বিতর্কটা কখনো শেষ হওয়ার নয়। তবু বিতর্ক ওঠে, সামনেও উঠবে, সম্ভবত এভাবেই চলবে। খেলাধুলার এই এক মজা। কে সেরা—এই প্রশ্নে বিতর্ক চিরকালীন। রজার ফেদেরার না রাফায়েল নাদাল? জবাব পৃথিবী দুই ভাগে ভাগ হওয়াই স্বাভাবিক। বরিস বেকার দাঁড়ালেন ঠিক তার মাঝে। ছয়বারের গ্র্যান্ডস্লামজয়ী এই জার্মান নিরপেক্ষভাবে চেষ্টা করলেন বাছাইয়ের—কে সর্বকালের সেরা। তবু করা গেল কি! বরং বরিসের মতামত নিয়েও বিতর্ক হতে পারে।
তবে টেনিস-মুদ্রার এই দুই এপিঠ-ওপিঠ কিন্তু একটি জায়গায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। সেটি গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের সংখ্যায়—সমান ২০টি করে গ্র্যান্ডস্লাম জিতেছেন এই দুই কিংবদন্তি। কিছুদিন আগে ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে ফেদেরারকে ছুঁয়ে ফেলেন নাদাল। তাঁদের খেলার কৌশল ব্যবচ্ছেদ করে সেরাকে বেছে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন বরিস বেকার। ডেইলি মেইলে নিজের কলামে ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড, ভলি, সার্ভ...খেলার কৌশলগত প্রতিটি দিকে ফেদেরার-নাদালকে ১০-এর মধ্যে নম্বর দিয়েছেন বেকার।
ফোরহ্যান্ড (পূর্ণমান ১০)
ফেদেরার (৯): ওর এই শট আশির দশকের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। পশ্চিমা গ্রিপ (র্যাকেট ধরা) ছাড়াই বল বেশি না তুলে টানা মারতে পারে। কোর্টের যে কোনো জায়গা থেকে এটি বিধ্বংসী শট। তবে রাফা এই শটে যে দানবীয় ক্ষমতা ধারণ করে তেমন নয়।
নাদাল (১০): অনন্য শট। র্যাকেটের মাথা দিয়ে মারতে পারে, ফলো-থ্রু আছে। এতে শটে যেমন শক্তি থাকে তেমনি বাঁক। বলটা পড়ার পর ওঠেও তুলনামুলক বেশি। প্রতিপক্ষের ব্যাকহ্যান্ড শটের জবাব হিসেবে এর জুড়ি নেই।
ব্যাকহ্যান্ড (পূর্ণমান ১০)
ফেদেরার (৮): টেনিসের ওল্ড-স্কুল শট। কৌশলটা পুরোনো হলেও ধ্রুপদী। আর ফেদেরার এই শটের ভীষণ বিশ্বস্ত ও দক্ষ সেবক। দ্রুতলয়ের কোর্টে এই শটে সে খুব ভালো। ব্যাকহ্যান্ডে ও যেভাবে বল বাঁক খাওয়ায় সেটা ওর প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ভালো।
নাদাল (৮): বেশি না, ১০ বছর আগেও এই শটে ওর দুর্বলতা ছিল। বৈচিত্র ছিল কম। কিন্তু এ সময়ের মাঝে সে অবিশ্বাস্য উন্নতি করেছে। দুই হাতই সমানতালে ব্যবহার করতে পারায় এই শট নিতে রাফা একটু সুবিধা পায়। রোববারের (ফ্রেঞ্চ ওপেন) ফাইনাল জয়ে ওর এই শটের ভূমিকা ছিল অনবদ্য।
ভলি (পূর্ণমান ১০)
ফেদেরার (১০): ওর হাত ও চোখের সমন্বয় দুর্দান্ত। বলটা আগেই দেখায় ভলিটা কোথায় ফেলবে, কোথায় মারবে—তা খুব ভালোভাবেই করতে পারে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ও নেটের সামনে এসে খেলতে পারে, তাই এই শটে ও অনন্যসাধারণ দক্ষ।
নাদাল (৯): রাফারও হাত ও চোখের সমন্বয় ভালো। কেন জানি মনে হয়, এই শটে ওকে কোনো কারণ ছাড়াই একটু পিছিয়ে রাখা হয়। বেসলাইন ওর রাজত্বের জায়গা হলেও নেটের সামনে সে যেভাবে খেলে, তা অন্য যে কোনো খেলোয়াড় পেতে চাইবে।
সার্ভ (পূর্ণমান ১০)
ফেদেরার (৯): অবিশ্বাস্যরকম নিখুঁত। কোথায় ফেলবে তা জানে। প্রতিপক্ষের জন্য বুঝে ওঠা কঠিন। ওর দ্বিতীয় সার্ভও ধ্রুপদী, ভীষণ মসৃণ। দেখে মনে হয় কোনোরকম শক্তিপ্রয়োগ ছাড়াই করতে পারে।
নাদাল (৮): গত ১০ বছরে রাফার উন্নতির আরেকটি জায়গা, এ সময়ের মাঝে এখানে সে দারুণ উন্নতি করেছে। আগে ওর এখানে দুর্বলতা ছিল। সার্ভ আরও শক্তিশালি, দ্রুতগামী করার কৌশলটা সে আয়ত্ত করেছে।
নড়াচড়া (পূর্ণমান ১০)
ফেদেরার (৯): পরিষ্কার বোঝা যায়, ১০ বছর আগের তুলনায় এখন ততটা পারে না। তবুও ওর এই বয়সে এটাই অবিশ্বাস্য। দেখে মনে হয় নাচছে। ছোট ছোট দ্রুতলয়ে পা ফেলে সে ঠিক জায়গায় পৌঁছে যায়।
নাদাল (১০): ওর মতো পেশিবহুল শরীর নিয়ে এমন নড়াচড়াটা অবিশ্বাস্য। রোববারের ফাইনালেই তা দেখা গেছে। সে যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকে বলের পেছন থেকে খেলেছে তা দেখে অবিশ্বাস্য লাগলেও বাস্তব।
অলরাউন্ডার (পুর্ণমান ১০)
ফেদেরার (১০): কাদামাটির কোর্টে ওর দুর্বলতা নিয়ে কথা হতে পারে। কিন্তু ঘাসের কোর্টে সে অবশ্যই এগিয়ে। নানারকম কোর্টে যে মোট ২০টি গ্র্যান্ডস্লাম জিতেছে তাকে কীভাবে ১০ নম্বর দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন?
নাদাল (১০): হ্যাঁ, বেশিরভাগ গ্র্যান্ডস্লামই সে জিতেছে কাদামাটির কোর্টে। কিন্তু উইম্বলডন সে দুবার জিতেছে। আর ৯ বছরের মধ্যে ইউএস ওপেন জিতেছে চারবার। আছে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন শিরোপাও। ১০ নম্বর ওর প্রাপ্যই।
খুনে মানসিকতা (১০ নম্বর)
ফেদেরার (১০): ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে থাকতে যেমন ছিল এখন হয়তো তেমনটা দেখা যায় না। তাই বলে ফেদেরারের হাবভাব দেখে বোকা বনে যাবেন না! সে একজন নির্মম প্রতিযোগি। কাজটা করার সময় রাফার চেয়ে তার মুখে হাসিটা একটু বেশি লেগে থাকে—এই যা!
নাদাল (১০): খোলা বইয়ের পাতার চেয়েও বেশি। ইস্পাতদৃঢ় সংকল্প ফুটে ওঠে ওর চোখেমুখে। অনেক অনেক সময় ধরে মনোযোগটা ধরে রাখতে পারে।
স্থায়ীত্ব (পূর্ণমান ১০)
ফেদেরার (১০): চল্লিশ বছর বয়সের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েও সেরাদের মধ্যে থাকা কাউকে নিয়ে এ ব্যাপারে প্রশ্ন চলে না। আমি এখনো বিশ্বাস করি, আরও গ্র্যান্ডস্লাম জিততে পারবে বলেই সে বিশ্বাস করে। বিশেষ করে উইম্বলডন—তা না হলে সে খেলা চালিয়ে যেত না।
নাদাল (৯): দেখে অবিশ্বাস্য লাগে, এই বয়সেও সে খেলার ধারটা ধরে রাখছে। এখন থেকে তাঁর ৩৯ বছর বয়সের মধ্যে কী ঘটবে তা আমরা জানি না। কিন্তু সে একজন অবিশ্বাস্য পেশাদার, নিজের জীবনযাপনের ধরন এবং চোট থেকে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতার কারণে আরও বেশ কিছুদিন খেলতে পারবে বলে মনে করি।
জনপ্রিয়তা (পূর্ণমান ১০)
ফেদেরার (১০+): খেলাধুলার একজন কিংবদন্তি, দূত। সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিও। মাইকেল জর্ডান কিংবা মোহাম্মদ আলীর পাশে রাখতে পারেন। হয়তো রাফার চেয়েও লোকে ওকে বেশি পছন্দ করে। এটা কিন্তু জনপ্রিয়তার অবিশ্বাস্য মানদন্ড।
নাদাল (১০): রাফার ১৪ বছর বয়সে ওর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল। সত্যি বলতে সে এতটুকুও পাল্টায়নি। লোকে ওকে ভালোবাসে সরলতা, বিনয় এবং যেভাবে অন্যকে সম্মান দেখায় সেসবের জন্য। অবিশ্বাস্যরকম প্রশংসা করে সবাই ওর।
রজার ফেদেরারকে মোট ৮৫ পয়েন্ট দিয়েছেন বরিস বেকার। রাফায়েল নাদাল পেয়েছেন ৮৪ পয়েন্ট। এ নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে অন্তত জানুয়ারি পর্যন্ত। কেননা, তখন অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে নামার সুযোগ পাবেন দুই কিংবদন্তি। দুজনের কেউ শিরোপা জিতলে এগিয়ে থাকবেন অন্তত শিরোপাসংখ্যায়।
তবে সেটা তো শুধুই সংখ্যা, খেলার কথা ধরলে এ বিতর্ক সম্ভবত টিকে থাকবে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত।