খবরটা পুরোনোই। কিন্তু আইসিসির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট। গত পরশু এল সে ঘোষণা। অক্টোবর-নভেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় ওয়ানডে বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং প্যানেলে আছেন বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ। বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে বিশ্বকাপের ম্যাচ পরিচালনা করবেন সাবেক এই বাঁহাতি স্পিনার। এ নিয়েই মোহাম্মদ জুবাইরের সঙ্গে কথা বললেন শরফুদ্দৌলা। আম্পায়ারিংয়ের অন্যান্য দিকও উঠে এসেছে সাক্ষাৎকারে।
প্রশ্ন: তাজা খবরটা দিয়েই শুরু করি। বিশ্বকাপে আম্পায়ারিংয়ের সুযোগ, নিশ্চয়ই খুব খুশি...
শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ: খুশি তো অবশ্যই। আইসিসি মনে করেছে, আমি প্রস্তুত। আমিও মনে করি, আমি এখন সেরা জায়গায় আছি বিশ্বকাপের মতো বড় জায়গায় ম্যাচ পরিচালনার জন্য। আমি যথেষ্ট অভিজ্ঞ আম্পায়ার, যথেষ্ট আন্তর্জাতিক ম্যাচ করার অভিজ্ঞতা আছে। ভারতে বিশ্বকাপ হচ্ছে, সেটা নিয়ে অনেক আলোচনা হবে। এটা আইসিসির সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টের একটা। এর আগেও আমি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব করেছি, কিন্তু এখানে অনেক চোখ থাকবে। অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে। আশা করি, এত বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যেতে পারব।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের অন্য আম্পায়ারদের নিশ্চয়ই এটা অনুপ্রেরণা দেবে...
শরফুদ্দৌলা: আমি গর্ব করছি না, তবে স্বাভাবিকভাবেই যেহেতু আমি বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে যাচ্ছি, এটা দেখে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ অনুপ্রাণিত হবে। তবে সেটাই সবকিছু নয়। আমরা যদি যারা আম্পায়ার হয়ে আসবে, তাদের ভালো প্রক্রিয়ায় না রাখতে পারি, তাহলে ভালো আম্পায়ার এলেও টিকবে না। অন্য দেশে সেই সংস্কৃতি আছে, প্রক্রিয়া আছে। যার মধ্য দিয়ে ভালো আম্পায়ার বেরিয়ে আসে। আমাদের এখানেও সেটা খুব করে প্রয়োজন।
প্রশ্ন: কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন, টেস্টে আম্পায়ারিং, নাকি বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং?
শরফুদ্দৌলা: ভালো প্রশ্ন। যেকোনো আম্পায়ারের টেস্ট আম্পায়ারিং করার স্বপ্ন থাকে। ইন্টারন্যাশনাল আম্পায়ার হলে আপনি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচ পরিচালনা করতে পারবেন। কিন্তু টেস্ট ম্যাচ করে এলিট প্যানেলের আম্পায়াররা। বেশির ভাগ ক্রিকেটারের কাছে টেস্ট ক্রিকেট যেমন অনেক উঁচুতে, আম্পায়ারদের জন্যও নিশ্চয় তা–ই। অন্তত আমার কাছে টেস্টই আসল। অনেক বছর আম্পায়ারিং করার পর একটা পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, জীবনে কখনো টেস্ট ম্যাচ করতে পারব কি না। শেষ পর্যন্ত টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারিং করতে পেরেছি। আমার মনে হয়, সেই ধারাবাহিকতায়ই বিশ্বকাপে আম্পায়ারিংয়ের সুযোগ পেয়েছি।
প্রশ্ন: তার মানে বিশ্বকাপের চেয়ে টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারিংকেই এগিয়ে রাখবেন?
শরফুদ্দৌলা: আমি টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারিং করার জন্যই মনে মনে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি। বিশ্বকাপ নিয়ে ওইভাবে চিন্তা করিনি। আমার মনে হচ্ছিল, আমি একটা সময় বিশ্বকাপে যাব। এটা অনেকটা প্রত্যাশিত ছিল। খবরটা আনুষ্ঠানিকভাবে শোনার পর তাই খুব একটা অবাক হইনি। তবে এবারের বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু হচ্ছে, এতে স্বাভাবিকভাবেই আমি খুশি। আমি খুব সম্মানিতও। কারণ, বিষয়টা অবশ্যই সম্মানের।
প্রশ্ন: টেস্ট ম্যাচের চ্যালেঞ্জটাও তো বেশি, তাই না?
শরফুদ্দৌলা: নিঃসন্দেহে। ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে একটা ভুল করলেও খেলাটা কিন্তু শেষ হয়ে যায়। আপনি তা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে সেই সুযোগ কই! আপনি একটা ভুল করবেন, পরের দিন সেই ক্রিকেটার, সেই মাঠে আবার আসতে হবে। ৪০টা আউটের সিদ্ধান্ত আপনাকে দিতে হবে। আমি আমার প্রথম টেস্টের কথাই বলি, আমি সাদমান ইসলামকে ভুল আউট দিয়েছিলাম। পরে সেটা নিয়ে আমি ভাবতে ভাবতে পুরো টেস্টটাই খারাপ করেছি। পরে আমি বুঝেছি, এত দূর চিন্তা করা যাবে না।
প্রশ্ন: একই চ্যালেঞ্জ তো ক্রিকেটারদেরও সামলাতে হয়। দূরের লক্ষ্য নিয়ে না ভেবে ছোট ছোট লক্ষ্য নিয়ে ভাবার কথা বলতে শুনি ক্রিকেটারদের...
শরফুদ্দৌলা: ঠিক তা–ই। আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যেন সেশন ধরে ধরে এগোতে পারি। আরও ছোট করলে প্রথম ঘণ্টা। আরও ছোট করলে, ৫ ওভার। পারলে পরের বল। কথায় আছে না, পরের বলটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন আমি একটা ভুল করলাম, এখন যদি আমি সে আউট নিয়ে ভেবে মনোবল হারিয়ে ফেলি, তাহলে কিন্তু ম্যাচের পরের অংশটা আমি ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারব না। ক্রিকেটারদের যেমন ম্যাচের বিভিন্ন অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়, আমাদেরও তা–ই। নতুন বলে শাহীন আফ্রিদি হয়তো বল করছে, সুইং কেমন করছে, সে হিসাবটা আমাকেও রাখতে হয়। মোস্তাফিজের কাটার নিয়েও ভাবতে হয়। উইকেট ব্রেক করছে, স্পিন হচ্ছে, এসব ডিটেরিয়েশনও খেয়াল রাখতে হয়।
প্রশ্ন: করোনার পর থেকে স্বাগতিক দেশের আম্পায়াররা ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পেতে শুরু করে। এটা কি বাংলাদেশের আম্পায়ারদের ভাবমূর্তি বদলাতে ভূমিকা রেখেছে?
শরফুদ্দৌলা: নিশ্চয়ই। আমরা অনেক ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছি। সে ম্যাচগুলো পরিচালনা করতে পারায় আমাদের একটা মান দাঁড়িয়েছে। আমরা নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছি, যা আমাদের ও আমাদের আম্পায়ারিংকে অনেক সাহায্য করেছে।
প্রশ্ন: দেশের মাঠে আম্পায়ারিংয়ে কি আলাদা চাপ থাকে?
শরফুদ্দৌলা: বিশ্বাস করবেন কি না, জানি না, আমি দেশের মাঠে ম্যাচ করার সময় কিছু খেতে পারি না। আমি ৭-৮ বার কফি খাই, ১০-১২ বার বাথরুমে যাই।
বিশ্বাস করবেন কি না, জানি না, আমি দেশের মাঠে ম্যাচ করার সময় কিছু খেতে পারি না। আমি ৭-৮ বার কফি খাই, ১০-১২ বার বাথরুমে যাই।
প্রশ্ন: না খেয়ে সারা দিন আম্পায়ারিং?
শরফুদ্দৌলা: সকালে সামান্য খেতে পারি। সেটাও কষ্ট করে। অনেকের কোনো সমস্যা হয় না। আমার হয়। দেশের একটা প্রত্যাশার চাপ থাকে। এখানে আম্পায়ার্স কলও দর্শক মানতে চায় না। বিদেশের মাটিতে এ চাপটা নেই। আমি তখন একদম ফুরফুরে থাকি।
প্রশ্ন: আম্পায়ারিং নিয়ে আমাদের ক্রিকেট–সংস্কৃতিতে কিছু ভুল ধারণা আছে। সেগুলো নিয়ে কিছু বলুন।
শরফুদ্দৌলা: আমাদের দেশে আম্পায়াররা সঠিক সিদ্ধান্ত না দিতে পারলে সেটাকে মিসটেক বলা হয়। খুব দ্রুত ট্রল শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আম্পায়ারিংয়ের ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘এরর অব জাজমেন্ট’। আমাদের যখন রিভিউ হয়, তখন আমরা নিজেদের ভুলের কথাগুলো বলতে গেলে তারা উল্টো উৎসাহ দেয়। সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় আমরা সেখান থেকে কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, সেটাকে। কুমার ধর্মসেনা বাংলাদেশে এক সিরিজে ১৬টা ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কিন্তু পরের বছর তিনি বর্ষসেরা আম্পায়ার হয়েছেন কীভাবে? তাঁর বাউন্সব্যাক করার অ্যাবিলিটির কারণে। এটা বুঝতে হবে।
প্রশ্ন: শুনেছি, সঠিক সিদ্ধান্তের চেয়েও কে কেমন মাঠ নিয়ন্ত্রণ করে, তা দিয়েও আম্পায়ারদের সামর্থ্য বিচার করা হয়।
শরফুদ্দৌলা: বিশেষ করে ডিআরএসের এই যুগে এটা অনেক বড় প্যারামিটার। আম্পায়ারিং এখন অনেকটাই ম্যান ম্যানেজমেন্টের মতো। কে মাঠটা কত ভালো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
সাক্ষাৎকারে শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ