এবারের বিপিএল আপনি দেখছেন মাঠের বাইরে থেকে। সামগ্রিকভাবে টুর্নামেন্টের মান কেমন দেখছেন?
মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন: মানসম্মত বিদেশি খেলোয়াড় এবার অনেক কম। আগে যে মানের বোলার বা ব্যাটসম্যান আসত, এবার সে মানের খেলোয়াড় দেখিনি। দু-একটি দল ছাড়া অন্য কোনো দল মানসম্মত খেলোয়াড় আনেনি। তবে উইকেট ভালো, স্থানীয় ক্রিকেটাররা ভালো করছে। বিদেশিরা ভালো ভূমিকা রাখতে পারেনি বলেই হয়তো আমাদের ছেলেরা ভূমিকা রাখার সুযোগ বেশি পেয়েছে। এবারের বিপিএলের এটাই হয়তো বড় ইতিবাচক দিক যে ব্যাটিং-বোলিংয়ে স্থানীয়রা উঠে আসছে। একটা টুর্নামেন্ট যে রকমই হোক, যখন অনেক দল থাকে, সেখান থেকে ছেলেরা কোনো না কোনো আত্মবিশ্বাস নিয়ে বের হতে পারে।
অনেকে তো বলছেন মানসম্মত বিদেশি ক্রিকেটার না থাকায় বিপিএলের পারফরম্যান্স স্থানীয় ক্রিকেটারদের মিছে আত্মবিশ্বাস দিচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
সালাহউদ্দীন: দেখুন, আমি মনে করি, ‘ওভার কনফিডেন্স ইজ বেটার দ্যান লেস কনফিডেন্স অর নো কনফিডেন্স।’ এটা যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যদি আত্মবিশ্বাস না থাকে, কখনো সাফল্য পাবেন না। কিন্তু যদি ওভার কনফিডেন্ট হন, কনফিডেন্স ব্যাপারটা অন্তত আপনার মধ্যে থাকবে। কাজেই এটাকে খারাপভাবে নেওয়ার কিছু নেই। ড্রামা করেও যদি আপনাকে মানসিকভাবে উজ্জীবিত করতে হয়, আত্মবিশ্বাসটা কিন্তু আপনার মধ্যে আসবে। ‘ফেক কনফিডেন্স’ বলার কোনো যুক্তি নেই। আপনি রান করছেন, যেকোনো দলের বিপক্ষেই হোক, রান হচ্ছে রান। এটা গুরুত্বপূর্ণ।
স্থানীয় ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের কথা বললেন। কিন্তু আলাদা করে যদি জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের কথা বলি, তাঁদের পারফরম্যান্সে আপনি কতটা সন্তুষ্ট?
সালাহউদ্দীন: কোচ হিসেবে আমি চাইব জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা যেন পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে। একটি টুর্নামেন্টে আপনি প্রতিদিন রান করবেন, এটা হতে পারে না। তবে খেলার মধ্যে যেন একটা প্যাটার্ন থাকে, খেলাটা যেন গোছানো থাকে, অন্যদের সঙ্গে যেন আপনার খেলার একটা পার্থক্য থাকে। এর জন্যই তো আপনি শীর্ষ পর্যায়ে খেলছেন। জানি না সেটা এখনো ওইভাবে হচ্ছে না কেন, তবে আমরা চাই এটা যেন তাড়াতাড়ি তারা রপ্ত করতে পারে।
বিপিএলের সফলতম কোচ হিসেবে আপনি এবারের বিপিএলে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর ভূমিকা কীভাবে দেখেন?
সালাহউদ্দীন: অভিজ্ঞতা একটা ব্যাপার। আমি যে ফ্র্যাঞ্চাইজিতে কাজ করতাম, ছয়-সাত বছর ধরে সেখানে একই ধরনের ম্যানেজমেন্ট ছিল, সবাই একই রকম ভূমিকা রেখেছে, একই ধরনের কাজ করেছে। তাদের জন্য যেকোনো টুর্নামেন্টে দল চালানো কঠিন নয়। নতুনেরা অনেক কিছু উল্টাপাল্টা করে ফেলবে। কারণ, এখানে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কঠিন কাজ করতে হয়, বিদেশি ক্রিকেটার আনতে হয়, বাদ দিতে হয়। ভালো দল করতে হলে ভালো বিনিয়োগ করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন ভালো ফ্র্যাঞ্চাইজি আসে, সে চেষ্টা করতে হবে। বিপিএলকে আপনি ছুড়ে ফেলে দিতে পারবেন না। এটা আমাদের দেশের অন্যতম একটা বড় টুর্নামেন্ট। বিপিএলের বদনাম হলে আমাদের সবারই বদনাম। বোর্ড, খেলোয়াড়, ফ্র্যাঞ্চাইজি, দর্শক—সবার এখানে ভূমিকা আছে। বিপিএলে বিতর্ক না হলে তো আপনিও লিখতে পারতেন না (হাসি)।
সামনে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। কিন্তু বিপিএলে জাতীয় দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছেন না। মাত্র পাঁচটি ম্যাচ খেলেছেন, রানও তেমন করেননি। তিনি যে মাঠের বাইরে বসে থাকছেন, এতে কি তাঁর আত্মবিশ্বাসে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না?
সালাহউদ্দীন: কার কিসে আত্মবিশ্বাস আসবে, আত্মবিশ্বাস কমবে, সেটা আমরা বলতে পারব না। এখানে যদি ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়, তাহলেও তো তার আত্মবিশ্বাস কমে যাবে।
না খেলে মাঠের বাইরে বসে থেকে কি আত্মবিশ্বাস আসবে?
সালাহউদ্দীন: এটা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে হবে ওয়ানডে। সে যদি তার প্রস্তুতিটা ঠিকভাবে নিতে পারে, তাহলেই তো হলো। প্রস্তুতি কিন্তু সে নিচ্ছে ঠিকভাবে। শুধু বসে আছে, তা তো নয়, প্রতিদিনই অনুশীলন করছে। ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণে তাকে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা রাখতে হবে। আত্মবিশ্বাস যদি সে না খেলেও পায়, সমস্যা কী? এখানে রান না পেলে বা না খেললেও সে হয়তো অনুশীলন থেকে আত্মবিশ্বাস নিচ্ছে।
কিন্তু একজন অধিনায়ক যখন একাদশের বাইরে থাকেন, সেটা কি তাঁর মানসিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না?
সালাহউদ্দীন: আমি একটা উদাহরণ দিই। পারভেজ হোসেন আমাদের সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল। ওয়ানডে সিরিজে একটি ম্যাচও খেলেনি। প্রথম দুটি টি-টোয়েন্টিতেও বসেই ছিল। কিন্তু এত ম্যাচ পর তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে সুযোগ পেয়ে সে ভালো খেলল। মানসিক ব্যাপারটা আসলে আপনি কীভাবে ভাবছেন, তার ওপর নির্ভর করে। এটা কেউ আপনাকে ঠিক করে দিতে পারবে না। বিষয়টা নির্ভর করে পরিস্থিতি আপনি কীভাবে সামলাচ্ছেন, তার ওপর। আমি যদি চিন্তা করি আমার আত্মবিশ্বাস নেই, তাহলে নেই। আমি যদি মনে করি আমি এটা পারব, আমি পারব।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি সামনে রেখে বিপিএলের মধ্যেও কি জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের অনুশীলনে জাতীয় দলের কোচিং স্টাফের ভূমিকা থাকছে?
সালাহউদ্দীন: আমাদের দেখার বিষয় হলো, ছেলেরা যেন মানসিকভাবে ভালো থাকে, যখন তারা চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে আসবে, তখন যেন তারা ভালো অবস্থায় থাকে। সেটার জন্য যদি আমাদের তাদের সঙ্গে গোপনে কথা বলতে হয়, তাহলে আমরা গোপনে কথা বলব। যদি সামনাসামনি কথা বলতে হয়, তাহলে সামনাসামনি কথা বলব। যদি কখনো মনে হয় কোনো ছেলে সমস্যায় আছে, তাকে সাহায্য করার জন্য আমরা আছি।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভালো করার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী আপনি?
সালাহউদ্দীন: আমরা এখন যে অবস্থায় আছি, আমরা বা আমাদের ছেলেরা, আমরা কখনোই এটা বলব না যে আমরা শুধু ভালো খেলতে যাচ্ছি। এখন কিছু দেওয়ার সময়। আমরা না–ও পারতে পারি, কিছু যায়–আসে না। কিন্তু শিখতে যাচ্ছি—এ–জাতীয় মানসিকতা থেকে বের হতে হবে। ২৫ বছর ধরে একই কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। এখন কিছু দিতে হবে। সেটা করতে গিয়ে আমরা ভালো না-ই খেলতে পারি। আমি সে ব্যর্থতা স্বীকার করব। কারণ, ব্যাখ্যা করব। তবু আমাদের এখন সামনে তাকানো উচিত।
দলে সাকিব, তামিমের না থাকাটা কি একদিক দিয়ে ভালো হলো? বাড়তি আলোচনা কম থাকবে...
সালাহউদ্দীন: দেখুন, ইতিহাস না ঘেঁটে আমাদের আসলে সামনের দিকে তাকানো উচিত। দলে যারা আছে, প্রত্যেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সবার নিজস্ব ভূমিকা আছে। সেটা নিয়েই আমাদের ভাবা উচিত।
আরও দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ দলে আছেন। জাতীয় দলে তাঁদের ভবিষ্যৎ আর কত দূর দেখেন?
সালাহউদ্দীন: কারও চিন্তার সঙ্গে আসলে কারও চিন্তা মিলবে না। এই যুগে কেউ যদি মনে করে বয়সের কারণে কেউ একজন ফিটনেস ধরে রাখতে পারবে না, আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগে। আমি মনে করি, একজন ক্রিকেটার কত দিন খেলবে, সেটা পুরোপুরি পারফরম্যান্সভিত্তিক হওয়া উচিত। আপনি যদি ভালো পারফর্ম করেন, তাহলে বাংলাদেশের সেরা ১১ জনে আপনার খেলার অধিকার আছে।
তাহলে বলছেন চ্যাম্পিয়নস ট্রফিই তাঁদের শেষ নয়…
সালাহউদ্দীন: এটা ওই খেলোয়াড়দের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত...তারা কত দিন খেলবে। তারা যদি মনে করে আরও দুই বছর দাপিয়ে খেলতে পারবে, খেলবে। জোর করে কাউকে অবসরে পাঠানো যাবে না। আমার ব্যক্তিগত মত—সেরা ১১ জনই যেন বাংলাদেশ দলে খেলে। বোর্ড, প্রধান কোচ—তাদের ভিন্নমত থাকতেই পারে। খেলোয়াড়দেরও নিজস্ব ভাবনা থাকতে পারে। কিন্তু আমার কাছে বয়সটা কখনোই ব্যাপার নয়। একজন ১৮ বছরের ছেলে জাতীয় দলে খেললে তখন তো আমরা বলি না যে ওর তো অভিজ্ঞতা হয়নি! ও কেন খেলবে? আপনি যদি মানসিকভাবে ওই চাপ নিতে পারেন, ওই পারফরম্যান্স দিতে পারেন, তাহলে কেন খেলবেন না? অভিজ্ঞ, অনভিজ্ঞ বলে খেলোয়াড়দের মধ্যে পার্থক্য করা উচিত নয়। সব সময় পারফরম্যান্সই বিবেচ্য হওয়া উচিত। একটা প্রশ্নের উত্তর দিন—অভিজ্ঞ খেলোয়াড় কি জাতীয় দলে ম্যাচ ফি বেশি পায়? অনভিজ্ঞরা কি কম পায়? সবাই সবকিছু সমান পাচ্ছে। সবার পারফরম্যান্সও একই রকম করা উচিত।
নাজমূল আবেদীন বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে প্রধান কোচ ফিল সিমন্স ও আপনার একটা অনলাইন সভা হয়েছে। কী ধরনের আলোচনা হলো সেখানে?
সালাহউদ্দীন: খুব বেশি আলোচনা হয়নি। সামনে অনুশীলন কীভাবে করব, সুযোগ-সুবিধা কী থাকবে—এসব নিয়েই কথা হয়েছে।