এত খেলা থাকতে আপনি দৌড়টাই কেন বেছে নিলেন?
শিরিন: ছোটবেলায় অন্য কোনো খেলার সুযোগ ছিল না। যত দূর মনে পড়ছে, পাশের বাড়ির মেয়েরা তখন হাঁড়িপাতিল নিয়ে খেলত। কেউ আবার খেলত পুতুল খেলা। স্কুলে যখন বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো, আমি অংশ নিতাম। স্কুলের মাঠ ততটা বড় ছিল না। তখন দৌড় প্রতিযোগিতায় মাঠের এক পাশ থেকে অন্য পাশে দৌড়াতাম। দেখতাম, স্কুলে কেউ পড়াশোনায় প্রথম হলে পুরস্কৃত করা হতো। আমি পড়ালেখায় কখনো প্রথম হতে পারিনি। তবে খেলাধুলায় প্রথম হলেও পুরস্কৃত করা হতো। এটা দেখে দৌড়ের প্রতি আমার আরও ভালো লাগা তৈরি হয়। এমনও হয়েছে, আমাদের ঘর থেকে রান্নাঘরে গেলেও দৌড়ে যেতাম। বৃষ্টির দিনে দৌড়াতে গিয়ে প্রায়ই পড়ে যেতাম। কিন্তু দৌড় থামাইনি। এরপর তো বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া, সেখানে অনেকগুলো ইভেন্ট, অনেকগুলো গেমসেই আমাকে সিলেক্ট করা হয়। কিন্তু আমি দৌড়টাকেই বেছে নিই। কারণ, শৈশব থেকেই দৌড়ের সঙ্গে আমার বন্ধনটা ছিল দারুণ।
২০১৪ সালে প্রথম ১০০ মিটারে সোনা জিতেছিলেন। এবার জিতলেন ১৬ নম্বর সোনা। ১ থেকে ১৬—কোনটি আপনার কাছে বেশি প্রিয়?
শিরিন: প্রতিবার দৌড় শেষ করার পর যে অনুভূতি, সেটা কখনোই আগেরবারের চেয়ে কম নয়। কারণ, দৌড়ের শুরু আর শেষের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমার কাছে কোনোটার গুরুত্ব কোনোটার চেয়ে কম নয়। তবে এটা ঠিক, প্রথম যেবার দ্রুততম মানবী হলাম, তখন অন্য রকম একটা অনুভূতি কাজ করেছে। এর পর থেকে ৫ বার, ৮ বার, ১০ বার, এখন ১৬ বার—এই যে সাফল্যের পাল্লাটা ভারী হচ্ছে, এখানে প্রতিবারই যেন নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছি।
আপনার চেয়ে একবার বেশি দ্রুততম মানবী হয়েছেন নাজমুন নাহার বিউটি। তাঁর রেকর্ড ভাঙা নিয়ে কিছু ভাবছেন?
শিরিন: আসলে আমি এটা (রেকর্ড) নিয়ে তেমন কিছু জানি না। ততটা অবগতও নই।
একজন অ্যাথলেটকে তো সাধারণ জীবন যাপন করলে চলে না। ফিটনেস, পারফরম্যান্স ঠিক রাখতে আপনি কী ধরনের রুটিন মেনে চলেন?
শিরিন: বেশির ভাগ সময় কোচ দিনের শিডিউলগুলো করে দেন। ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একটা রুটিন থাকে। যেখানে দুই বেলা অনুশীলন, সেটা পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা পর্যন্তও দীর্ঘ হয়। খাবারের জন্য নির্দিষ্ট একটা সময় থাকে। একজন স্প্রিন্টারের জন্য যেসব স্বাস্থ্যকর খাবার দরকার, সেগুলো খেতে হয়। তবে স্প্রিন্টের যে পুষ্টিবিদ, সেটা আমি পাই না। কারণ, সেটা অনেক ব্যয়বহুল। কারও কাছ থেকে যদি ছয় মাসেরও একটা তালিকা নিতে হয়, তাঁকে দুই লাখ টাকা পেমেন্ট করতে হয়। সে ক্ষেত্রে কোচ যতটুকু পারেন রুটিন ঠিক করে দেন, আর সেটা আমি মেনে চলি।
অ্যাথলেটিকসের অ্যাডহক কমিটির সদস্যপদে আছেন। কেন এ দায়িত্বে আসা?
শিরিন: প্রথমত, আমি একজন অ্যাথলেট, এরপর খেলোয়াড় প্রতিনিধি। যেহেতু এখনো খেলছি, সেহেতু আমার সঙ্গে যারা খেলছে, তাদের মনের ভাব, চাওয়া-পাওয়া, তাদের আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-কষ্ট কিংবা কীভাবে আরও ভালো করবে, এই বিষয়গুলো অনেক সময় তাদের কাছ থেকে জানতে পারি এবং নিজেও সেটা উপলব্ধি করি। চেষ্টা করছি সেই জায়গাগুলোকে ঠিকঠাকভাবে উপস্থাপন করার, ভবিষ্যতেও চেষ্টাটা অব্যাহত থাকবে।
দেশের মধ্যে সোনা জেতা আপনার কাছে রীতিমতো ডালভাত। কিন্তু দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতায় সেটা হয় না কেন? ঘাটতিটা কোথায় দেখছেন?
শিরিন: দেশের মধ্যে নিয়মিত প্রথম হতে যে শ্রম দেওয়া লাগছে না বা কোনো চেষ্টা করা লাগছে না, এমন কিন্তু নয়। তবে সাফল্যটা আমার একার জন্য আসে না, এটা পুরোপুরি সম্মিলিত একটা প্রচেষ্টা। এখানে খাবারের বিষয় থাকে, ফিজিওর বিষয় থাকে, থাকা-খাওয়া, আরও অনেক বিষয় জড়িত, যেটা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাথলেটরা অনুসরণ করেন। যেখানে অনুশীলন একটামাত্র দিক, এরপর খাবার, নিউট্রিশন, ফিজিও, আরও কিছু বিষয় থাকে। আসলে আমাদের যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, এগুলো যদি আরও ভালো হয়, তাহলে পারফরম্যান্সও আরও ভালো হবে। অর্থাৎ এখন যা আছে খারাপ নয়, তবে ভালো হলে আরও ভালো কিছু করতে পারব।
একজন নারী হিসেবে অ্যাথলেট হওয়া কতটা কঠিন ছিল আপনার জন্য? এত দূর আসতে কী রকম বাধা পেরোতে হয়েছে?
শিরিন: শুধু নারী নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই খেলোয়াড় হয়ে ওঠাটা সহজ নয়। আপনি দেখবেন, ছেলেদেরও বহু বাধাবিপত্তি ডিঙাতে হয়। আমরা এখনো ওই পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি, যেখানে একটা শিশু বেড়ে ওঠার পর খেলোয়াড় হতে চাইলে তাকে সহজেই খেলোয়াড় হতে দেওয়া হবে। তা ছাড়া ক্রিকেট-ফুটবল বাদে অন্য খেলাগুলোর অবস্থা খুব একটা ভালোও দেখি না।
শুরুর দিকে যখন আপনি অ্যাথলেট হওয়ার কথা মা–বাবাকে বলেছিলেন, তখন তাঁদের উত্তর কী ছিল? এখন আপনার সফলতা দেখে তাঁরা কী বলেন?
শিরিন: প্রথম দিকে তাঁরা কখনোই চাননি আমি অ্যাথলেট হই। আমার বাড়ি সাতক্ষীরা, একেবারে গ্রামেই আমার জন্ম। সাধারণত রক্ষণশীল পরিবারে একটা মেয়ের জন্মের পর প্রাপ্তবয়স্ক হলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় বা একটা সময় পর্যন্ত পড়াশোনা করানো হয়। আমার মা–বাবাও এমন মানসিকতারই ছিলেন। আমি হাল ছাড়িনি। এটা ঠিক, তাঁরা সব সময় একটা দুশ্চিন্তায় থাকতেন, আমি ঠিক পথে আছে কি না, ভালো আছি কি না, সুস্থ আছি কি না। এসব বিষয় নিয়ে সব মা–বাবাই ভাবেন। সেদিক থেকে আমার মা–বাবাও ব্যতিক্রম ছিলেন না। যখন আমি বিকেএসপিতে ভর্তি হই, তখন আমার এলাকার আর কোনো মেয়ে বিকেএসপিতে ছিল না। তখন তো তাঁরা (মা–বাবা) বুঝতেন না বিকেএসপি কী, অ্যাথলেট কী। এমনকি আমি ভর্তির আগেও অ্যাথলেটিকস নামটা পর্যন্ত শুনিনি। সে ক্ষেত্রে গ্রামের একটা মেয়ে অনেক কিছুই জানে না, তাকে এত দূর আসতে কতটুকু সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন! এখন আর সেই দৃশ্য নেই। অনেক কিছুই বদলে গেছে। গ্রামের অনেক মা–বাবা এসে বলেন, আমার মেয়েটাকে তোমার মতো বানাতে চাই। এমনকি অনেককেই বলতে শুনি, আমার মেয়ে হলে শিরিনের মতো যেন হয়।
ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের বাইরে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ বা চাওয়া আছে? যেমন এটা হলে ভালো হতো বা আমি ওটা হতে চেয়েছিলাম, পারিনি; এমন কিছু...
শিরিন: আক্ষেপ বলতে কিছু নেই। আমার যেটা মনে হয়, একজন শিরিন আক্তারের দিকে লাখো মেয়ে তাকিয়ে আছে। সে ক্ষেত্রে শিরিন আক্তারকে এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত, যেমন করে একটা রজনীগন্ধা ফুলের ঘ্রাণ ছড়ালে সবাই সেটা নেওয়ার জন্য আগ্রহী থাকে। সেদিক থেকে আমি বলব, এমন রোল মডেল দরকার, যাতে হাজারো মেয়ে এই পথে চোখ বন্ধ করে আসতে চায়।
সবকিছুরই শেষ থাকে! আপনাকেও নিশ্চয়ই শেষের পথিক হতে হবে। ক্যারিয়ার শেষে কী করতে চান?
শিরিন: এখনো সেভাবে কিছু ভাবা হয়নি। তবে যখন যেভাবে কাজ করার সুযোগ আসবে, সেভাবে কাজ করার চেষ্টা করব।
দেশের অ্যাথলেটদের মধ্যে অনেকেই একই অঙ্গনের মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। আপনার এমন কোনো ইচ্ছা আছে?
শিরিন: হ্যাঁ, তেমন চিন্তা তো আছেই! আর বিয়ে নিয়েও ভাবতে হবে। শিগগিরই জানতে পারবেন। আর জীবনসঙ্গী যদি অ্যাথলেট বা ডাক্তার হয়, তাহলে অনেক কিছু বুঝতে, জানতে, এমনকি বোঝাপড়া করতেও সুবিধা হয়।
তাহলে কেমন পাত্র পছন্দ আপনার?
শিরিন: পাত্র হিসেবে সুস্থ মানসিকতার মানুষই আমার পছন্দ (হাসি)।