অভিনন্দন। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ ১৪ বছর পর সেমিফাইনালে খেলেছে। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে আপনার
মূল্যায়ন কী?
হাভিয়ের কাবরেরা: সেমিফাইনালে উঠে প্রথম লক্ষ্যটা পূরণ করেছি আমরা। টুর্নামেন্টটা সফলই হয়েছে আমাদের জন্য। আমরা ঢাকায় ভালো প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কম্বোডিয়ার প্রস্তুতিটাও বেশ সহায়তা করেছে। সাফে আমরা পিছিয়ে পড়েও মালদ্বীপ ও ভুটানকে হারিয়েছি। এ ছাড়া দুটি মধ্যপ্রাচ্যের দল লেবানন ও কুয়েতকে হারানোর খুব কাছে চলে গিয়েছিলাম। সামগ্রিকভাবে দলের পারফরম্যান্স অনেক ইতিবাচক। আর এটাই এ বছরের বাকি ম্যাচগুলোর জন্য আমাদের উদ্দীপ্ত করবে।
বেঙ্গালুরু যাওয়ার আগে সেমিফাইনাল খেলার ব্যাপারে জোর দিয়ে কিছু বলেননি আপনি। সেমিফাইনাল খেলা সম্ভব, এটা বিশ্বাস করতেন?
কাবরেরা: বিশ্বাস করতাম। মালদ্বীপ আর ভুটানকে অবশ্যই হারাতে পারব বলে বিশ্বাস ছিল। শক্তিশালী লেবাননের সঙ্গে লড়তে পারব, সেই বিশ্বাসও ছিল। সেটা আমরা করেও দেখিয়েছি।
সেমিফাইনালে ৫১ ধাপ এগিয়ে থাকা কুয়েতের কাছে হারের পর আপনি ফুটবলারদের জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছেন। এটাই কি এবারের সাফে বাংলাদেশের সবচেয়ে হতাশার মুহূর্ত?
কাবরেরা: অবশ্যই। খুবই কষ্ট পেয়েছি ম্যাচটা হেরে। তবে জানতাম, অতিরিক্ত সময়ে গেলে আমাদের কিছুটা ধুঁকতে হবে। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কুয়েত আমাদের চেয়ে ২৪ ঘণ্টা বেশি সময় পেয়েছে বিশ্রামের। আমাদের একটা ভুলে ওরা গোল করে জিতে গেছে। তবে ৯০ মিনিটের মধ্যেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে আমরা জয়ের আনন্দও করতে পারতাম।
সাফে গিয়ে আপনার কী মনে হলো, বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে?
কাবরেরা: আমরা সাফের শীর্ষ স্তরেই আছি। যদিও ভারতের র্যাঙ্কিং ১০০, আমাদের ১৯২। তবে ওটা খাতা–কলমে। র্যাঙ্কিংয়ের চেয়ে আমরা ভালো দল। আমাদের র্যাঙ্কিং হওয়া উচিত অন্তত ১৬০-৭০–এর মধ্যে। এখন আমাদের র্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি আনতে হবে। দল একটা অবস্থানে এসেছে। কম্বোডিয়ায় অনুশীলন ম্যাচসহ সর্বশেষ ৬ ম্যাচের ৪টি জিতেছি। আমরা সঠিক পথেই আছি। তবে আরও উন্নতি করতে হবে।
বাংলাদেশ দলের খেলায় ট্যাকটিক্যাল পরিবর্তন এসেছে। এটা কেন করলেন?
কাবরেরা: করেছি আমাদের সামর্থ্য আর প্রতিপক্ষ বিবেচনায়। সাফে আমরা মাঝমাঠে ডায়মন্ড শেপে খেলেছি (চার মিডফিল্ডারই মাঝখানে থাকেন)। উইং দিয়ে উঠেছে কখনো সাইডব্যাকরা, কখনো ফরোয়ার্ড রাকিব ও মোরছালিন। এটা আমাদের সাহায্য করেছে। মাঝমাঠে আমাদের পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে প্রতিপক্ষ দলগুলো মাঝমাঠ দিয়ে খুব বেশি আক্রমণ করতে পারেনি। বরং মাঝমাঠ থেকে স্ট্রাইকিং পর্যন্ত আমরা দ্রুত গেছি। আক্রমণাত্মক রানিং ছিল আমাদের।
নির্ভরযোগ্য একজন ‘নাম্বার নাইন’ নেই বাংলাদেশ দলে। তারপরও সাফে মালদ্বীপ ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েও ৩টি করে গোল করেছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
কাবরেরা: নাম্বার নাইন সুমন রেজা ভালোই করেছে লেবানন ম্যাচে। সে চাপে রেখেছে লেবাননের সেন্টারব্যাককে। যদিও সে গোল করতে পারেনি। গ্রুপের বাকি দুই ম্যাচে আমি ভেবেছি, ফরোয়ার্ডে দুজন দ্রুতগতির ফুটবলার দেব। এটা হতে পারে ফাহিম, রাকিব, মোরছালিন। এই খেলোয়াড়েরা মাঝমাঠের সামনে ফাঁকা জায়গাটা রানিং দিয়ে কাভার করে প্রতিপক্ষ রক্ষণকে চাপে ফেলতে পারে। সেটা তারা করেছেও। ফলে আমরা গোল পেয়েছি।
কিন্তু এটা তো সাময়িক সমাধান। দলে নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকারের অভাব কতটা অনুভব করছেন?
কাবরেরা: শুধু স্ট্রাইকার নয়, সব বিভাগেই উন্নতির সুযোগ আছে। তবে আমি এখনো বিশ্বাস করি, আমরা গোল করতে পারি এবং আরও অক্রমণাত্মক হতে পারি।
পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাই। সেপ্টেম্বরে ফিফা উইন্ডো আছে, অক্টোবরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব। এরই ফাঁকে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের এশিয়ান গেমস। এসবে ভালো করাই এখন লক্ষ্য।
জামাল ভূঁইয়াকে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার থেকে আক্রমণে নিয়ে গেছেন আপনি। অনভ্যস্ত জায়গায় খেলে জামালকে অসন্তুষ্ট মনে হলো। কী বলবেন?
কাবরেরা: জামাল পেশাদার ফুটবলার। ভালো অধিনায়ক, খেলাটা বোঝে, পরিপক্বতা আছে। আমি ওকে বিভিন্ন পজিশনে খেলিয়েছি। নাম্বার টেন পজিশনেও পরখ করেছি। ওকে আসলে মুক্ত হয়ে খেলার স্বাধীনতা দিয়েছি। সে সেরাটা দিয়েছে। আক্রমণের পাশাপাশি রক্ষণেও সহায়তা করেছে। ওর ওপর আমি খুশি। আমি নিশ্চিত, দলের প্রয়োজনে ভবিষ্যতেও সে সেরাটা দেবে।
দলে একঝাঁক তরুণ খেলোয়াড় নিয়েছেন। তাঁদের পারফরম্যান্সে কতটা খুশি?
কাবরেরা: অনেক খুশি। ফাহিম, মোরছালিন, আবাহনীর সোহেল রানা, কিংসের সোহেল রানা—মাঝমাঠে আমাদের একঝাঁক ভালো খেলোয়াড় আছে। ওরা সবাই নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে প্রতিপক্ষ রক্ষণে খালি জায়গা তৈরি করেছে। হৃদয় দারুণ করেছে, মোরছালিন তো ছিলই, জনি, রবিউলরাও ভালো খেলেছে। আমরা ভাগ্যবান যে কিছুটা প্রতিভাবান খেলোয়াড় ছিল আমার হাতে।
এবারের সাফে বাংলাদেশের সেরা আবিষ্কার শেখ মোরছালিন। কিন্তু সাফের জন্য আপনার প্রথম ৩৫ জনে তিনি ছিলেন না। পরে কী দেখে নিলেন? কবে তাঁকে প্রথম দেখলেন?
কাবরেরা: বসুন্ধরা কিংসের অনুশীলনেই প্রথম দেখি ওকে। তারপর মোহামেডানের হয়ে কিংসের বিপক্ষে তার গোল দেখেছি। এ বছর শেখ রাসেলের বিপক্ষে কিংসের দ্বিতীয় পর্বের ম্যাচে সে একাদশে ছিল এবং ১টি গোল করেছে। সেই গোল দেখেই তাকে ভালো লেগেছে। সে দারুণ প্রতিভা। দলে তার অন্তর্ভুক্তি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সে সব সময়ই শিখতে চায়, কঠিন পরিশ্রম করে। তবে তাকে আরও অনেক উন্নতি করতে হবে।
বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ফুটবলে অনেক দিন পর মোরছালিনের মতো প্রতিভা এল। আপনি একমত?
কাবরেরা: সে আক্রমণাত্মক, তাই নজরে পড়েছে বেশি। ওর খেলায় একটা শিহরণ আছে। আমাদের উচিত এখন তাকে সমর্থন দেওয়া। তবে শুধু মোরছালিন নয়, আমাদের হাতে জনি, হৃদয়ের মতো তরুণেরাও আছে।
আপনি ফুটবলারদের সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখেন। সারাক্ষণ মিটিং করেন। কেউ কেউ মজা করে বলেন, আপনি নাকি কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের মতো শেখান। শিক্ষক হিসেবে হাভিয়ের কাবরেরা কঠোর নাকি কোমল?
কাবরেরা: (হাসি) ঠিক কঠোর নই। ফুটবলাররা ভালো–মন্দ বলতে পারে আমাকে। আমি আসলে বিশ্বাস করি কঠিন পরিশ্রমে। নিজের সেরাটা দিই আমি।
আপনার অধীন বাংলাদেশ ১৫টি ম্যাচ খেলে জিতেছে ৫টিতে। ৪টি জয়ই এ বছর। ড্র ২টি, হার ৮টি। সামনে লক্ষ্য কী?
কাবরেরা: পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে চাই। সেপ্টেম্বরে ফিফা উইন্ডো আছে, অক্টোবরে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব। এরই ফাঁকে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের এশিয়ান গেমস। এসবে ভালো করাই এখন লক্ষ্য।
বাংলাদেশে দেড় বছর হলো আছেন। মাঠের বাইরের জীবনটা কেমন কাটছে?
কাবরেরা: খুবই ভালো। দল ভালো করায় ঢাকায় নেমে খুব খুশি লাগছে। নিজের বাড়ির মতোই লাগে এখানে। স্ত্রী ঢাকাতেই থাকে আমার সঙ্গে, এখন দেশে। ঢাকার খাবার ভালো লাগে। বাইরে গেলে লোকে ছবি তোলে, এটাও ভালো লাগে। খেলা না থাকলে স্প্যানিশ বা ইউরোপিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাই।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই দায়িত্ব নেন বাংলাদেশের মতো দলের। চাপ ছিল কি?
কাবরেরা: তা ছিলই। তবে চাপটাকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছি। যখন ঢাকায় প্রথম আসি, তার চেয়ে এখন আমি আরও ভালো কোচ, আরও পেশাদার। এসে যে দলটা পেয়েছি, তার চেয়ে এই দলটা ভালো।
কোচ হিসেবে কাকে ভালো লাগে?
কাবরেরা: অনেকেই আছেন। লুইস এনরিকে, পেপ গার্দিওলার নাম বলতে পারি।
আপনি নাকি ফুটসালও খেলতেন?
কাবরেরা: আমি স্পেনে আধা পেশাদার ফুটসাল খেলোয়াড় ছিলাম। তবে আমি মূলত ফুটবলার। মাদ্রিদের রাস্তায় ফুটবল নিয়েই কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর। স্বপ্ন দেখেছি ফুটবলার হব। স্পেন জাতীয় দলের বড় ভক্ত ছিলাম, সেটা ক্লাবের চেয়েও বেশি। তখন পেপ গার্দিওলা খেলতেন। বলতে পারেন, আমার জীবন পুরোপুরিই ফুটবলনির্ভর।