সাক্ষাৎকারে রানী হামিদ

‘বুদাপেস্টের পরিবেশের কারণেই আমার খেলা ভালো হয়েছে’

হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ৪৫তম দাবা অলিম্পিয়াডে এবার বাংলাদেশ খুব একটা ভালো করেনি। উন্মুক্ত বিভাগে বাংলাদেশ ১৮৮টি দলের মধ্যে ৭৮তম, মেয়েদের বিভাগে ১৬৯টি দলের মধ্যে ৮১তম। তবে এর মধ্যেও উজ্জ্বল ৮১ বছর বয়সী রানী হামিদ। বুদাপেস্ট অলিম্পিয়াডে যাঁর যাওয়ারই কথা ছিল না। যাওয়ার পরও প্রথম দুই ম্যাচে সেরা চারে ঠাঁই হয়নি। পরের গল্পটা শুধুই রানীময়। ৮ ম্যাচে ৭ জয়। যার মধ্যে টানা ৬টি। এই বয়সে এসে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার রহস্যটা কী? গত সোমবার রাতে দেশে ফিরে প্রথম আলোর সঙ্গে রানী হামিদ কথা বলেছেন আরও অনেক কিছু নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ আলম

প্রথম আলো:

জাতীয় দাবায় এবার আপনি প্লে-অফে ষষ্ঠ হয়েছিলেন। টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় হওয়া মহিলা ফিদে মাস্টার নারায়ণগঞ্জের শারমীন সুলতানা পারিবারিক কারণে অলিম্পিয়াডে না যাওয়ায় মেয়েদের দলের পঞ্চম খেলোয়াড় হিসেবে আপনার সুযোগ আসে। সুযোগটা দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন। নিজে কতটা খুশি?

রানী হামিদ: অনেক খুশি। তবে জানি না, কীভাবে ভালো হয়ে গেল আমার খেলা! আমি স্বাভাবিক খেলাটাই খেলেছি। আসলে বুদাপেস্টে আবহাওয়া খুব ভালো ছিল। সে জন্য হয়তো এত ভালো হয়েছে আমার খেলাটা। এমনিতে আমি হঠাৎ ভুল করে অনেক সময় জেতা ম্যাচও হেরে যাই। এই অলিম্পিয়াডে সে রকম ভুল হয়নি, তাই ৮ ম্যাচের ৭টিই জিতেছি। এবারের সাফল্যটা আসলে আশাতীত।

প্রথম আলো:

বিশ্বমঞ্চে এভাবে টানা জয়ের পেছনে কোন বিষয়টা বেশি অনুপ্রাণিত করেছে আপনাকে?

রানী হামিদ: ওখানকার পরিবেশ। দেশে তো অনেক সময় খেলতে হয় গরমের মধ্যে। কারেন্ট থাকে না, এসি ভালোমতো চলে না, নানা সমস্যা। গরমে খেলতে আমার সমস্যা হয়, ভুল বেশি হয়। গরমে আমার মাথাও গরম হয়ে যায়। বুদাপেস্টে সেটা হয়নি। কারণ, সেখানকার পরিবেশই ছিল অন্য রকম। বুদাপেস্টের পরিবেশের কারণেই আমার খেলা ভালো হয়েছে।

হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে বাংলাদেশের মহিলা দাবা দল
সংগৃহীত
প্রথম আলো:

এটিকেই কি নিজের সেরা অলিম্পিয়াড বলবেন?

রানী হামিদ: এর আগেও দু-একবার ভালো করেছি। ১ নম্বর বোর্ডে টানা ছয় ম্যাচ জিতেছি। সাবেক মহিলা বিশ্ব রানারআপের সঙ্গে ড্র করেছি, মহিলা জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকেও হারিয়েছি। বিশ্বের তৃতীয় সেরা মহিলা দাবাড়ুকে হারিয়েছি। তখন কিন্তু এত আলোচনা হয়নি। এবার হচ্ছে; কারণ, আমার তো খেলারই কথা ছিল না।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

৮১ বছর বয়সে আপনি এবারের অলিম্পিয়াডে খেলেছেন। সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হাঙ্গেরির মহিলা গ্র্যান্ডমাস্টার সুশান পোলগার আপনাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছেন। অলিম্পিয়াডেও আপনাকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে শুনেছি। এসবে আপনার কেমন লেগেছে?

রানী হামিদ: খুব ভালো। সুশান পোস্ট করার পর সবাই আমার সম্পর্কে জানতে পেরেছে। আসলে সুশান আমাকে খুব পছন্দ করে। আশির দশকের শুরুতে যখন লন্ডনে গেলাম খেলতে, সে-ও এসেছিল তার মাকে নিয়ে। ওর বয়স তখন ১৪-১৫। আমার ৩৩। তবে বয়স কম হলেও ওকে দেখতে বড়ই লাগত। ওই সময় ওর মা বলত, কীভাবে ছেলেদের বড় বড় জিএমরা ওকে দাবিয়ে রাখতে চায়। সবখানে আসলে একই রকম কাহিনি। সেবার বড় বড় দাবাড়ুকে পেছনে ফেলে সে ভালো করল। একবার অলিম্পিয়াডে দেখলাম, ওর বোন জুডিথ পোলগার ওপেন বিভাগে ১ নম্বর বোর্ডে খেলেছে। বড় বড় ঝানু দাবাড়ুরা পেছনে লাইন দিয়ে দেখছে ওর খেলা। অবাক লেগেছে, ভালোও লেগেছে। সাধনা করলে আসলে কী না হয়, তা–ই দেখলাম।

পরের চালটা কী হবে, ভাবছেন রানী
সংগৃহীত
প্রথম আলো:

শেষ রাউন্ডে আপনার ম্যাচটা প্রায় ১০০ চালে গেছে। এত সময় লাগল কেন?

রানী হামিদ: দশম রাউন্ড পর্যন্ত খেলা হয়েছে বিকেলে। শেষ রাউন্ড সকালে। দশম রাউন্ড খেলার পর সারা রাত ঘুমাইনি। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাই। কয়েক ঘণ্টা পর খেলতে বসি এবং জিতি। কিংয়ের ওপর আক্রমণ করে দুই বিশপ হাতে রাখছিলাম। প্রতিপক্ষ চাইলে রিজাইন করতে পারত। সে-ও অনেক চেষ্টা করেছে, তাই অনেক সময় লেগেছে। তবে বেশি সময় নিয়ে খেলতে আমার তেমন কষ্ট হয় না। সমস্যা হলো, হঠাৎ ভুল করে ফেলি।

আমাদের সেই সাধনা নেই। না খেলোয়াড়ের চেষ্টা আছে, না সংগঠকের। কারোরই চেষ্টা নেই, এটাই সমস্যা।
রানী হামিদ
প্রথম আলো:

আপনি তো এবার বলে গিয়েছিলেন, সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসবেন। আর অলিম্পিয়াডে যাওয়া হয় কি না, জানেন না। তা বুদাপেস্টে কি সবার কাছে বিদায় বলে এসেছেন?

রানী হামিদ: (হাসি) সবাইকে বলেছি, ভালো থেকো। আবার দেখা হতে পারে, না-ও পারে। কাজাখস্তানের এক খেলোয়াড় আমার সঙ্গে ছবি তুলল। বলল, আপনি খেলেন বলে আমরা প্রেরণা পাই। এভাবে অনেকেই বলেছে, আমাকে দেখলে নাকি শক্তি পায় ওরা।

বয়সে অনেক তরুণ প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলা শুরুর আগে রানী
সংগৃহীত
প্রথম আলো:

এবারের অলিম্পিয়াডে আপনার চোখে বাংলাদেশ কেমন করল?

রানী হামিদ: খারাপই করেছে বলব। কেন এমন খারাপ হলো, বুঝলাম না। মেয়েরা ৮১তম হয়েছে। ছেলেরা ৭৮তম। হয়তো গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের মৃত্যুটা আমাদের সবার মনে প্রভাব ফেলেছে। আসলে আধা পয়েন্ট-এক পয়েন্টের জন্য ফলাফলে অনেক হেরফের হয়। আমাদের মেয়েরা একটা সময় পর্যন্ত ভালোই খেলছিল। শেষ ম্যাচে হাফ পয়েন্ট বেশি পেলে মেয়েরা ১৫-২০ ধাপ এগিয়ে যেতে পারত।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

অষ্টম রাউন্ডে এসে বাংলাদেশ নারী দল ২৭তম ছিল। তারপর টানা তিনটি হার। শেষটা কেন এমন হলো?

রানী হামিদ: আমরা শেষ রাউন্ডে ১ পয়েন্ট পেয়েছি। আর দুটি বোর্ড থেকে আধা পয়েন্ট করে এলেও অবস্থাটা বদলাত। প্রতিপক্ষ বেলজিয়াম দলটাও কাছাকাছি ছিল। আসলে ভালো করতে হলে ভালো টিমকে হারাতে হবে। আমরা তো সুইডেনের মতো দলকে হারিয়েছি। আরেকটা বড় ম্যাচও জিতেছি। ওই ধারা ধরে রাখতে পারলে নারী বিভাগে ৪০-৫০-এর মধ্যে থাকা যেত। শেষের দিকে এসে কিছুটা ছন্দপতন হয়েছে।

আমি তো দাবা খেলেছি খামখেয়ালিভাবে। পরিকল্পনা করে কই খেললাম! টাইম পাসের জন্য খেলি। যখন শুরু করি, দাবা তখন বুড়োদের খেলা ছিল, এখন না বাচ্চাদের খেলা হয়ে গেছে!
রানী হামিদ
প্রথম আলো:

আর উন্মুক্ত বিভাগ নিয়ে কী বলবেন?

রানী হামিদ: সেখানেও অনেক জেতা বোর্ড ড্র হয়েছে। না হলে এত পেছনে পড়ার কথা নয়। দুজন খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স অনেক সময় ভালো হয়েছে, অনেক সময় কম শক্তির খেলোয়াড়ের কাছে ওরা হেরেছে। আসলে দাবার জন্য তৈরি হতে অনুকূল পরিবেশ লাগে। ভারত যে এবার দুই বিভাগেই চ্যাম্পিয়ন হলো, এটা তো এক দিনে হয়নি। দুই বিভাগে ভারতীয় দলের ১০ জন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কোচ ছিলেন ৮ জন! অবাকই হয়েছি। ওদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে অনেক সাধনা, পরিশ্রম ছিল, পরিকল্পনা আছে।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের দাবা কোথায় পিছিয়ে গেল?

রানী হামিদ: আমরা আসলে খেলাটা জাস্ট টাইম পাসের জন্য খেলি। আমাদের সেই সাধনা নেই। না খেলোয়াড়ের চেষ্টা আছে, না সংগঠকের। কারোরই চেষ্টা নেই, এটাই সমস্যা। আমরা যেভাবে খেলি, এর চেয়ে ভালো রেজাল্ট আর কী হবে? তবে মেয়েদের কথা যদি বলি; পুলিশ, আনসার, নৌবাহিনীতে ওদের ভালো সুযোগ–সুবিধা দিচ্ছে। তাদের আরও ভালো করা উচিত।

হাঙ্গেরির বিখ্যাত পোলগার বোনদের একজন সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সুসান পোলগারের সঙ্গে রানী
সংগৃহীত
প্রথম আলো:

দশম রাউন্ডে ইসরায়েলের বিপক্ষে খেলেননি গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব। এটা কি ঠিক হয়েছে, আপনার কী মত?

রানী হামিদ: শুনেছি, রাজীব নাকি আগের রাতেই না খেলার কথা বলেছিল টিম ক্যাপ্টেনকে। ঘটনা যা–ই হোক, এটা তো আসলে দলীয় খেলা। কাজেই দলীয় সিদ্ধান্তই আগে। ব্যক্তিগত মত এখানে অগ্রাধিকার পায় না। ওই ম্যাচে নীড় (মনন রেজা) ইসরায়েলের গ্র্যান্ডমাস্টারকে হারিয়েছে, খুশি হতাম রাজীবও খেলে যদি জিতত। আর আমার মত হলো, টিম ক্যাপ্টেন যা বলত, আমি তা–ই করতাম।

প্রথম আলো:

দাবা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

রানী হামিদ: (হাসি) আমি তো দাবা খেলেছি খামখেয়ালিভাবে। পরিকল্পনা করে কই খেললাম! টাইম পাসের জন্য খেলি। যখন শুরু করি, দাবা তখন বুড়োদের খেলা ছিল, এখন না বাচ্চাদের খেলা হয়ে গেছে! সুস্থ থাকলে খেলা চালিয়ে যাব। ২০২৬–এর অলিম্পিয়াডে যদি সুযোগ পাই, নিশ্চয়ই যেতে চাইব।

আরও পড়ুন