নতুন চ্যাম্পিয়ন, না প্রথম চ্যাম্পিয়নের ফেরা

আজ ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ফাইনালপ্রথম আলো

নতুন চ্যাম্পিয়নকে স্বাগত জানাবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, নাকি আবার বরণ করে নেবে প্রথম চ্যাম্পিয়নকে। এটাই হতে পারে ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের ট্যাগলাইন। হতে পারে কি, এটাই তো হওয়া উচিত। আর কিছু খোঁজার কী প্রয়োজন!

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আর খুব বেশি অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। তবে অপেক্ষা না করে এখনই যা বলে দেওয়া যাচ্ছে, তা হলো নতুন চ্যাম্পিয়ন পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নতুন একটা কিছু অবশ্যই পাচ্ছে এই বিশ্বকাপ। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন!

টি-টোয়েন্টি এমনই অনিশ্চিত খেলা, এমনই অঘটনঘটনপটীয়সী, দুই ফাইনালিস্টেরই অপরাজিত থেকে ফাইনালে ওঠাটাকে বিস্ময়ই বলতে হবে। এর আগে এত বছরেও যে এমন হয়নি, তা তো আর এমনি নয়। আগেই দুই দলের দেখা হয়ে গেলে এবারও যা হতো না।

দক্ষিণ আফ্রিকার আটে-আট। ভারতের আটে-সাত। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শতভাগ জয় নিয়ে ভারতের ফাইনালে উঠতে না পারাটা তাদের ব্যর্থতা নয়। ওটা বৃষ্টির কাজ। কানাডার বিপক্ষে ম্যাচটা যে কারণে হতে পারেনি।

অষ্টমবারের চেষ্টায় সেমিফাইনাল-জুজু জয় করে দক্ষিণ আফ্রিকার ফাইনালে ওঠাটাই অনেক বড় ঘটনা। প্রথম ফাইনালে উঠেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলে যা আরও বড় হয়ে যাবে। প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারত যথেষ্টই কঠিন, দুই দলের ফাইনালমুখী যাত্রার দিকে ফিরে তাকালে ভারতকেই মনে হবে শ্রেয়তর দল। টুর্নামেন্টজুড়েই যাদের দাপুটে পারফরম্যান্স। তার পরও কখনো কখনো মনে হচ্ছে, ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য ভারতের চেয়ে বড় একটা প্রতিপক্ষ আছে। অদৃশ্য সেই প্রতিপক্ষকে জয় করাই হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকার আসল চ্যালেঞ্জ।

সেমিফাইনালে আফগানিস্তানের অমন উড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ব্রায়ান লারা একাডেমির উইকেটের কথা বলতে পারেন, দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্দান্ত বোলিংয়ের কথাও। তবে আসল কারণটা হয়তো অন্য। অভাবনীয় সেমিফাইনালের আনন্দ আফগানদের আবেগের এমন শৃঙ্গে তুলে দিয়েছে যে এক দিনের মধ্যে সেই চূড়া থেকে আর নামা সম্ভব হয়নি। হয়তো সম্ভবও না।

দক্ষিণ আফ্রিকার ফাইনালে ওঠা তো আরও বেশি আবেগের জন্ম দেওয়ার কথা। সাত-সাতটি সেমিফাইনাল থেকে শূন্য হাতে ফেরার বিচিত্র সব ইতিহাসকে পেছনে ফেলে এই ফাইনাল। প্রজন্মের পর প্রজন্মের ৩২ বছরের দুঃখগাথার শেষ এই ফাইনাল। এমন একটা কিছু করে ফেলার পর দক্ষিণ আফ্রিকানদেরও আবেগে ভেসে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ফাইনালে মাঠে নামার আগে তা ঝেড়ে ফেলে পেশাদারের রূপে প্রত্যাবর্তন হয়তো অসম্ভব কিছু নয়। তবে একটু কঠিন তো বটেই।

এই দক্ষিণ আফ্রিকা দলের ক্রিকেটারদের কথাবার্তায় অবশ্য খুব কঠিন কিছু মনে হচ্ছে না। আবেগের প্রকাশ সীমাবদ্ধ মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেকদের মধ্যেই। এইডেন মার্করামদের প্রজন্ম মনে হয় অন্য ধাতুতে গড়া। যে কারণে সেমিফাইনাল শেষেই ফাইনাল নিয়ে অমন গোছানো ভাবনার কথা বলতে পারেন দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক। যদিও তখন পর্যন্ত ফাইনালের প্রতিপক্ষই ঠিক হয়নি।

টানা ৮ ম্যাচ জিতে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকা
আইসিসি

সেটি যখন ঠিক হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকা দল তখন ত্রিনিদাদ বিমানবন্দরে আটকা পড়ে আছে। ফাইনালের আগে বাড়তি যে একটা দিন পাওয়া গিয়েছিল, তা ওভাবেই শেষ। বার্বাডোজগামী চার্টার্ড বিমান ছাড়ার কথা ছিল সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে। তা ওড়ার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছিল। বার্বাডোজ বিমানবন্দরে এক দুর্ঘটনায় রানওয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত যা ছেড়েছে সাত ঘণ্টা পর। বিমানবন্দরে বসেই গায়ানার ম্যাচ দেখেছে দক্ষিণ আফ্রিকা দল। যদিও খেলোয়াড়দের প্রায় সবার সঙ্গেই স্ত্রী-বান্ধবী-সন্তান থাকায় খুব যে নির্বিঘ্নে তা দেখা গেছে, এমন নয়।

বিশ্বকাপের ২০ দলের মধ্যে একমাত্র ভারতই জানত, সেমিফাইনালে উঠলে তাদের ম্যাচটা কোথায় পড়বে। বিশ্বকাপের ২০ দলের মধ্যে ভারতই একমাত্র দল, যাদের সব ম্যাচ একই সময়ে। এর সবই যে অর্থ নামের অনর্থের কারণে, এটা তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই। ভারত এতে বাড়তি সুবিধা পেয়েছে বলে যতই শোরগোল হোক, ভবিষ্যতেও এমনই হবে। বিশ্বকাপের সূচি সব দেশের কাছেই যায়। সব দেশেরই তাতে মত দেওয়ার সুযোগ থাকে। নিজেদের স্বার্থেই তারা চুপ করে থাকে। গায়ানায় সেমিফাইনাল খেলার কথা আগেই জানা থাকায় একটু সুবিধা তো পেয়েছেই ভারত।

তাই বলে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের স্রেফ উড়ে যাওয়ার কারণ তো আর শুধু সেটিই হতে পারে না। ইংল্যান্ডের এই দলের প্রায় সবাই বছরের পর বছর আইপিএলে খেলছেন। ভারতের বোলারদের কেউই তাঁদের অচেনা নয়। ওই স্লো-লো-টার্নিং উইকেটও না। তারপরও অমন ভেঙে পড়া আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিচ্ছে, সাদা বলের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের দিন শেষ।

তাহলে কি ভারতের দিন শুরু? ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে হারের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার সুযোগ হয়ে সাত মাসের মধ্যেই আরেকটি বিশ্বকাপের ফাইনাল। সেই ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর আর কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট জিততে না পারার আক্ষেপ ঘোচানোর আরেকটি সুযোগ। আজকের ফাইনালে ফেবারিটও হয়তো ভারতই।

ফ্র্যাঞ্চাইজি আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যদি টি-টোয়েন্টির দুটি ধারা হয়, আইপিএল আর বিশ্বকাপ সেই দুটি শোপিস ইভেন্ট। সেই দুটিতে এবার কী বৈপরীত্য! আইপিএলে রীতিমতো রান–বন্যা আর এখানে রানের জন্য হাহুতাশ। বিরাট কোহলিই হতে পারেন এই বৈপরীত্যের আদর্শ প্রকাশ।

বিরাট কোহলি ছন্দে নেই
বিসিসিআই

৭৪১ রান করে আইপিএলের সর্বোচ্চ স্কোরার ফাইনালের আগে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানদের তালিকায় ৫৪ নম্বরে! ৭ ইনিংসে রান মাত্র ৭৫। কোহলিকে এমন বিবর্ণ কে দেখেছে কবে! ফাইনালের জন্যই কি জমিয়ে রেখেছেন সব? রোহিত শর্মার তো এমনই বিশ্বাস। আশাও বলতে পারেন।

বিশ্বকাপ তাঁরা দুজনেই জিতেছেন। একজন টি-টোয়েন্টির বিশ্বকাপ, অন্যজন ওয়ানডের। তবে একসঙ্গে কখনো বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে ভাসা হয়নি। রো-কো জুটির এটাই হয়তো শেষ বিশ্বকাপ। তা কি দুজনের যুগল উদ্‌যাপনের স্মৃতি হয়ে থাকবে, নাকি নতুন চ্যাম্পিয়নকে আবাহনের।

তা আগেই জেনে গেলে কি আর ফাইনাল দেখতে বসতেন আপনি!