২৬-এর মাঝরাত পেরিয়ে ততক্ষণে আগস্টের ২৭ হয়ে গেছে। সালটা ২০২৩। বুদাপেস্টের একটা নৈশক্লাবে প্রচণ্ড জোরে মিউজিক বাজিয়ে চলেছেন ডিজে। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছেন নোয়াহ লাইলস। পকেটে থাকা ফোনে ক্রমাগত নোটিফিকেশনের শব্দ বেজেই চলছে। লাইলসের সেসব দেখার সময় নেই। এ তাঁর উদ্যাপনের রাত।
বুদাপেস্টেই আগের দুই দিনে লাইলসের গলায় ঝুলেছে তিনটি সোনার পদক। উসাইন বোল্টের পর প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের এক আসরে জিতেছেন ১০০ মিটার, ২০০ মিটার ও ৪x১০০ মিটার রিলে। সেই খুশিতেই নৈশক্লাবে এমন উদ্যাপন। লাইলস জানেন, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে ফোনে একের পর এক অভিনন্দন বার্তা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এখন ওসব দেখার সময় নয়। পরে সময় করে সবাইকে ধন্যবাদ দেওয়া যাবে।
কিন্তু ফোনটা যে আওয়াজ করেই চলেছে! বিরক্ত হয়ে বন্ধ করে দিতে যাবেন, এমন সময় একটা কল এল। খুব কাছের এক বন্ধু। ওটা ধরলেন। ‘কী বলেছ তুমি? তোমার ইনস্টাগ্রামে যাও। দেখো কী হচ্ছে’—ডিজের প্রচণ্ড জোরে বাজনার মধ্যে শুধু এটুকুই বুঝতে পারলেন লাইলস। কিছুটা বিরক্ত হয়েই ফোন থেকে ইনস্টাগ্রামে ঢুকলেন।
তাঁর সংবাদ সম্মেলনের একটা ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। সেটার নিচে অনেকেই তাঁকে ধুয়ে দিচ্ছেন। সব কড়া কড়া মন্তব্য। মন্তব্যকারীদের মধ্যে আছেন এনবিএ তারকা কেভিন ডুরান্ট, এনবিএপ্রেমী ও বিখ্যাত কানাডিয়ান র্যাপার ড্রেকও। ‘ধ্যাৎ’—স্বগতোক্তি করলেন লাইলস। ফোন বন্ধ করে মনোযোগ দিলেন নাচে।
ক্লিপটা ছিল বুদাপেস্টে তাঁর ‘ট্রেবল’ জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনের। একটা প্রশ্নের সূত্র ধরেই বলেছিলেন, ‘এনবিএর প্রতি মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন দলগুলো যে নিজেদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবি করে, ওরা কোন দেশের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! যুক্তরাষ্ট্রের? ওরা তো বিশ্ব পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করে না।’ ব্যস, আমেরিকান এক অ্যাথলেটের মুখে ওটা শুনে খেপে গেলেন তাবৎ এনবিএপ্রেমী। যেটা দেখে লাইলসের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল ওই—‘ধ্যাৎ’।
লাইলস এমনই। যেটা মনে আসে, সেটাই বলে ফেলেন। কী প্রতিক্রিয়া হবে, সেই ভয় পান না। কেভিন ডুরান্ট, ড্রেক কিংবা ট্র্যাকে তিনি যাঁদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাঁদের কাউকেই তো আসলে প্রতিপক্ষ মনে করেন না, তাঁর প্রতিপক্ষ সময়। আর সময়ের সঙ্গে যাঁরা লড়েন, তাঁদের একটু সাহসী হতে হয় বৈকি!
বিশ্বের সেরা স্প্রিন্টারদের নিয়ে নেটফ্লিক্সের বানানো স্প্রিন্ট নামে ডকু সিরিজেও বুদাপেস্টে বলা লাইলসের ওই প্রসঙ্গটা আছে। চ্যাম্পিয়ন লাইলসকে কিছুটা চেনা যায় সেই সিরিজে বলা তাঁর একটা কথা থেকে, ‘আপনার থাকতে হবে ঈশ্বরের মানসিকতা। আমি বিশ্বাস করি, কোনো মুহূর্ত আমার চেয়ে বড় নয়। মুহূর্ত তৈরিই হয় আমার জন্য।’
প্যারিস অলিম্পিকে সে রকমই কিছু মুহূর্তের অপেক্ষায় লাইলস। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জেতা তিনটি ইভেন্টে তো নামছেনই, দৌড়াতে চান ৪x৪০০ মিটার রিলেতেও। অলিম্পিক ইতিহাসেই কোনো অ্যাথলেট একই গেমসে চারটি ট্র্যাক ইভেন্টে সোনা জেতেননি কখনো। আমেরিকার জেসি ওয়েন্স (১৯৩৬ বার্লিন), কার্ল লুইস (১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস) দুজনই চারটি করে সোনা জিতেছিলেন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্ট মিলিয়ে। দুজনেরই ১০০, ২০০ ও ৪x১০০ মিটারের সঙ্গে আরেকটা ইভেন্ট ছিল লং জাম্প। এর বাইরে ১৯০০ প্যারিস অলিম্পিকে ৬০ মিটার স্প্রিন্ট, ১১০ মিটার হাই হার্ডলস, ২০০ মিটার লো হার্ডলস ও লং জাম্প মিলিয়ে চার সোনা জয়ের কীর্তি আছে আমেরিকারই আলভিন ক্রায়েনজলিনের। এবার প্যারিসে লাইলসের সামনে হাতছানি তাঁদের ছোঁয়ার, আবার একদিক থেকে তাঁদের চেয়েও আলাদা হয়ে থাকার।
বুদাপেস্টে লাইলসের ট্রেবল জয়ের আগে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এই কীর্তি ছিল শুধু বোল্টের, ২০১৫ সালে বেইজিংয়ে যা করেছিলেন জ্যামাইকান কিংবদন্তি। ১১টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ও ৮টি অলিম্পিক সোনা জয়ের পর ২০১৭ সালে অবসরে যান বোল্ট।
বোল্টের অবসরের পর বিশ্ব অ্যাথলেটিকসের ট্র্যাকও আসলে বর্ণিল কোনো মহাতারকার আবির্ভাবের অপেক্ষায়। তবে আপাতত বোল্টের রেখে যাওয়া শূন্যস্থান পূরণ নয়, লাইলসের লক্ষ্য সর্বশেষ টোকিও অলিম্পিকের ভূত তাড়ানো। টোকিও অলিম্পিক হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে, লাইলসের লক্ষ্য ছিল সেখানে ১০০, ২০০ ও ৪x১০০ মিটারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার। কিন্তু করোনার কারণে শেষ পর্যন্ত সেই অলিম্পিক হয়েছে এক বছর পর। তত দিনে চোট ও মানসিক ধকল মিলিয়ে লাইলস বেকায়দায়। ১০০ মিটারে অলিম্পিক ট্রায়ালেই বাদ পড়েন। শেষ পর্যন্ত শুধু ২০০ মিটারেই অংশ নিয়ে জিতেছিলেন ব্রোঞ্জ। কয়েক দিন আগে লন্ডন ডায়মন্ড লিগে ১০০ মিটারে ব্যক্তিগত সেরা ৯ দশমিক ৮১ সেকেন্ডের টাইমিংয়ের পর লাইলস বলেছিলেন, ‘আমার বুকে এখনো আগুন ধরায় ওই ব্রোঞ্জ। আমি প্যারিসে এটি নিয়েই ঘুরব। নিজেকে মনে করিয়ে দিতে যে এবার আর এই রং নিয়ে ফিরছি না।’
এ রকম কথা বলার পর প্যারিসে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ওপর অনেক বেশি চোখ থাকবে, বাড়বে প্রত্যাশার চাও। এটা ভালোই জানেন লাইলস। যে কারণে কিছুদিন আগে এটাও বলেছেন, ‘প্যারিসে যাওয়ার আগে জানি, আমি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে। আমার দিকে যত বেশি চোখ থাকবে, আমি তত ভালো পারফর্ম করব। অন্তত আমার থেরাপিস্ট এমনই বলেন। টিভি ক্যামেরা যখন আমার দিকে তাক করা, যখন লোকে আমাকে দেখতে আসে, আমি তখন হারি না।’
এমন একজনকে দেখার অপেক্ষায় তো থাকাই যায়। সেই অপেক্ষার শেষ হচ্ছে আগামী ৩ আগস্ট। সেদিনই ছেলেদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের হিটে প্যারিস অলিম্পিক প্রথম দেখবে লাইলসকে। পরদিন ফাইনাল শেষে হয়তো তাঁর উদ্যাপনও।