আইপিএল খেলতে ভারতে গিয়ে আপাতত মুম্বাইয়ের এক হোটেলে কোয়ারেন্টিন সময় কাটাচ্ছেন সাকিব আল হাসান। সেখান থেকেই কাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওয়ানডের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার বলেছেন টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা। এসেছে নিউজিল্যান্ড সফরের ব্যর্থতা এবং জাতীয় দলে অভিজ্ঞদের বিকল্প তৈরি না হওয়ার প্রসঙ্গও—
তারেক মাহমুদ :
এবার আবারও কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে আইপিএল খেলবেন। এটা কি ঘরের ছেলের ঘরে ফেরার মতো ব্যাপার হলো?
সাকিব আল হাসান
অনেকটা ও রকমই বলতে পারেন। যদিও এবার কলকাতায় খেলা হচ্ছে না, এটা একটা আফসোস। এখনো আমার কোয়ারেন্টিন শেষ হয়নি। দুই দিন বাকি আছে। দলের সঙ্গে যোগ দেব এরপর।
প্রশ্ন :
আপনি এবার আইপিএলে যাওয়ার আগে তো অনেক আলোচনা–বিতর্ক হলো। আপনি বলেছেন, আইপিএলে খেলতে শ্রীলঙ্কায় টেস্ট সিরিজ থেকে ছুটি চাওয়ার ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে বোর্ড। বিসিবিও পাল্টা বক্তব্য দিয়েছে। বিষয়টা এখন কোন অবস্থায় আছে?
(হাসি) এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না।
প্রশ্ন :
মাঝে কয়েক দিনের জন্য দেশে এসেছিলেন। বোর্ডের কারও সঙ্গে তখন বিষয়টা নিয়ে কথা হয়েছে?
না, এ নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
প্রশ্ন :
এ ঘটনায় কি বোর্ডের সঙ্গে আপনার দূরত্ব বাড়ল?
এই মুহূর্তে আমি পুরোপুরি আইপিএলে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমার চিন্তায় এখন শুধু এটাই আছে। এর বাইরে আর কিছু নেই।
প্রশ্ন :
টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? সাম্প্রতিক বিতর্ক কিন্তু সেই কৌতূহলেরও জন্ম দিয়েছে প্রবলভাবে…
দেখুন, যেহেতু আগামী দুই বছরে পরপর দুটি টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আছে, এই সময়ে আমরা খুব বেশি টেস্ট খেলব বলেও মনে হয় না। শ্রীলঙ্কায় তো আমি খেলছি না, বিশ্বকাপের আগে হয়তো আর আমরা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই টেস্ট খেলব…সেটাও এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগপর্যন্ত তো আর কোনো টেস্ট ম্যাচই নেই। সে জন্য এখন টেস্ট নিয়ে আলাপ করাটাও যুক্তিযুক্ত মনে হয় না আমার কাছে।
প্রশ্ন :
তবু ভবিষ্যতের কথা যদি বলেন, টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে নিশ্চয়ই আপনার একটা পরিকল্পনা আছে…
আমি কত দিন খেলতে পারব, টেস্ট ম্যাচ আমাদের কী রকম আছে; সবকিছুর ওপরই এটা নির্ভর করছে। ১২–১৪ বছর তো হয়ে গেল টেস্ট খেলছি। তারপরও টেস্ট খেলেছি কয়টা? ৬০টিও (৫৭টি) হয়নি এখনো। অথচ আমাদের সঙ্গে অন্য দেশের যারা টেস্ট খেলা শুরু করেছে, তাদের মধ্যে এমন খেলোয়াড়ও আছে যাদের ১০০–১২০টা টেস্ট খেলা হয়ে গেছে। আমাদের এত টেস্ট খেলার সুযোগ হয় না। এর ভেতরে আবার চোট, বহিষ্কারাদেশ, ব্যক্তিগত কারণে না খেলা—এসব মিলিয়ে আরও কিছু টেস্ট খেলতে পারিনি। মুশফিক ভাইয়ের কথা যদি বলি, আমাদের মধ্যে যিনি খুব বেশি টেস্ট মিস করেননি, তিনিও তো মনে হয় ৭০টির (৭২) বেশি টেস্ট খেলেননি।
প্রশ্ন :
আপনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয়তো আর তিন–চার বছরই খেলবেন। যত দিনই খেলেন, ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত টেস্ট খেলতে চাইবেন?
এগুলো আসলে কেউ পরিকল্পনা করে ঠিক করতে পারে না। অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। এখন ধরুন আমার পারফরম্যান্স খারাপ হওয়া শুরু হলো। তখন এক বছর পরই দেখা যাচ্ছে আর খেললাম না। আবার ভাবলাম দুই বছর খেলব। কিন্তু দেখা গেল, এই দুই বছর এত ভালো খেলে ফেললাম যে আমারও খেলতে ভালো লাগছে, আবার দলেরও আমাকে দরকার, তখন হয়তো খেললাম। তবে হ্যাঁ, আমার চেষ্টা থাকবে প্রতিটি ফরম্যাটেই যেন আমি জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারি।
প্রশ্ন :
আপনি বলেছেন, বাংলাদেশের টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্টে শ্রীলঙ্কার দুটি টেস্ট খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে নিকট ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের ভালো কিছুর সম্ভাবনা নেই। তাই বলে কি ক্রিকেটাররা টেস্ট থেকে সরে থাকবেন?
আমি তো এটাও বলেছি, প্রতিটি ম্যাচ জেতাই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অবশ্যই টেস্ট খেলতে হবে, টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতির চেষ্টা করতে হবে এবং টেস্ট জিততে হবে। আমাদের যত বেশি সম্ভব টেস্ট খেলতে হবে, যে সুযোগগুলো আসবে খেলার, সেগুলো নিতে হবে।
প্রশ্ন :
এটা কি সব খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়?
অবশ্যই।
প্রশ্ন :
আপনি ছুটি নিলেন, তামিম ইকবাল ব্যক্তিগত কারণে নিউজিল্যান্ডে টি–টোয়েন্টি খেললেন না। এর আগে বিসিবি সভাপতিও বলেছেন, অভিজ্ঞদের এখন আর সব সময় একসঙ্গে পাওয়া যাবে না, এটাই বাস্তবতা। আপনারও কি তা–ই মনে হয়?
এই সিদ্ধান্ত আসলে বোর্ডই ভালো নিতে পারবে। নীতিনির্ধারক যাঁরা আছেন, সঙ্গে কোচিং স্টাফ, নির্বাচকেরা মিলেই ঠিক করবেন তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী বা তাঁদের কোন দিকে চিন্তা করা উচিত। খেলোয়াড়েরা তো যত দিন ভালো খেলবে, তত দিনই খেলে যেতে চাইবে। জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব কে না করতে চায়! তবে কার সার্ভিস দরকার, কার সার্ভিস দরকার নয়, এগুলো তো বোর্ড চিন্তা করতেই পারে।
যে ভালো খেলতে থাকবে, সে দলে থাকবে। যে ভালো খেলবে না, সে থাকবে না। সে ১৫ বছরের পুরোনো খেলোয়াড়ই হোক, আর ৫ দিনের নতুন খেলোয়াড়ই হোক।
প্রশ্ন :
কিন্তু আপনার কি মনে হয় আপনি, তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহর পর যাঁরা দলে এসেছেন, তাঁরা এর মধ্যেই প্রস্তুত আপনাদের শূন্যতা পূরণ করতে?
দেখুন, একসময় বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারই হতো পাঁচ–ছয় বছরের। এখন দলে যারা পাঁচ–ছয় বছর খেলে ফেলেছে, তাদের তো আর তরুণ বলা যাবে না। আর সিনিয়র–জুনিয়র, এভাবে আমি কখনো দেখি না। হ্যাঁ, নতুন অনেকেই দলে আসতে পারে। তবে জাতীয় দলে তৈরি খেলোয়াড় আসা ভালো। এখন দলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে গেছে। আমাদের সময় জাতীয় দলে এসে তৈরি হওয়ার সুযোগ ছিল। এখন জাতীয় দলে তৈরি হয়েই আসতে হবে।
প্রশ্ন :
জাতীয় দলে পাঁচ–ছয় বছর খেলাটাই কি সব? দায়িত্ব নেওয়ার জায়গায়ও তো আসতে হবে। সে রকম খেলোয়াড় কোথায়!
সে জন্যই বলছি, কে কত দিন ধরে খেলছে, সেটা ধরে বিচার করা যাবে না। পারফরম্যান্সটাই আসল। যে ভালো খেলতে থাকবে, সে দলে থাকবে। যে ভালো খেলবে না, সে থাকবে না। সে ১৫ বছরের পুরোনো খেলোয়াড়ই হোক, আর ৫ দিনের নতুন খেলোয়াড়ই হোক। সবার মানদণ্ড একটাই হতে হবে—পারফরম্যান্স। হ্যাঁ, কারও প্রতি যদি এই আস্থা রাখা যায় যে সে ভালো করবেই, তাকে হয়তো দুইটার জায়গায় পাঁচটা সুযোগ দিতে পারেন।
প্রশ্ন :
আপনারা যাঁরা অভিজ্ঞ আছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে যদি বাংলাদেশ দলের দিকে তাকান, আপনার কি মনে হয় পারফরম্যান্স দিয়ে দলকে এগিয়ে নেওয়ার মতো যথেষ্ট ভালো খেলোয়াড় সেখানে আছে?
সে সুযোগ তো করে দিতে হবে ওদের। যতক্ষণ ওদের দায়িত্ব না দিচ্ছেন, ততক্ষণ কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? কথার কথা, সামনে যখন জিম্বাবুয়েতে দল যাবে, নতুন একটা গ্রুপ আপনি পাঠিয়ে দেখেন না কী করে। আমি জিম্বাবুয়েকে খাটো করছি না। তবে যেসব সিরিজ আমরা মনে করি যে জেতা সহজ হবে, সেসব জায়গায় আমরা তরুণ দল পাঠিয়ে দেখতেই পারি, তারা কেমন করে। সেখান থেকে আপনি দুজন ভালো খেলোয়াড় পেতে পারেন, যারা পরের সিরিজে মূল দলে চলে আসবে। এভাবে আস্তে আস্তে দলের শক্তি বাড়তে থাকবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে তরুণ দলটা বাংলাদেশে এল, ওই দলের মেয়ার্স–বোনার—ওরা এখন মূল দলে খেলছে। তাদের দুটো খেলোয়াড় কিন্তু তৈরি হয়ে গেল। আমি বলছি না যে আপনি ১১ জনই নতুন খেলোয়াড় খেলাবেন। তবে কিছু খেলোয়াড় থাকতেই পারে যাদের অভিষেক হবে, কিছু থাকবে যারা অল্প কিছু ম্যাচ খেলেছে।
প্রশ্ন :
একটা সময় আসবেই যখন আপনারা অভিজ্ঞ চার–পাঁচজন আর থাকবেন না দলে। সেই সময়ে আরেকজন তামিম, মুশফিক বা সাকিব হতে পারবেন, এমন ক্রিকেটার কি দেখেন দলে?
অবশ্যই আছে। আমাদের চেয়ে ভালো খেলবে, এমন ক্রিকেটারও দলে আছে। তবে যেটা বলেছি, তাদের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। একজন খেলোয়াড় যখন এক, দুই, তিন, চার বা পাঁচে ব্যাট করবে; তখন স্বাভাবিকভাবেই তার ওপর দায়িত্ব বেশি থাকবে। ওয়ানডেতে যখন তরুণ বোলাররা ১০ ওভার করে বল করবে, তখন তাদের দায়িত্বটা বেশি। নতুন বলে বল করা বা ডেথ ওভারে বল করা, এসব চ্যালেঞ্জে সফল হলে সে অভিজ্ঞতা তাদের পরে কাজে লাগবে।
প্রশ্ন :
নিউজিল্যান্ড সিরিজ তো শেষ হলো। কেমন দেখলেন বাংলাদেশ দলকে?
নিউজিল্যান্ডে আমরা কখনোই ভালো করিনি। তবে কখনো ভালো করিনি বলে যে কখনো ভালো করব না, সেটাও নয়। ভালো করতে পারিনি, এটা অবশ্যই হতাশার। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ ভালো খেললেও দল হিসেবে পারফর্ম করিনি। দল হিসেবে পারফর্ম না করলে জেতা কষ্ট।
প্রশ্ন :
অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতি এখানে কতটা প্রভাব ফেলেছে মনে করেন?
আমি ছাড়া তো সবাই–ই খেলেছে। হ্যাঁ, টি–টোয়েন্টিতে ছিল না। কিন্তু টি–টোয়েন্টি এমন একটা জায়গা, যেখানে আমাদের পয়েন্ট নিয়ে চিন্তা নেই। বিশ্বকাপ আছে, ওটাই একমাত্র ফোকাস। সেটার জন্য নতুন অনেক কিছুই চেষ্টা করার সুযোগ আছে এবং তার জন্য এটাই উপযুক্ত সময়। সামনে অনেকগুলো টি–টোয়েন্টি ম্যাচ খেলব আমরা। একটা ভালো দল দাঁড় করানোর জন্য বেশ কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা এখন থেকেই শুরু করা উচিত।
প্রশ্ন :
আপনি নাকি টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য আইপিএলে খেলছেন। কিন্তু দলের অন্যদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতির জন্য কী করা উচিত?
বেশি বেশি ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করা দরকার। এবার তো শুনেছি প্রিমিয়ার লিগ হবে টি–টোয়েন্টি সংস্করণে। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। শ্রীলঙ্কা সফরের পর জাতীয় লিগও টি–টোয়েন্টি করে দিতে পারে। বিশ্বকাপের আগে আমাদের ক্রিকেটাররা যদি ঘরোয়া দু–তিনটা টি–টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলতে পারে এবং সেখান থেকে দুজন খেলোয়াড়ও যদি বের হয়, সেটাও ভালো। এ রকম কয়েকটা ঘরোয়া টি–টোয়েন্টির পরিকল্পনা করা যেতে পারে। অবশ্য এখন তো করোনাভাইরাসও একটা বাধা। চাইলেই যে বোর্ড সব করতে পারবে, তা নয়। বাংলাদেশ, ভারতে যেভাবে করোনা বাড়ছে; বিশ্বকাপই হবে কি না, তারও তো নিশ্চয়তা নেই।
প্রশ্ন :
কোচ রাসেল ডমিঙ্গো বলেছেন, ২০২৩ সালের মূল বিশ্বকাপকে মাথায় রেখেই নাকি তিনি এগোচ্ছেন। কিন্তু তার আগেই তো দুটি টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। কোন চিন্তাটাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগোনো উচিত বলে মনে করেন?
সবকিছুকেই গুরুত্ব দিতে হবে। আর ২০২৩ বিশ্বকাপ আসতে আসতে কার অবস্থান কোথায় থাকবে, সেটাও তো এখন বলা কঠিন। আমি মনে করি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে একটা স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাও থাকতে হয়, আবার মাঝামাঝি একটা পরিকল্পনাও থাকতে হয়। সবকিছু নিয়েই এগোতে হয়।