার চ্যাম্পিয়নস লিগে দারুণ ফুটবল খেলেছে আয়াক্স। ব্রাজিলের সেনসেশন আন্তোনি ইউরোপের নজর কেড়ে চলেছেন, ওয়েস্ট হামে ব্যর্থ স্ট্রাইকার সেবাস্তিয়ান আলের এই মৌসুমে সেখানে গিয়ে খুঁজে পেয়েছেন নতুন দিশা। যদিও এবার ফুটবলটা মন রাঙালেও সাফল্য সেভাবে আসেনি।
বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, স্পোর্তিং লিসবন আর বেসিকতাসকে নিয়ে গড়া গ্রুপে ছয় ম্যাচের সব কটিতে জয়ের পথে প্রতিপক্ষকে গোলে ভাসিয়েছে আয়াক্স। গোল করেছে ২০টি, খেয়েছে ৫টি। কিন্তু সেই আয়াক্সই শেষ ষোলোতে কীভাবে বেনফিকার কাছে হেরে গেল, সে এক আশ্চর্য বটে!
কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সেটি নিয়ে পড়ে থাকছে না। কৌশলের দিক থেকে ক্লপ-গার্দিওলাদের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার মতো, এই ৫২ বছর বয়সেও ইউরোপে তারকা কোচ হওয়ার পথে ছুটতে থাকা টেন হাগকে বেছে নিতে ইউনাইটেডকে খুব বেশি ভাবতে হয়নি।