ইদানীং অনেক টি-টোয়েন্টি খেলছেন…আগে কখনো এভাবে টানা টি-টোয়েন্টির মধ্যে ছিলেন?
হোল্ডার: আমি কয়েক বছর ধরেই খেলছি। এবার হয়তো প্রথম একটানা টি-টোয়েন্টি খেলছি। আমার জন্য মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার আছে কিছুটা। তবে দিন শেষে খেলাটা তো ব্যাট আর বলেরই।
বিশ্বকাপের কথা মাথায় রেখেই কি এত টি-টোয়েন্টি খেলছেন?
হোল্ডার: আমি এ বছর কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছি। এর মূল কারণ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এখন বিশ্বকাপ দলে থাকার জন্য সবকিছু করছি। সিদ্ধান্তটা ভেবেচিন্তেই নেওয়া। বছরের শুরুর দিকটা ঠিকভাবে ব্যবহার করে টি-টোয়েন্টির মানসিকতায় ঢুকতে চেয়েছিলাম। এরপর ইংলিশ গ্রীষ্ম থেকে টেস্ট ক্রিকেটকে গুরুত্ব দেব।
বাংলাদেশে তো কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নাম সরিয়ে নেওয়ার কথা কোনো ক্রিকেটার চিন্তাই করতে পারেন না...
হোল্ডার: দেখুন, অনেকেই ভেবেছে আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি। বিষয়টি একদমই তা নয়। আমি বছরের শুরুটাকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছি। সেটা বিশ্বকাপের জন্যই। এটাও ঠিক, আমি ক্যারিয়ারের যে জায়গায় আছি, এ সময় আমাকে সর্বোচ্চ আয়ের একটা ব্যবস্থাও করতে হবে। আমার বয়স এখন ৩২-৩৩। জানি না, কত দিন খেলব। তবে আমি আন্তর্জাতিক খেলা ছাড়ছি না। ইংল্যান্ড সফর দিয়েই টেস্ট ক্রিকেটে ফিরছি।
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, টেস্ট ক্রিকেটটা এখনো আপনার প্রথম পছন্দ...
হোল্ডার: দেখুন, আমি নিজেকে মাটির মানুষ ভাবতে পছন্দ করি। আমার পরিবারকে ঘিরেই আমার জীবন। আমি ক্রিকেটের ছাত্রও। আর আমি যখন বড় হই, তখন কোনো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ছিল না। আমি বড় হয়েছি টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেট দেখে। ওই দুই সংস্করণই খেলার প্রতি আমার ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে। কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশদের খেলা দেখতে খুব পছন্দ করতাম। ক্রিকেট নিয়ে আমার আবেগ সেখান থেকেই। এরপর আমি নিজেও টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছি। টেস্ট ক্রিকেট খেলা অনেক কষ্টের ব্যাপার। এরপর আপনি যখন সাফল্য পাবেন, তা আগের সব কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়। এ কারণেই আমি টেস্ট ক্রিকেট ভালোবাসি। প্রথম চার দিন মনে করেন কিছুই হলো না। পঞ্চম দিনের প্রথম দুই ঘণ্টার দারুণ ক্রিকেটে হয়তো জিতে গেলেন। যা আগের চার দিনের পরিশ্রমকে ভুলিয়ে দেয়। একটা ম্যাচ জেতানো ইনিংস, ম্যাচ জেতানো স্পেল…সে জন্যই আমি টেস্ট ক্রিকেট পছন্দ করি।
অলরাউন্ডার হিসেবে ক্রিকেটের ঠাসা সূচির চ্যালেঞ্জটা কত বড়?
হোল্ডার: অনেক বছর ধরে তিন সংস্করণের ক্রিকেট খেলছি। আমার মনে হয়, তিন সংস্করণের ক্রিকেট খেলে যাওয়া অসম্ভব, বিশেষ করে যদি আপনি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটও খেলতে চান। সঙ্গে ঘরোয়া ক্রিকেট যোগ হলে তো আরও অসম্ভব। এখন যা হচ্ছে, তা অতিরিক্ত।
তাহলে সমাধান কী?
হোল্ডার: আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত ক্রিকেট ‘ইন্টারন্যাশনাল উইন্ডোর’ দিকে যাবে। এখন যে কাঠামো আছে, তাতে আপনি টিকতে পারবেন না।
অনেকটা ফুটবলের মতো?
হোল্ডার: হ্যাঁ, এ ছাড়া আর কোনো উপায় দেখি না। রাজস্ব ভাগাভাগির এখনকার পদ্ধতি না বদলালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য একটা উইন্ডো করতে হবে, ঘরোয়া ক্রিকেটের জন্য আরেকটা। তা না হলে আপনাকে ছোট দেশগুলোকে টিকিয়ে রাখতে অন্য উপায় খুঁজতে হবে। ম্যাচ ফি বাড়াতে হবে। সেটা হয়তো লিগ থেকে যে আয় হয়, তার সঙ্গে তুলনা করার মতো হবে না। তবে মোটামুটি হলেও হয়তো আপনি দু-একটি লিগ খেলার প্রস্তাব বাদ দেওয়ার চিন্তা করতে পারবেন।
আপনি কদিন আগে সরাসরিই বলেছিলেন, টেস্ট ক্রিকেট যে কাঠামোতে চলছে, এভাবে চললে এই সংস্করণের মৃত্যু ঘটবে...
হোল্ডার: আমি মনে করি, টেস্ট ক্রিকেটের ওপরে কিছু নেই। এটাই ক্রিকেটের সেরা সংস্করণ। আপনি দেখুন, সম্প্রতি যে টেস্ট ম্যাচগুলো হচ্ছে, খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, রোমাঞ্চকর। কিন্তু যখন অন্য সংস্করণের সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে ছোট টেস্ট খেলুড়ে দেশে…দেখেছেন তো দক্ষিণ আফ্রিকায় কী হলো। ওরা বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় সারির দল নিউজিল্যান্ডে পাঠিয়েছে। কারণ, তাদের নিজেদের টি-টোয়েন্টি লিগকে প্রাধান্য দিতে হচ্ছে। কেন? অর্থনৈতিক কাঠামো। তাদের নিজ দেশের ক্রিকেট অর্থনীতি সচল রাখার আর কোনো উপায় নেই। তাদের নিজেদের লিগে সেই দেশের সেরা খেলোয়াড়দের খেলাতেই হবে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো এই চ্যালেঞ্জের সঙ্গে দীর্ঘদিন লড়ছে…
হোল্ডার: হ্যাঁ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বাদ দিয়ে লিগে খেলছে। কারণ একটাই, অর্থনৈতিক কাঠামো। ধীরে ধীরে ক্রিকেটের অন্য সংস্কৃতিতেও এটা ঢুকে পড়বে। হয়তো বাংলাদেশেও হবে। শ্রীলঙ্কাতেও হয়তো দেখতে পাবেন। আপনি দেখবেন, খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে আগেভাগে অবসর নিয়ে নিচ্ছে, যেন সে লিগ খেলতে পারে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?
হোল্ডার: উপায় দু–একটা আছে। আইসিসির যে অর্থনৈতিক কাঠামো আছে, সেটা বদলাতে হবে। ছোট ছোট দেশকে আরও টাকা দিতে হবে। অথবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য আলাদা সময় বের করতে হবে। ধরুন, জানুয়ারি থেকে মে, পুরোটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। বছরের বাকি সময় ঘরোয়া ক্রিকেট। তাহলে খেলোয়াড়েরা নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করবে। চিন্তা করবে, আমি বছরের প্রথম চার-পাঁচ মাস আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলব। বাকিটা ঘরোয়া।
কিন্তু একেক দেশের ক্রিকেট মৌসুম তো বছরের একেক সময়ে…
হোল্ডার: সেটা তো আমার দায়িত্ব নয় (হাসি)। হ্যাঁ, আপনি যেটা বললেন, এখানে কোনো না কোনো দেশকে তাদের মৌসুমের কিছুটা সময় ছাড় দিতে হবে। আমার সঠিক উত্তর জানা নেই। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজস্ব ভাগাভাগির বর্তমান কাঠামো বদলানোর পক্ষে। আমি মনে করি, দ্বিপক্ষীয় সিরিজে সফরকারী দলের সেই সিরিজের আয়ের ভাগ পাওয়া উচিত। এটাই একমাত্র উপায়। যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজ শ্রীলঙ্কা সফর থেকে আয়ের ভাগ পায়, শ্রীলঙ্কা যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসে, তারাও ভাগ পাবে। এভাবে আপনি আয় বাড়াতে পারবেন। এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ যদি অস্ট্রেলিয়া যায়, তাহলে আমরা সিরিজের প্রথম ম্যাচের আগে থেকেই কত ক্ষতি হলো, তা গুনতে থাকি। অস্ট্রেলিয়া সফর ব্যয়বহুল। ম্যাচ ফি, লজিস্টিকস, বিমানভাড়া…সব আমাদের খরচ। আমরা কিন্তু সফর করে কিছুই পাচ্ছি না। আমাদের অপেক্ষা করতে হয় নিজেদের ঘরের মাঠের সিরিজের জন্য। আর ঘরের মাঠে আমরা যদি ভারত ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে না পারি, তাহলে বোর্ড কোনো টাকাই আয় করে না। কিন্তু খরচ তো থাকেই। যদি সফরকারী দল সিরিজের আয় ভাগাভাগি করে নেয়, তাহলে সেই কাঠামো টেকসই হবে।
খরচের চ্যালেঞ্জটা অন্যান্য দেশের তুলনায় ক্যারিবিয়ানে একটু বেশিই…
হোল্ডার: ঠিক ধরেছেন। মানুষ ক্যারিবিয়ান অর্থনীতিটা বোঝে না। অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে আমাদের ক্যারিবীয় ক্রিকেট। প্রতিটি দ্বীপের সরকার ভিন্ন। অর্থনীতি ভিন্ন। যেমন বার্বাডোজ অনেক ব্যয়বহুল। গায়ানা বা জ্যামাইকা একটু কম। বর্তমান কাঠামোতে এত কিছু সামলেও যে আমরা টিকে আছি, এটাই অনেক বড় ব্যাপার। দেখুন, বিগ থ্রির কাছেই যাচ্ছে ক্রিকেটের সব অর্থ। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে বেশি টাকা তারাই আনছে। তবে স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে বাকিদের বিরাট পার্থক্য থাকছেই।
বিগ থ্রি নিজেদের মধ্যে পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলছে। কিন্তু ছোট দলের বিপক্ষে খেলছে দুটি করে…
হোল্ডার: ইংল্যান্ড ও ভারত পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেললে টিভি থেকে কেমন আয় হয়, চিন্তা করে দেখুন। ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে টিভি থেকে কেমন আয় হবে? আমাদের জন্য বিরাট ব্যাপার। কিন্তু তাদের জন্য অবশ্যই খুব বেশি নয়। তাই ওরা আমাদের পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ দেয় না।
আপনার কি মনে হয়, বর্তমান কাঠামো বদলানোর কোনো সম্ভাবনা আছে?
হোল্ডার: না (হাসি)। দেখুন, পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন আপনি চাইবেন। যদি না চান…। দেখুন, আমি সমালোচক নই। আমি বাস্তববাদী। আর এ মুহূর্তে এটাই বাস্তবতা।
তবু আপনি এই আলোচনা করেই যাচ্ছেন…
হোল্ডার: দেখুন, আমি অনেকের সঙ্গেই এ নিয়ে অনেক ফলপ্রসূ আলোচনা করেছি। এই লড়াই নিজের জন্য লড়ছি না। আমার লড়াই ক্রিকেটের জন্য। এটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড বা ভারতের ব্যাপার নয়, এটা ক্রিকেটের ব্যাপার। কারণ, এটি ক্রিকেটের ক্ষতি করছে। এখন অনেক দ্বিপক্ষীয় সিরিজ হচ্ছে, যা অর্থহীন। তাহলে কেন আগের মতো ত্রিদেশীয়, চার জাতি সিরিজ হবে না। এটাও একটা উপায় হতে পারে। অনেকের জন্য এটি স্পর্শকাতর বিষয় বলে এ নিয়ে আলোচনা হয় না।
প্রায় সব দেশেই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হচ্ছে…এটাও তো আর্থিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িত।
হোল্ডার: সবাই লিগ আয়োজন করতে চাইবে। কারণ, লিগের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে। অনেক দেশই এই লিগনির্ভর আর্থিক কাঠামোর দিকে যাচ্ছে। কারণ, লিগ টিভির জন্য ভালো। সেখান থেকে আয় আসে। তাই প্রায় প্রতিটি দেশেই লিগ শুরু হচ্ছে, এতে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। কারণ, তাদের টিকে থাকতে হলে লিগের আয় লাগবেই। বাংলাদেশ তাদের বিপিএল আয়োজন করতে চাইবে। শ্রীলঙ্কাও একই। কেন নয়?
আপনার অভিনয় ক্যারিয়ারের কী হলো?
হোল্ডার: আপনি আমাকে অভিনয় করতে কই দেখলেন?
‘ফায়ার ইন ব্যাবিলন’! এরপর আর কোনো মুভি আসছে না…
হোল্ডার: ওহ্, ফায়ার ইন ব্যাবিলন! আমাকে আসলে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না (হাসি)। কে জানে, আমি কোনো সীমারেখার মধ্যে নিজেকে বন্দী রাখতে চাই না। আগামীকাল নতুন একটা দিন আসবে। যেকোনো কিছুই হতে পারে।