সাক্ষাৎকারে সাবিনা খাতুন

‘টিকটক করাটা কী ক্ষতির, আমার মাথায় আসে না’ 

ভারতের বিপক্ষে ৩-১ গোলের স্বস্তির জয়ে গ্রুপসেরা হয়েই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে উঠেছে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। এই জয়ে দলের ভেতর বইছে সুবাতাস। যার কল্যাণে দল ফাইনালেও পৌঁছে যাবে—বিশ্বাস অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের। সিনিয়রদের কোচ পছন্দ করেন না—মিডফিল্ডার মনিকা চাকমার অভিযোগের পর দল কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল? প্রথম আলোর সঙ্গে সেসব নিয়েই কথা বলেছেন সাবিনা

প্রথম আলো:

চাপের মধ্যে ভারতের বিপক্ষে দারুণ জয়ে নিশ্চয়ই প্রাণ ফিরেছে দলে? 

সাবিনা খাতুন: এটার জন্য (মনিকার অভিযোগের পর) অনেক ফাইট করতে হয়েছে। তখন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কোচও খুশি হননি। বাইরে ছড়িয়ে গেছে যে দলে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব। এমন কমেন্ট করে মেয়েদের মেন্টালি ডাউন করা ঠিক নয়। এটা দুঃখজনক। খেলোয়াড়দের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। সত্যি বলতে, মনিকার মন্তব্যের পর সবকিছু কঠিন ছিল। এটিকে (ভারত ম্যাচ) আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম।  

প্রশ্ন:

দলে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব কি সত্যিই নেই? 

সাবিনা: নেই। জুনিয়রদের সঙ্গে সিনিয়ররা যেভাবে মেশে, বিতর্ক ওঠাই অনুচিত। কেন সিন্ডিকেটের কথা আসছে? ভেতরে কী হচ্ছে, শুধু প্লেয়াররাই জানে। আমরা কেমন ভুক্তভোগী, আমরাই জানি। এখন কেউ এসব নিয়ে কমেন্ট করতে পারে না। এখানে পজিটিভের চেয়ে নেগেটিভটা দ্রুত ছড়ায়। আপনারা যে এই বিভাজনটা তৈরি করে দিয়েছেন, যেভাবে বিতর্ক ছড়াচ্ছে, সত্যিই তা হতাশাজনক, দুঃখজনকও। 

ভারতকে হারানোর উচ্ছ্বাস বাংলাদেশের মেয়েদের
বাফুফে
প্রশ্ন:

এতে খেলোয়াড়দের কি কোনো দায় নেই?

সাবিনা: না, নেই। আমার রুমে যেসব জুনিয়র থাকে, আমি তাদের সঙ্গে যেভাবে মিশি, সবচেয়ে সিনিয়র হিসেবে সেভাবে হয়তো মেশা উচিত নয়। আমি ওই পার্থক্যটা বুঝতে দিই না ওদের। সাগরিকা, কৃষ্ণা সবার সঙ্গে দুষ্টুমি-ফাজলামি করি। এখন ওরা ভাবে যে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের কথাটা হয়তো ওরা বলেছে। আসলে তা নয়। এটা আপনারা তৈরি করে দিয়েছেন (কিছু মিডিয়া)। জুনিয়রদের সিনিয়ররা যথেষ্ট ভালোবাসে। এমনও হয় সিনিয়ররা বাসায় গেলে জুনিয়রদের জন্য খাবার রান্না করে আনে। 

জুনিয়রদের সঙ্গে সিনিয়ররা যেভাবে মেশে, বিতর্ক ওঠাই অনুচিত। কেন সিন্ডিকেটের কথা আসছে? ভেতরে কী হচ্ছে, শুধু প্লেয়াররাই জানে। আমরা কেমন ভুক্তভোগী, আমরাই জানি। এখন কেউ এসব নিয়ে কমেন্ট করতে পারে না।
প্রশ্ন:

মনিকা বলেছেন, বর্তমান কোচ সিনিয়রদের পছন্দই করেন না। আসলেই কি তাই?

সাবিনা: দেখুন, পাকিস্তানে খেলোয়াড়েরা আমাকে বলল, ‘আমরা খেলার আগে যখন টিম লিস্ট পেয়েছি, খুব অবাক হয়েছি। মারিয়া, কৃষ্ণা, সানজিদা, মাসুরা নাই। তখনই মনে হয়েছে গেম অনেকখানি আমাদের পক্ষে।’ আমাদের মূল কয়েকজন খেলোয়াড় না থাকায় ওরা অ্যাডভান্টেজ পেয়েছে। আপনি যদি ভারতের সঙ্গে অনভিজ্ঞ মুনকিকে নামিয়ে দেন, চাপটা কী ও নিতে পারবে? 

বাংলাদেশ দলে সিনিয়র–জুনিয়র দ্বন্দ্ব নেই বলে দাবি সাবিনার
ফেসবুক
প্রশ্ন:

ছোটদেরও তো শিখতে হবে। তাই না?

সাবিনা: অবশ্যই। তবে শামসুন্নাহার জুনিয়রের কথাই যদি বলি, ছোটন স্যার, পল স্যারের সময় ও অনেক ছোট ছিল। ওকে তখন হুট করে সেরা একাদশে নামিয়ে দেয়নি। চাপটা সে তখনই নিতে পারবে, যখন ফল ৩-০ হচ্ছে, ১০-১৫ মিনিট খেলা বাকি।  

প্রশ্ন:

যা–ই হোক, গুমোট অবস্থা কাটিয়ে কীভাবে দলটাকে এক করলেন? 

সাবিনা: সব ম্যাচের আগে আমি ছোটন স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলতে চেষ্টা করি। আমার মনে হয়, আমার থেকে উনি আমাকে ভালো চেনেন। ১৪ বছরের সম্পর্ক তো। শুধু আমাকে নয়, প্রত্যেকটা খেলোয়াড়েরই। স্যার বলেছিলেন, হার-জিত-ড্র যা–ই হোক, তোমরা সেমিতে যাবে। এই বার্তাটা সবাইকে ফরোয়ার্ড করেছিলাম যে স্যার এটা বলেছেন। কারণ, অনেক বিতর্ক হচ্ছিল তখন। আমার মনে হয়েছে, এই বার্তাটা আমার কাছ থেকেই যাক মেয়েদের কাছে। 

প্রশ্ন:

বর্তমান কোচ কি তাহলে আপনাদের যথেষ্ট উজ্জীবিত করতে পারছেন না? 

সাবিনা: উজ্জীবিত করার ব্যাপার নয়। বর্তমান কোচ সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আছেন। প্রত্যেক কোচের ফিলোসফি ভিন্ন। তবে আমি ১৪ বছরের সম্পর্কের সঙ্গে ছয় মাসের সম্পর্ক কখনোই এক করতে চাই না। অবশ্যই দুজনের মধ্যে অনেক পার্থক্য। একজন হয়তো একভাবে কাজ করেন, আরেকজন আরেকভাবে। তাঁদের কাজ করার ধরনটাকে আমি সম্মান করি। 

অনুশীলনে সাবিনা
ফেসবুক
প্রশ্ন:

বাটলার বলেছেন, মেয়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত থাকেন। টিকটক করেন।

সাবিনা: সোশ্যাল সাইটে অ্যাকটিভ শুধু বাংলাদেশের মেয়েরা নয়। সারা দুনিয়ার মেয়েরাই অ্যাকটিভ। একটা মেয়ে যখন ভোর চারটায় উঠে অনুশীলনে যায়, আটটায় ফেরে, ৯-১০টায় নাশতা করে। দুপুরে জিম করে। ওর নিজস্ব মানসিক শান্তির দরকার আছে। সে সারাক্ষণ ক্যাম্পে থাকে। ওরা কেন সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকটিভ, প্রশ্নটাই তো ওঠা উচিত নয়। 

প্রশ্ন:

অনেকে বলেন, টিকটকে ব্যস্ত থাকায় কারও ভালো খেলার খিদে কমে গেছে।

সাবিনা: টিকটক করাটা কী ক্ষতির, আমার মাথায় আসে না। এভাবে মেয়েদের ডিমোটিভেট করার চেয়ে কীভাবে চাঙা রাখা যায়, এটাই আপনাদের কাজ। এদের গড় বয়স ২১-২২। খুব স্বাভাবিক ওরা সোশ্যাল সাইটে অ্যাকটিভ থাকতে চাইবে। এটা দিয়ে তাদের বিচার করলে সেটা হবে দুঃখজনক। 

প্রশ্ন:

২৭ অক্টোবর সেমিফাইনাল। সমর্থকদের কী বার্তা দেবেন?

সাবিনা: দেশের মানুষের ভাবা উচিত দুই বছর আগে মেয়েরা সাফ জিতেছে, এখন কেন একই রকম পারফরম্যান্স হচ্ছে না। মেয়েরা কেন আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে। বাংলাদেশের কালচারটাও বুঝতে হবে। মেয়েদের জন্য কয়টা ম্যাচের ব্যবস্থা করতে পারছেন? সারা বছর ট্রেনিং করেই উন্নতি হলে বাংলাদেশ হতো বিশ্বের শীর্ষ দল। কারণ, তারা সারা বছর ক্যাম্পে থাকে। 

সাবিনার নেতৃত্বে ২০২২ নারী সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ
ইনস্টাগ্রাম
প্রশ্ন:

শেষ প্রশ্ন। জুনিয়র মেয়েদের মনের অবস্থা কী?

সাবিনা: আজ সকালে ওরা আমায় বলছিল, আপু, ভালো কিছু হলে তাড়াতাড়ি ছড়ায় না, একটু খারাপ কিছু হইলেই দ্রুত ছড়ায়ে যায়। এটা খারাপ লাগে। মেয়েদের যা দরকার, যা দিতে পারবেন না, মেয়েদের দোষও দেওয়া ঠিক নয়। আবার ফল এদিক–ওদিক হলেই কথা বলেবেন। কিন্তু মেয়েরা জানে, দেশের জন্য কীভাবে খেলতে হয়। কেউ যদি বলে মেয়েরা খেলার ভেতর নেই, সেটা ঠিক নয়। ভারত ম্যাচে মেয়েরা নিজেদের প্রমাণ করেছে। ওরা দেশের সম্মানের জন্য খেলছে।