সাঁতারু থেকে মন্ত্রী, এখন তিনি বৈশ্বিক ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে ক্ষমতাধর

ক্রিস্টি কভেন্ট্রি যখন অলিম্পিক পদকজয়ী।এএফপি

সুইমিংওয়ার্ল্ড যুক্তরাষ্ট্রের ত্রৈমাসিক সাময়িকী। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ক্রিস্টি কভেন্ট্রিকে নিয়ে একটি লেখা ছাপা হয়েছিল। সেটি আগের বছর এথেন্স অলিম্পিকে তাঁর সাফল্যের প্রেক্ষিতে। সেই লেখার শেষে কভেন্ট্রিকে নিয়ে ছোট্ট তথ্যপঞ্জিও ছিল। যেখানে জীবন নিয়ে নিজের গোপন পরিকল্পনায় কভেন্ট্রি বলেছেন, ‘নিজের একটি রেস্টুরেন্ট খুলতে চাই।’

কভেন্ট্রির নিজস্ব ওয়েবসাইটে তাঁর বিষয়ে ঘাঁটতে গিয়ে একটি তথ্য জেনে অবাক লাগতে পারে। ৯ বছর বয়সে মা–বাবাকে বলেছিলেন, অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং সোনা জিতবেন। ৯ বছর বয়স মানে ১৯৯২ সাল—এর ঠিক এক যুগ পর ২০০৪ সালে এথেন্স অলিম্পিকে যে মেয়েটি সাঁতারে সোনা, রুপা ও ব্রোঞ্জ জিতলেন, তাঁর জীবন নিয়ে ইচ্ছার ব্যাপ্তি তো আরও বড় হওয়ার কথা! কভেন্ট্রি জিম্বাবুয়ের হয়ে সাঁতারে প্রথম অলিম্পিক সোনাজয়ী। ভবিষ্যৎও ছিল উজ্জ্বল।

একটি রেস্টুরেন্ট খুলতে চাওয়ার ইচ্ছাটা এমন একজন অ্যাথলেটের সঙ্গে কতটা মানানসই?

হ্যাঁ, ব্যক্তিগত ইচ্ছার জায়গা থেকে দেখলে এই বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। কভেন্ট্রির সাঁতারু হয়ে ওঠা যেখানে, যুক্তরাষ্ট্রের সেই অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হোটেল ও রেস্টুরেন্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়কে মেজর করে তাঁর ডিগ্রি নেওয়া আছে। ব্যবসায় নিয়েছেন মাইনর ডিগ্রি। এটুকু বিচারে ওই ইচ্ছাটা ঠিকই আছে। কিন্তু সোনাজয়ী একজন অলিম্পিয়ানের জীবন নিয়ে পরিকল্পনায় রেস্টুরেন্ট ব্যবসা থাকবে, এটা একটু ব্যতিক্রমই বটে!

কিংবা কভেন্ট্রি তখন সেই ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন হয়তো পরিস্থিতির কারণে। জিম্বাবুয়ের সাবেক স্বৈরাচারী শাসক রবার্ট মুগাবে ২০০১ সালে শ্বেতাঙ্গদের দখলে থাকা কৃষি–ফার্মগুলোকে ‘প্রত্যাবাসন’ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সরকারি লোকজন হাজারো শ্বেতাঙ্গের কৃষিজমি কেড়ে নিয়েছে সে সময়। সাদাদের ওপর কালোদের অত্যাচারের মাত্রাও বাড়ছিল।

সে পরিস্থিতিতে শ্বেতাঙ্গ রক্তের কভেন্ট্রি যতই দেশকে অলিম্পিকের সোনা এনে দিন না কেন, নিজেকে নিয়ে তাঁর স্বপ্নটা বড় হওয়ার কথা নয়। হ্যাঁ, অন্য দেশে গিয়ে হয়তো পারতেন। কিন্তু সাময়িকীর সে লেখাতেই কভেন্ট্রি বলেছিলেন, ‘জিম্বাবুয়ে আমার ঘর। ওখানে আমার জন্ম। ওটাই আমার সংস্কৃতি। আমি সব সময় জিম্বাবুয়ের প্রতিনিধিত্বই করব। গায়ের রং আমার কাছে কোনো বিষয় না।’

ক্রিস্টি কভেন্ট্রি যখন বেইজিং অলিম্পিকের পুলে।
এএফপি

কভেন্ট্রির মতো গায়ের রংকে পাত্তা না দিয়ে শুধু জিম্বাবুয়ে নিয়ে তখন অনেক কৃঞ্চাঙ্গও ভেবেছিলেন। সে সময় দেশটির হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডগুলোয় প্রচুর কৃঞ্চাঙ্গ শিশুর নাম রাখা হয়েছিল ক্রিস্টি কভেন্ট্রির নামে। তাদের মধ্যে প্রথম দুটি শিশুর নাম ছিল ক্রিস্টি কভেন্ট্রি মাপুরিসা ও ক্রিস্টি কভেন্ট্রি মাবাম্বা।

শ্বেতাঙ্গ কভেন্ট্রির এথেন্স অলিম্পিকে পাওয়া সাফল্যকে জিম্বাবুয়ের কৃঞ্চাঙ্গরা কতটা আপন করে নিয়েছিল, সেসব বোঝা যায় তাঁর তিনটি পদক জয়ের পর দেশটিতে সদ্যোজত শিশুদের নামে সাঁতারের বিভিন্ন ‘টার্ম’ সংযোজনে—থ্রিমেডালস চিনোতিম্বা, সুইমিংপুল নাহাঙ্গা, ফ্রিস্টাইল জুজি, ব্রেস্টস্ট্রোক মুসেনদামে, বাটারফ্লাই মাসোচা, ব্যাকস্ট্রোক বান্দা, গোল্ডমেডেল জুলু, গোল্ড সিলভার ব্রোঞ্জ এনদোলোভু!

কভেন্ট্রির নামে শিশুর নাম রাখার সেই স্রোত কি এখন আবার শুরু হবে জিম্বাবুয়েতে? যে মেয়েটি ৯ বছর বয়সে মা–বাবার কাছে অলিম্পিকে সোনা জয়ের প্রতিজ্ঞা করে এবং পরে সেটা পূরণও করে রেস্টুরেন্ট ব্যবসাকে ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হিসেবে দেখেছিল, সেই মেয়েটিই যখন চল্লিশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি হয়ে যান, তখন ব্যাপারটির গভীরতা মোটেই অল্প নয়। গতকাল আইওসি সভাপতি হওয়ার পর কভেন্ট্রির কথাতেই মিলিয়ে নিতে পারেন, ‘বিস্ময়কর মুহূর্ত। ৯ বছর বয়সে কখনোই ভাবিনি একদিন এখানে এসে দাঁড়াব।’

আইওসির দশম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন ক্রিস্টি কভেন্ট্রি।
রয়টার্স

কিন্তু মানুষ দাঁড়ায়। বারবার হোঁচট খেয়েও নিজ কর্মগুণে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে চলে ঈপ্সিত গন্তব্যপানে। সেই পথের মোড়ে কভেন্ট্রির জন্য যে এমন উপহার থাকবে, সেটা কে ভাবতে পেরেছিল! হ্যাঁ, বিদায়ী সভাপতি টমাস বাখ নিজে তাঁর জন্য প্রচারণা চালিয়েছেন। আইওসির এক সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, বিদায়ী সভাপতি বাখের পছন্দের প্রার্থী ছিলেন কভেন্ট্রি। তা না হয় ছিলেন, কিন্তু ছয়জন পুরুষ প্রার্থীকে হারিয়ে একজন নারী যখন আন্তর্জাতিক ক্রীড়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর সংস্থাটির সভাপতি হন, তখন নতুন সব ঐতিহাসিক পাতা যোগ হওয়াই স্বাভাবিক।

পাতাগুলোর শিরোনাম একবার পড়ুন—আইওসির ১৩১ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী সভাপতি। প্রথম আফ্রিকানও। আধুনিক অলিম্পিকের জনক ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিনের পর আইওসির ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সভাপতিও। কুবার্তিন ১৮৯৪ সালে আইওসি গঠনের দুই বছর পর ৩৩ বছর বয়সে সভাপতির দায়িত্ব নেন। কভেন্ট্রি নিলেন ৪১ বছর বয়সে। কুবার্তিনের গড়া সেই আইওসি এত দিনে যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, কভেন্ট্রি সেখানে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হওয়ার পর বিশ্বজোড়া

সংবাদমাধ্যমগুলোর বেশির ভাগই তাঁর নতুন দায়িত্ব নিয়ে একটি কথা লিখেছে, ‘খেলাধুলা পরিচালনায় সবচেয়ে শক্তিশালী পদ।’ কেউ আবার লিখেছে, ‘বৈশ্বিক খেলাধুলার সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি।’

আইওসিতে টমাস বাখের (ডানে) স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন ক্রিস্টি কভেন্ট্রি (বাঁয়ে)।
রয়টার্স

কিন্তু কভেন্ট্রি এক সময় ক্ষমতার ধারেকাছেও ছিলেন না। তিনি ছিলেন জলের মানুষ। ১৭ বছর বয়সে সিডনি গেমস দিয়ে তাঁর অলিম্পিক ক্যারিয়ার শুরু। তখনো হাইস্কুল পড়ুয়া। জিম্বাবুয়ের প্রথম সাঁতারু হিসেবে পৌঁছেছিলেন অলিম্পিকের সেমিফাইনালে। জিম্বাবুয়ের বছরের সেরা নারী ক্রীড়াবিদও হন সেবার। চার বছর পর এথেন্স অলিম্পিকের ২০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে জেতেন সোনা। ১০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে রুপা ও ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলিতে ব্রোঞ্জ।

চার বছর পর বেইজিং অলিম্পিকের ২০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে বিশ্বরেকর্ড গড়ে সোনা ধরে রাখার পাশাপাশি তিনটি রুপা জেতেন যথাক্রমে ১০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক, ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলি ও ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলিতে।

অর্থাৎ অলিম্পিকে মোট ৭টি পদক জেতেন, এর মধ্যে দুটি সোনা, চারটি রুপা ও একটি ব্রোঞ্জ। আফ্রিকার সবচেয়ে সফল নারী অলিম্পিয়ান কভেন্ট্রি—অলিম্পিকে জিম্বাবুয়ের জেতা আটটি পদকের সাতটিই তাঁর। কভেন্ট্রির ওয়েবসাইটে অবশ্য আরও একটি কথা লেখা আছে, ‘ইতিহাসের যেকোনো নারী সাঁতারুর চেয়ে অলিম্পিকে বেশি ব্যক্তিগত পদক জিতেছেন ক্রিস্টি।’

বেইজিং অলিম্পিকে পদকজয়ের পর ক্রিস্টি কভেন্ট্রিকে আজীবনের জন্য কূটনৈতিক পাসপোর্ট দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে সরকার।

প্রয়াত রবার্ট মুগাবে পর্যন্ত অলিম্পিকে কভেন্ট্রির সাফল্যের জন্য তাঁকে ‘সোনার মেয়ে’ বলেছিলেন। যদিও অনেকে মনে করেন, মুগাবে জিম্বাবুয়ের শাসক থাকতে কভেন্ট্রির অলিম্পিকে সোনা জয় অনেকটাই ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিকে অ্যাডলফ হিটলারের সামনে জেসি ওয়েন্সের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর মতো। জিম্বাবুয়ের প্রচণ্ড আর্থিক মন্দার মধ্যেও ২০০৮ অলিম্পিকের পর কভেন্ট্রিকে ব্যক্তিগতভাবে ১ লাখ ডলার দিয়েছিলেন মুগাবে। তখন সারা জীবনের জন্য কূটনৈতিক পাসপোর্টও পেয়েছিলেন কভেন্ট্রি। ২০১২ ও ২০১৬ অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার পর সাঁতারের পুল থেকে অবসর নেন কভেন্ট্রি।

কিন্তু কভেন্ট্রির যাত্রা সেখানেই থামেনি। ২০১৭ সালের অভ্যুত্থানে মুগাবে সরকার উৎখাত হওয়ার পর নিজের ৩৫তম জন্মদিনের আট দিন আগে জিম্বাবুয়ের যুব, ক্রীড়া, শিল্পকলা ও বিনোদন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন কভেন্ট্রি। ২০২৩ সালে জিম্বাবুয়েতে বিতর্কিত নির্বাচনের পর আবারও একই দায়িত্ব পান এবং এখনো সে দায়িত্বেই আছেন।

রাজনৈতিক কূটচাল ও নির্মমতার জন্য ‘দ্য ক্রোকোডাইল’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া প্রধানমন্ত্রী এমেরসন মানানগাগওয়ার অধীনে কভেন্ট্রি মন্ত্রী হওয়ার পর তাঁকে ঘিরে বেশ কিছু বিতর্কও হয়েছে।

ক্রিস্টি কভেন্ট্রি আগামী আট বছর আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন।
এএফপি

ভালো স্টেডিয়াম তৈরি করতে না পারায় ২০২০ সালে আফ্রিকান ফুটবল কনফেডারেশন জিম্বাবুয়েকে আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ আয়োজনে নিষিদ্ধ করে। ২০২২ সালে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগে জিম্বাবুয়েকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিষিদ্ধও করেছিল ফিফা। পরের বছর অবশ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। জিম্বাবুয়েতে অন্যান্য খেলায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করতে না পারার জন্যও সমালোচিত হয়েছেন কভেন্ট্রি।

মন্ত্রী কভেন্ট্রি সমালোচিত হলেও সাঁতারু কভেন্ট্রি আইওসিতে সব সময়ই সুনজরে ছিলেন। ২০১৩ সালে আইওসির সদস্য হন। এক বছর আগে লন্ডন অলিম্পিকে অ্যাথলেট নির্বাচনের ফল পাল্টানো হয়েছিল কভেন্ট্রি তাঁর এক প্রতিদ্বন্দ্বির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর। এরপর আইওসি সদস্য হন কভেন্ট্রি। তারপর ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলেন একদম চূড়ায়। কোথায়? গ্রিসে, যেখানে তাঁর প্রথম অলিম্পিক সোনা জয়! যেখান থেকে শুরু অলিম্পিকেরও।

আরও পড়ুন