‘হকির ম্যারাডোনা হয়েছি, এর চেয়ে বেশি গর্বের কিছু নেই’

‘হকির ম্যারাডোনা’ নামে খ্যাত পাকিস্তানের কিংবদন্তি শাহবাজ আহমেদছবি: আশরাফুল আলম

বাংলাদেশের হকিতে শাহবাজ আহমেদ এক নস্টালজিয়ার নাম। নব্বই দশকের মাঝামাঝি ঢাকা মোহামেডানের জার্সিতে বাংলাদেশের ঘরোয়া হকি মাতিয়ে যান। নানা ভূমিকায় আরও তিন-চারবার এসেছেন ঢাকায়। ‘হকির ম্যারাডোনা’ তিন দিন আগে বাংলাদেশে এসেছেন পঞ্চমবারের মতো। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় শুরু হতে যাওয়া দেশের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি হকি লিগে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের দল মোনার্ক মার্টের পরামর্শক তিনি। এই সুযোগে গতকাল বিকেলে পল্টনে টিম হোটেলের রেস্টুরেন্টে বসে ৫৪ বছর বয়সী শাহবাজ আহমেদ ফিরে তাকালেন বাংলাদেশসহ হকির নানা প্রসঙ্গে।

মোহামেডানে খেলার স্মৃতি

স্মৃতিটা তাঁকে আলোড়িত করে এখনো। তাই বাংলাদেশে আসেন সানন্দে। শাহবাজ বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আমাকে সম্মান করে, ভালোবাসে। তাই এখানে এসে আনন্দ পাই। সম্ভবত ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জেতার পরপর মোহামেডানের হয়ে প্রথম ঢাকায় আসি ১৯৯৫ সালে, তখন প্রথম এসেই ঘাসের মাঠে খেলেছিলাম।’

তিন বছর মোহামেডানে খেলে প্রতিবারই চ্যাম্পিয়ন করেছেন দলকে। সাপের মতো তাঁর আঁকাবাঁকা স্টিক ওয়ার্কের সামনে দাঁড়াতে পারত না প্রতিপক্ষ, যা মনে করে শাহবাজ আজও রোমাঞ্চিত। ‘সাদাকালো জার্সি পরে আমরা মাঠে নামার সময় দর্শক অনেক চিৎকার করত। সেটা ছিল দারুণ একটা অনুভূতি। দর্শক আমার হকি স্কিল ভালোবাসত। আমি তা কখনো ভুলব না,’ শান্ত গলায় বলে যান হকির কিংবদন্তি।

শাহবাজ আহমেদ। যখন খেলোয়াড় ছিলেন
ছবি: টুইটার

মোহামেডান থেকে প্রস্তাব পেয়ে প্রথমেই নাকি বলেছিলেন, দলের সব সিদ্ধান্তই তিনি নেবেন। কেন? ২৭ বছর পেছন ফিরে বলেন, ‘কারণ, আমি মোহামেডানকে চ্যাম্পিয়ন করতে চেয়েছি। তাই আমিই ছিলাম দলটির অধিনায়ক, আমিই ছিলাম কোচ। বিদেশি খেলোয়াড় নেওয়া হয় আমার পছন্দেই। আমি কোনো কাজ অর্ধেক করতাম না। শতভাগ দিতাম। সেটার কল্যাণেই আমরা চ্যাম্পিয়ন হতাম।’

ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে কী করতে চান

সাকিবের দলে এসেছেন, তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘পোস্টার বয়ে’র সঙ্গে তাঁর কখনো কথা হয়নি। তিনি জানেন, সাকিব এখন বিশ্বকাপ নিয়ে ব্যস্ত। সেই সাকিবের দলকে জেতানোই এই সফরে শাহবাজের লক্ষ্য। খেলোয়াড়দের শেখাবেন নানা কিছু। কীভাবে মাঠে শক্ত থাকা যায়...আচার-আচরণ... । জুসের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে শাহবাজ বলেন, ‘এখনো শতভাগই দেব। স্থানীয় খেলোয়াড়দের কিছু দিতে চাই। তারা যাতে উজ্জীবিত হয়।’

দেশের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি হকি লিগে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের দল মোনার্ক মার্টের পরামর্শক হিসেবে এসেছেন শাহবাজ
ছবি: আশরাফুল আলম

তবে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগটা নব্বই দশকে ঢাকার লিগের সেই জমজমাট আবহ ফিরিয়ে আনতে পারবে মনে করেন না শাহবাজ। কারণটাও বলেন, ‘বাংলাদেশের হকিতে আগের সেই আবহ নেই, মানও নেই। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ হচ্ছে ভালো। কিন্তু কিছু বিদেশি খেলোয়াড় আনা হচ্ছে, যাঁদের দেশ হকিতে এমন কিছুই নয়। ৩০ বছরের বেশি বয়সী বিদেশি খেলোয়াড় এনে কী লাভ বলুন? বয়সটা দেখতে হবে। আর নিশ্চিত করতে হবে আপনার দেশের কতজন তরুণ এখানে সুযোগ পান।’

বাংলাদেশের হকিতে কোনো বদলই দেখছেন না?

১৯৯৫ সালে প্রথম আসার ২৭ বছর পরও বাংলাদেশের হকিতে কোনো পরিবর্তন দেখেন না শাহবাজ। তাই তো হতাশা নিয়ে বলেন, ‘সেই একই অবকাঠামো, একই প্রতিভা, একই পরিকল্পনায় চলছে বাংলাদেশের হকি...সবকিছু আছে আগের জায়গাতেই। বাংলাদেশের হকিতে অবকাঠামোগত কোনো উন্নতিই হয়নি। একটা মাত্র হকি স্টেডিয়াম, বিকেএসপি বাদে হকি টার্ফ নেই আর কোথাও। অথচ হকিতে উন্নতি করতে চাইলে আরও কয়েকটা টার্ফ লাগবে। তরুণদের খেলায় আকৃষ্ট করতে হবে।’

যোগ করেন, ‘আগে কামাল-সাদেক-হারুণদের মতো খেলোয়াড় ছিল। দারুণ একটা পরিবেশ ছিল তখন। ভারতের মুকেশ কুমাররা আসত খেলতে। সেই দিন গত হয়েছে। বাংলাদেশের হকি এগোতে পারেনি, কোনো বদল দেখছি না এখানকার হকিতে।’

বাংলাদেশের এগোয়নি বলে মনে করেন শাহবাজ
ছবি: আশরাফুল আলম

হকির জন্য বড় বাজেটের বিকল্পও দেখেন না এই কিংবদন্তি। পাকিস্তান থেকে কার যেন ফোন আসে, সেই ফোন ধরে তারপর নিজেই বলেন, ‘গত ২০-২২ বছরে হকির জন্য কানো অর্থ ঢালা হয়নি বাংলাদেশের হকিতে। এভাবে তো হবে না। হকি উন্নয়নে অর্থ লাগবেই। অর্থ ছাড়া কিছু হবে না। আমি দেখেছি, উপমহাদেশে হকিতে প্রকৃতিগত প্রতিভা আছে। বাঙালি ছেলেরাও প্রতিভাবান। কিন্তু তাদের খেলার সুযোগ কম। ফলে অভিজ্ঞতা হয় না ছেলেদের, বড় দলের সঙ্গে খেলা হয় না। যে কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে।’

বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের যেমন দেখছেন

খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস, ম্যাচ টেম্পারমেন্টের অভাব। এটা বাড়াতে হবে মনে করেন শাহবাজ, ‘ভালো কোচ, ভালো সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে এশিয়ার সেরা চারে আসা সম্ভব বাংলাদেশের পক্ষে। কারণ, তাদের সামর্থ্য আছে মালয়েশিয়াকে হারানোর, জাপান, চীনের মতো দলকে। ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে তারা এগিয়ে নয়, তবে ভালো ফাইট করতে পারে।’

প্রস্তাব পেলে লম্বা সময়ের জন্য বাংলাদেশের কোচ হতে অবশ্য রাজি নন শাহবাজ। তবে সংক্ষিপ্ত সময় পরামর্শক হতে আপত্তি নেই। বলেন, ‘বাংলাদেশের এমন কোচ দরকার, এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে যে মানিয়ে নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি কোচ হতে পারে বাংলাদেশে জন্য ভালো কোচ।’

পরামর্শ

বাংলাদেশকে এশিয়ান পর্যায়ে ইভেন্ট করতে হবে। ছেলেরা যাতে উজ্জীবিত হয়, কিছু শিখতে পারে। আসলে অনেক কিছুই করার আছে জানিয়ে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনকে দিলেন পরামর্শ, ‘আমি ফেডারেশনের সঙ্গে বসতে চাই। বসে তাদের এটাই বলব, হকি উন্নয়নে সরকারের সহায়তা চাইতে। সারা দেশে তো বটেই, ঢাকা শহরে ৩-৪ টার্ফ যেন করে দেয় সরকার। ছেলেদের জন্য বছরে অন্তত দুটি বিদেশ সফরের আয়োজন করতে হবে। সেটা কম খরচে মালয়েশিয়া ও চীনে হতে পারে। এটা না হলে ছেলেরা আগ্রহ হারাবে। এরপর ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে খেলতে হবে।’

উদাহরণ টানেন ক্রিকেটের, ‌‘ক্রিকেট বাংলাদেশ এখন পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলে। একইভাবে হকিতেও বড় বড় দেশের সঙ্গে খেলা চাই। এসবের কোনো বিকল্প নেই। তাহলেই ওরা তৈরি হবে ভালোভাবে।’ অথচ ২০১৮ সালে জাকার্ত এশিয়াডের পর ৪০ মাস আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেনি। এটাই বাস্তবতা।

হকির খেলোয়াড়দের উজ্জীবিত করতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন শাহবাজ
ছবি: আশরাফুল আলম

হকি খেলোয়াড়দের জন্য হোস্টেল , ডাইনিং, বিনোদন কক্ষ, টেবিল টেনিস থাকা দরকার মনে করেন শাহবাজ। যাতে অন্য শহর থেকে ছেলেরা ঢাকায় আসতে পারে, একটা হকিময় পরিবেশ তৈরি হয়। কিন্তু সত্যিটা হলো, বাংলাদেশের ঘরোয়া হকি লিগই নিয়মিত হয় না। প্রিমিয়ার লিগ, প্রথম বিভাগ হয় না ৪ বছর ধরে। এই অবস্থায় হকিময় পরিবেশ দূর কল্পনাই। তার ওপর রয়েছে সংগঠকদের অনিয়ম, দুর্নীতি।

কথায় কথায় শাহবাজ বলেন, ‘পাকিস্তানের কামার ইব্রাহিম বাংলাদেশ হকি দলের কোচ ছিল। সে গতকাল ফোন করে আমাকে বাংলাদেশের হকিতে সংগঠকদের অনিয়ম নিয়ে অনেক কথা বলেছে। সে বলেছে, সে যখন কোচ ছিল তখন দেখেছে সংগঠকেরা এখানে টাকা বানাতে চাইত। একটা জুসের দাম ১০০ টাকা হলে বলত ২০০ টাকা লিখতে। এটা শুনে তো আমি ভীষণ হতাশ হয়েছি।’

পাকিস্তান হকির অবস্থা

অন্তর্দ্বন্দ্ব আর দোষারোপের খেলায় জেরবার পাকিস্তানের হকি। কথাটা অকপটে বলেন শাহবাজ। ৩ বছর পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। সেই সময়টা নিয়ে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তখন অনেক সাবেক লেগে যায়। অনেকে আমাকে ঈর্ষা করে। ওরা চায় না আমি হকিতে থাকি। গত ২০ বছরে পাকিস্তান হকি যদি পিছিয়ে পড়ে থাকে, সেটা এ জন্যই। সাবেকেরা বলত, আমি হকির ভালো সংগঠক হতে পারব না। তবে পাকিস্তান সরকার আমার সহায়তা চায় এবং আমি সেটা দিই।’
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, ‘জার্মানি, হল্যান্ডে যখন কাজ করি হাজার শিশুকে অনুশীলন করাই। তারা আমার ভিডিও প্রচার করত। তারা বলত আমি হকির কিং। যখন হল্যান্ডের মতো দেশ অমাকে সম্মান দেয়, তখন বুঝতে হবে আমি কিছু করেছি। উপমহাদেশে ঈর্ষা আছে, বিভেদ আছে, এটাই আসলে সমস্যা।’

পাকিস্তান হকির গল্পও করলেন শাহবাজ
ছবি: আশরাফুল আলম

পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম হকির প্রতি আগ্রহী নয়। শাহবাজ দিলেন নিজের ঘরের উদাহরণ, ‘ইংল্যান্ডে পড়ুয়া আমার ২৬ আর ২১ বছর বয়সী দুই ছেলের হকির প্রতি কোনো আগ্রহ-ই নেই। হকি নিয়ে কিছু শুনতেও চায় না ওরা। ওরা হকি খেলা দেখে না। যখন আমার স্ত্রী তাদের বলে, ‘তোমরা কি জানো, তোমাদের বাবা কী ছিল?’ ওরা বলে, জানি। ব্যস, এটুকুই।’

তবে তাঁর বিশ্বাস, পাকিস্তানে এখনো প্রতিভা আছে। দরকার পরিচর্যা। একাডেমি করা যেতে পারে, বৃত্তি দেওয়া যেতে পারে ছেলেদের। একাডেমি করলে বিভিন্ন প্রদেশে তরুণদের আকৃষ্ট করা যাবে। সেটা করা না হলে হবে না। শাহবাজ বলেন, ‘এখন যে পাকিস্তান দল আছে, তাদের ফিটনেস নেই পুরোপুরি। স্কিল দুর্বল। দুই-তিন মাস আগে কমনওয়েলথ গেমসে আমি পাকিস্তানের পারফরম্যান্স দেখি, আমি দলের কোনো সৃষ্টশীলতা দেখিনি। ভালো খেলার কোনো তাড়া দেখলাম না কারও মধ্যে।’

হকির ম্যারাডোনা উপমা

১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিক, ১৯৯৪ সিডনি বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে চ্যাম্পিয়ন করেন শাহবাজ। ৮-১০টি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। প্রায় ১০ বছর বিশ্বসেরা ছিলেন। ‘হকির ম্যারাডোনা’ ‘কিং অব হকি’ ‘ম্যারাডোনা অব হকি’...এসব বিশেষণ দেখে ভালো লাগে তাঁর। বলেন, ‘ফুটবল বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় খেলা। মানুষ যখন ম্যারাডোনার সঙ্গে আমাকে তুলনা করে, সম্মানিত বোধ করি। ম্যারাডোনা ফুটবলে যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, সেটা আমি হকিতে পেয়েছি। স্ট্রিট বয় বলতে পারেন আমাকে। জন্মস্থান ফয়সালাবাদের রাস্তায় রাস্তায় খেলাধুলা করে হকির ম্যারাডোনা হয়েছি। এর চেয়ে গর্বের কিছু নেই। কিং অব হকি, ম্যারাডোনা অব হকি—এসব বিশেষণ দেখে ভালো লাগে।’

সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানান, ‘বিশ্বে এমন কোচ ছিল না, যে আমাকে হকি শিক্ষা দিতে পারে। আমার কোনো শারীরিক ট্রেইনার ছিলেন না, যে আমাকে শিক্ষা দিতে পারেন। হকি আমি প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভায় খেলেছি। আমি নিজে আমার সব দেখতাম। খেলা, আমার খাদ্যাভ্যাস, সব। আমি পত্রিকা, টিভি তেমন দেখতাম না। খেলার ওপর মনোযোগ রাখতাম সব সময়।’

তখন শাহবাজ অনেক বেশি প্রচারে ছিলেন। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট, ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট, হল্যান্ডে বিএমডব্লু ট্রফি ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট, ভারতে ইন্দিরা গান্ধী টুর্নামেন্ট ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। কিন্তু আজ ক্রিকেট দেখুন বাবর আজম ম্যান অব দ্য ম্যাচ, কাল শাহীন আফ্রিদি ম্যান অব দ্য ম্যাচ পরশু বিরাট কোহলি। তখন শাহবাজই বারবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হতেন। শাহবাজ বলেন, ‘বিশ্বকাপ, এশিয়ান গেমস, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, সেরা হতাম। সেরা হওয়া ছিল আমার অভ্যাস।’

স্মরণীয় ম্যাচ

১৯৯০ সালে লাহোর বিশ্বকাপে সেরা নৈপুণ্য দেখান তিনি। যদিও পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি, তবে শাহবাজ দুর্দান্ত খেলেন। পেছন ফিরে বলেন, ‘১৯৯৪ সালে সিডনি বিশ্বকাপে আমি ভালো খেলি। টুর্নামেন্টে সেরা খেলোয়াড় হই। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের অনেক মানুষ আমার কাছে আসে, ওরা বলত, তুমিই একমাত্র লোক যে জানে হকিটা কীভাবে খেলে। সেসব প্রশংসা কখনো ভুলব না। সেবার গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়াকে আমরা হারিয়েছিলাম। হল্যান্ডকে ফাইনালে হারাই। এটা ছিল দুর্দান্ত ম্যাচ। মানুষ উপভোগ করে।’

তাঁর স্মরণীয় গোল ১৯৮৬ সিউল এশিয়ান গেমসে। ভারতের সঙ্গে মাঝমাঠ থেকে এককভাবে বল নিয়ে গোল সাপের মতো এঁকেবেঁকে গোল করে বেরিয়ে আসেন। তখন তিনি ১৮ বছরের তরুণ।

হকি কেন জনপ্রিয় হচ্ছে না

হকি এখনো আধা পেশাদারি খেলা হিসেবেই রয়ে গেছে। এ কথা বলে শাহবাজ যোগ করেন, ‘ক্রিকেট একটা শিল্প এখন। দুই বছর ক্রিকেট খেললে আপনি গাড়ি, বাড়ি করতে পারবেন। অথচ দেখুন ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপ খেলার পর আমাকে পাকিস্তান হকি ফেডারেশন মাত্র ২ হাজার টাকা দেয়। যে কারণে তরুণেরা হকির প্রতি আগ্রহী হচ্ছে না। হকির সরঞ্জামের অনেক দাম। আগামী ২০ বছরেও এই অবস্থার বদল হবে না। অবস্থা আরও খারাপ হবে।’

ইউরোপের খেলোয়াড়েরা শিক্ষিত। উপমহাদেশে কম শিক্ষিত। ফলে আপনি ম্যাচ পরিকল্পনা ভালোভাবে বুঝবেন না বলেন শাহবাজ। তবে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের উত্তাপ আগের মতোই আছে মনে করেন শাহবাজ, ‘এই জায়গায় বদল আসেনি। ভারত-পাকিস্তান হকি ম্যাচ মানে এখনো যুদ্ধ, যুদ্ধ ভাব। ভারতে হকির বাজেট লাল লাখ ডলার। ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, হকির উন্নয়নে সব করবেন। পাকিস্তানে এটা নেই। স্কুল থেকে খেলাটা সরে গেছে। দুটি জাতিই ক্রিকেট নিয়েই আসলে ব্যস্ত।’

হকিকে এখনো পুরোপুরি পেশাদার খেলার পর্যায়ে দেখেন না শাহবাজ
ছবি: আশরাফুল আলম

চোখ ফেরান বাইরের দুনিয়ায়। বলেন, আর্জেন্টিনা ৫-৬ হাজার খেলোয়াড় আছে, দেশটি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বেলজিয়াম ১০-১২ বছর আগে কিছুই ছিল না। তারা অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন, বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাদের অবকাঠামো, ক্লাব সবই হয়েছে হকির কল্যাণে। হল্যান্ড সব সময় সেরা চারে থাকে। সেখানে শাহবাজ ৪ বছর খেলেন। হল্যান্ডে জনপ্রিয়তায় ফুটবলেরও আগে হকি। জার্মানিতে ফুটবল এক নম্বর, তবে অনেক ছেলেমেয়ে হকি খেলে। পোল্যান্ডে খেলে। অস্ট্রেলিয়ার হকি নিয়ে দারুণ পরিকল্পনা আছে। কিন্তু হকি আজও পেশাদার খেলা হতে পারল না।

শূন্য থেকে শিখরে

দীর্ঘ প্রায় এক ঘণ্টার কথোপকথনের শেষ দিকে শাহবাজ রেস্টুরেস্ট থেকে রুমে আসেন। রুমে ঢুকতে ঢুকতে ফিরে তাকান নিজের ছোটবেলায়। তিনি বলেন, তাঁর বাবা চৌধুরী মোহাম্মদ হোসেন ছিলেন নিম্ন আয়ের মানুষ। একটা সেলুন ছিল তাঁর। ছিল একটা বইয়ের দোকান। একসময় ছোট গাড়ি চালিয়ে রোজগার করতেন তিনি। ৬ ছেলে ৪ মেয়ে নিয়ে বিশাল সংসার, যা চালাতে হিমশিম খেতেন মানুষটা। ছোটবেলায় খেলে বাসায় গেলে শাহবাজ খাবার পেতেন না ঠিকমতো। সেই সময় নিয়ে বলেন, হয়তো ছিম–আলু দিয়ে ভাত খেয়ে নিতাম। অনেক কষ্ট করেছি, যা বলার মতো নয়। সংসারে অভাব ছিল। আমি তখন ফুটবল-ক্রিকেট যা-ই খেলতাম, সেরা ছিলাম। ১৪-১৫ বছর বয়সে হকিতে আসি। তখন আমার নাম ছড়িয়ে পড়ে হকিতে। ঘাসের মাঠে আমি অনায়াসে ৪-৫ জনকে সহজে কাটিয়ে দিতাম। এখন আমি আমার পুরোনো দিনের ভিডিও দেখলে বিস্মিত হই।’

অবসরে স্নুকার ও স্কোয়াশ খেলেন শাহবাজ
ছবি: আশরাফুল আলম

ভালো লাগা

লিওনেল মেসিকে ভালো লাগে তাঁর। ভিভ রিচার্ডসের খেলা দেখতেন। অবসরে স্নুকার, স্কোয়াশ খেলেন। এটা তাঁর শখ। হেসে বলেন, দিনে ৩-৪ ঘণ্টা পাকিস্তানি টিভি সিরিয়াল দেখতে নাকি তাঁর ভালো লাগে। আর ঢাকায় এলে প্রতিদিন ডাব খেতে ভালো লাগে। এখানে এলে পেঁপে খান। কাঁঠাল খেতে চান। নিজেই বলেন, ‘১৯৯৫ সালে যখন প্রথম আসি ঢাকায় তখন প্রতিদিন আমার ফ্রিজে নারকেলের পানি থাকত। এটা ভালো লাগত। সব বাঙালি খাবার খাই।’

কী করছেন এখন

পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস পিআইএতে চাকরি করছেন ৩৬ বছর ধরে, বর্তমানে উপব্যবস্থাপক। গত কয়েক বছরে হকির সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না। এখন আবার আগ্রহ পাচ্ছেন বলে ঢাকায় এসেছেন। তাঁর দুই ছেলে এবং বিয়ে হয়ে যাওয়া একমাত্র মেয়ে ইংল্যান্ডে থাকে। বছরে কয়েকবার ছেলেমেয়েদের কাছে যান। কিন্তু তাঁর দুঃখ, তাঁর সন্তানেরাও হকির কথা শুনতে চায় না, যে হকির ফেরিওয়ালা তিনি।