পুরস্কার নিয়ে মঞ্চে নিজের ভালো লাগার কথা বলেছেন। পাঁচ দিন তো হয়ে গেল, আনন্দের রেশ কি এখনো আছে? নাকি আবার সেই খেলা, অনুশীলনই শুধু মনের মধ্যে?
সাবিনা খাতুন: না না, পুরস্কারের রেশ এখনো আছে, তা অন্য কিছু যতই মাথায় থাক। আর পুরস্কার পেতে সব সময়ই ভালো লাগে। বড় মঞ্চে পুরস্কার যখন দেয়, অন্য রকম একটা আনন্দ কাজ করে। সতীর্থরা সামনে থাকলে সেটা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। আপনাদের পুরস্কার অনুষ্ঠানে আমার সতীর্থরা সবাই ছিল।
শুধু সতীর্থরা নন, আপনার সামনে ছিলেন আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন, বাফুফের নারী উইংয়ের প্রধান মাহফুজা আক্তার, সাবেক তারকা ফুটবলারসহ ফুটবল পরিবারের নামীদামি অনেকেই। এটা কেমন লেগেছে?
সাবিনা: দারুণ। প্রেসিডেন্ট স্যার, কিরণ আপা...সবাই ছিলেন। ফুটবল ফেডারেশন এখন একটা ফ্যামিলির মতো। সবাইকে নিয়েই পুরস্কারটা নিতে পেরেছি, এটাও বড় পাওয়া।
মনের মধ্যে কি আশা জাগছিল যে বর্ষসেরার পুরস্কারটা আপনি পেতে পারেন?
সাবিনা: কিছুটা আশা ছিল (হাসি)। কারণ, ২০২২ সালে আমরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতি। মেয়েদের ফুটবলে সিনিয়র পর্যায়ে এটাই বড় সাফল্য। আমি নিজে পারফর্ম করেছি। পাঁচ ম্যাচের তিনটিতে ম্যাচসেরা হয়েছি। ৮ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছি। তাই আশাবাদী ছিলাম। তবে সত্যি কথা বলতে, ভেবেছিলাম সেরা নারী ক্রীড়াবিদ হব হয়তো (হাসি)। বর্ষসেরা হওয়াটা ভাবনার একটু বাইরে ছিল। যখন বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ ঘোষণা হচ্ছিল, তখন আমাদের মেয়েরা বলছিল, ‘আপা, আপনি পাবেন।’ আমি ওদের বলি, না–ও তো হতে পারে। তোরা চুপচাপ বসে থাক।
বর্ষসেরা নারীর পুরস্কার যখন হয়ে গেল, আর্চার নাসরিন তা পেলেন, তখন কি আরও আশাবাদী হয়ে ওঠেন?
সাবিনা: একটু তো হয়ে উঠিই। বর্ষসেরা নারী পুরস্কারের আগে আমি ভাবছিলাম, বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদের পুরস্কার যদি আমাকে না দেয়, তাহলে এর থেকে ভালো কিছু দেবে হয়তো। কিরণ আপাও বলেছিলেন, ‘তোমার একটা সম্ভাবনা আছে।’ কারণ, এটা তো ২০২২ সালের পুরস্কার। ওই বছর বিএসপিএর (বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি) পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার পাই। তবে প্রথম আলোর প্রোগ্রাম সব সময়ই ভিন্ন হয়। অনেক সেলিব্রিটি থাকে। এখানে পুরস্কার পাওয়ার আনন্দই আলাদা।
প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কারে এর আগে বর্ষসেরা নারীর পুরস্কার পেয়েছেন। এবার বর্ষসেরা। ছেলে, মেয়ে মিলিয়ে আপনিই একমাত্র ফুটবলার, যিনি বর্ষসেরা হলেন। এই অনুভূতি কেমন?
সাবিনা: অবশ্যই অন্য রকম। ক্রিকেটারদের ছাপিয়ে বর্ষসেরা হওয়াটা দারুণ ব্যাপার। এর আগে ২০১৭ সালে প্রথম আলোর বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ হয়েছি। সেই স্বীকৃতি আমাকে সামনে এগিয়ে দিয়েছে।
ক্যারিয়ারে এ নিয়ে কতগুলো পুরস্কার হলো?
সাবিনা: নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। প্রথম আলোর দুটি, বিএসপিএর তিনটি। রাঁধুনী কীর্তিমতী সম্মাননা পেয়েছি। সব মিলিয়ে ১০-১২টি হবে।
সবচেয়ে বড় কোনটি?
সাবিনা: সবচেয়ে...বড়। সবচেয়ে...বড়। মানে অ্যাওয়ার্ডের দিক দিয়ে?
হ্যাঁ, অ্যাওয়ার্ডের গুরুত্বের দিক থেকে।
সাবিনা: অ্যাওয়ার্ডের দিক দিয়ে অবশ্যই প্রথম আলোরটা প্রথমে থাকবে। এটাই আমার সেরা পুরস্কার।
পুরস্কার পাওয়ার পর সতীর্থরা কী বললেন? আপনার কাছে খেতে চাননি?
সাবিনা: চাইবে না আবার! কোনো অ্যাওয়ার্ড পেলেই...বিশেষ করে মাসুরা বলে, কী খাওয়াবেন আপা? ঠিক করেছি, আমি ওদের চিকেন আর গ্রিল খাওয়াব। সঙ্গে জুনিয়ররাও আছে। ওদের খাওয়াই মাঝেমধ্যে।
পুরস্কার পেলে সবচেয়ে বেশি আনন্দ কে করেন?
সাবিনা: মারিয়া, মনিকা। আমার রুমমেট শামসুন্নাহারও করে।
আপনার বোনেরাও নিশ্চয়ই অনেক খুশি...
সাবিনা: সবাই খুব খুশি। তাঁরা সাফল্যটা উপভোগ করেন। বিশেষ করে বড় বোন সালমা খাতুনের কথা বলব, আমার এত দূর আসার পেছনে ওনার অবদান বেশি। আমার ক্রেস্টগুলো খুব পছন্দ করেন তিনি। সব কটিই বাড়িতে আছে। এই ক্রেস্টও সাতক্ষীরার বাড়িতে পাঠিয়ে দেব। আগে আমার কিছু লাগলে বড় বোনের কাছ থেকে নিতে হতো। বাবার ওই রকম সামর্থ্য ছিল না। বড় বোনেরও যে অনেক সামর্থ্য, তা নয়। তবে সব সময় চেষ্টা করেছেন। বাবার পাশাপাশি বড় আপু পরিবারকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন।
বাবার কথাও নিশ্চয়ই মনে পড়ছে...
সাবিনা: সব সময়ই মনে হয়। বেঁচে থাকলে ওনার খুব ভালো লাগত। উনি ফুটবল খুব পছন্দ করতেন। ২০২০ সালে মারা যান। লিভারে সমস্যা ছিল, ৬৫-এর ওপরে বয়স হয়েছিল।
আর মা?
সাবিনা: মা তো আছেনই। তাঁর দোয়া ছাড়া আমি এত দূর আসতে পারতাম না।
অনেক পুরস্কার তো পেলেন। এমন কিছু আছে, ভবিষ্যতে যেটি পেতে চান?
সাবিনা: স্বপ্ন ছিল ইউরোপের কোনো লিগে খেলা। সেটা পূরণ হয়নি। আমাদের আসলে এজেন্ট নেই। অনেক যোগাযোগ থাকতে হয়। পাশাপাশি এশিয়ায় ভালো অবস্থানে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। যদিও সেভাবে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয় না আমাদের।
এই পুরস্কার কাকে উৎসর্গ করেছেন?
সাবিনা: এর পেছনে যেসব মানুষের অবদান আছে, তাঁদের সবাইকে। যেমন বাফুফে, কোচিং স্টাফ, সতীর্থ খেলোয়াড়—সবাইকে।
পুরস্কারের দুই লাখ টাকা কী করবেন, ভেবেছেন কিছু?
সাবিনা: পরিবারের কাজেই ব্যয় হবে। আমার পরিবার অনেকটা আমার ওপর নির্ভরশীল। আমার বোনেরাও সাপোর্ট করেন। আমার টাকায় সবার ভাগ থাকে। সব সময় পরিবারের জন্যই খরচ হয়। এখানে যে (বাফুফে ভবনে) মেয়েরা আছে, প্রায় সবাই পরিবারকে সাপোর্ট করে। যেমন মারিয়া, মনিকা, মানসুরা। আমার নিজের খরচ বলতে বুট কেনা (হাসি)।
আর কত দিন খেলার ইচ্ছা আছে?
সাবিনা: আল্লাহ পাকের ইচ্ছা। যত দিন ফিটনেস ধরে রাখতে পারব। খেলা ছেড়ে কোচিংয়ে আসতে চাই। ‘এ’ ডিপ্লোমা কোচিং কোর্সও করেছি।
এ বছরই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। ট্রফি ধরে রাখা কতটা চ্যালেঞ্জিং হবে?
সাবিনা: ট্রফি নিজেদের কাছে রাখাটা অনেক বড় দায়িত্ব এখন। চেষ্টা করব, শতভাগ দেব মাঠে।
ব্যক্তি সাবিনা সম্পর্কে তাঁর নিজের মূল্যায়ন কী?
সাবিনা: অমি আমার পেশার প্রতি সব সময় অনুগত ছিলাম। কখনো ফুটবলের প্রতি অনীহা দেখাইনি। ক্যাম্পে বা বাসায়—যেখানেই থাকি, চেষ্টা করেছি মাঠের সঙ্গে থাকতে। এ কারণেই এখনো চালিয়ে নিতে পারছি বা আরও পারব। পেশার প্রতি আপনাকে সৎ হতে হবে, সে যে পেশাই হোক। আর আমি খুবই সাধারণ ও বাস্তববাদী একজন মানুষ। কোনো কিছুতে ভেঙে পড়া, বেশি চিন্তা—এগুলো কম করি। কোনো কিছু নিয়ে আফসোস করি না। আপনাদের কাছে মাঝেমধ্যে মনে হতে পারে, সাবিনা কাউকে পাত্তা দেয় না। আসলে মাঝেমধ্যে আমরা অসহায় হয়ে যাই। সবার কাছ থেকে অনুরোধ আসে কথা বলতে, সাক্ষাৎকার দিতে। চেষ্টা করি সবার চাওয়া মেটাতে। দিন শেষে আপনারা যখন আমাদের জন্য কাজ করেন, আমাদেরও দায়িত্ব আপনাদের সাপোর্ট করা।
ফুটবলার না হলে কী হতেন?
সাবিনা: বড় বোনের ইচ্ছা ছিল আমাকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু ডাক্তার হওয়ার ধারেকাছেও যেতে পারিনি। পড়াশোনায় আমার অনেক গ্যাপ পড়ে যায় খেলার জন্য। ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষার সময় আমি চলে গেছি আমেরিকাতে একটা ফুটবল ফেস্টিভ্যালে। বড় আপা তখন বলেছিলেন, তুই পরীক্ষা বাদ দিয়ে যাচ্ছিস! আমি বলেছিলাম, পরীক্ষা হবে, আগে ঘুরে আসি। আমি ফুটবলকে সব সময় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছি। আমি সুখী যে একজন ফুটবলার হয়েছি। দেশের হয়ে খেলছি। দেশের পতাকা তুলে ধরছি, এর চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না।
বাফুফে ভবনে ১০-১১ বছর ধরে থাকেন। এই জীবনটা কেমন?
সাবিনা: এটা ইন্টারেস্টিং। ১৪ থেকে ২৩-২৪ বছরের মেয়েরা আছে। মাঝেমধ্যে একঘেয়ে লাগে। তারপরও মনে হয়, এটাই আমার বাসা। বড় বোন মনে করে মেয়েরা। সমস্যা হলে কথা বলে। বিশেষ করে মারিয়া। তবে সবার সঙ্গেই আমার আন্তরিক সম্পর্ক। জেলার হয়ে ফুটবল খেলতে প্রথম ঢাকায় আসি ২০০৮ সালে। তারপর তো আস্তে আস্তে বাফুফে ভবনই হয়ে যায় ঠিকানা।
অবসরে কী করেন?
সাবিনা: মাঝেমধ্যে বই পড়া হয়। তবে খুব কম। মুভি দেখা হয় বেশি। তামিল মুভি পছন্দ। বলিউডের মুভিও দেখা হয়।
কাউকে আদর্শ মানেন?
সাবিনা: বড় বোনকে। অনেক সংগ্রাম করতে দেখেছি ওনাকে। সব সময় তাঁকে দেখে প্রেরণা পেয়েছি। বলা যেতে পারে, তিনি আমার কাছে রোল মডেল। উনি সাতক্ষীরা শহরে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের নার্স।
অবসরে ফুটবল ছাড়া অন্য কোনো খেলা খেলেন?
সাবিনা: ব্যাডমিন্টন খেলি বাড়ি গেলে। দু-তিনটা ছোট ভাই আছে, ওরা নিয়ে যায়। ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ ভাইয়ের খেলা ভালো লাগে। গত বিশ্বকাপে তাঁর খেলা দেখেছি।
বিশেষ কোনো স্বপ্ন দেখেন?
সাবিনা: স্বপ্ন দেখার শেষ নেই। স্বপ্ন হচ্ছে সারা জীবন যেন পরিবারকে সমর্থন দিতে পারি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যেন থাকতে পারি। ভালো মানুষ হয়ে যেন বেঁচে থাকতে পারি।
আপনার শখ কী?
সাবিনা: গিটার বাজানোর শখ ছিল কিন্তু সেটা হয়নি। বাজাতে পারলে ভালো লাগত।
দৈনিক রুটিনটা কেমন?
সাবিনা: ভোরে উঠি। অনুশীলন করি। ছক মেনেই কাটে দিন। মাঝখানে নামাজ-কালাম পড়ি।
খেলাধুলার কী অবস্থা?
সাবিনা: লিগ শুরু হচ্ছে ২৭ এপ্রিল। প্রথম দিনে আতাউর রহমান ভূঁইয়া কলেজের সঙ্গে নতুন আসা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ম্যাচ। আমরা জাতীয় দলের বেশ কিছু খেলোয়াড় এবার নাসরিন স্পোর্টিংয়ের জার্সিতে খেলব।