তালেবানের আফগানিস্তানে নিষিদ্ধ জাকিয়ার পদক জয়ের স্বপ্ন

আফগান তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড় জাকিয়া খুদাদাদিইনস্টাগ্রাম

জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে জাকিয়া খুদাদাদিকে। সব বাধাবিপত্তি পেরিয়েই ২০২০ টোকিও প্যারালিম্পিকে ইতিহাস গড়েন জাকিয়া। তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের প্রথম নারী ক্রীড়াবিদ হিসেবে আন্তর্জাতিক কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেন তিনি। যদিও ২৫ বছর বয়সী এই তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড়ের প্যারালিম্পিকে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা একরকম শেষ হয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন

২০ বছর যুদ্ধের পর মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী নিজেদের সরিয়ে নিলে ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের দখল নেয় তালেবান। তালেবানের উত্থানের পর নিজ দেশে একরকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন জাকিয়া। দেশটিতে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তালেবানরাও আফগান নারীদের খেলাধুলায় নিষেধাজ্ঞা দিতে তোড়জোড় শুরু করে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই জাকিয়া কোনো রকমে দেশ ত্যাগ করেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুরোধের পর আফগানিস্তানের হয়ে টোকিও প্যারালিম্পিকে খেলার সুযোগ পান।

১১ আগস্ট শেষ হচ্ছে প্যারিস অলিম্পিক। সপ্তাহ দুয়েক পর ২৮ আগস্ট শুরু হবে প্যারিস প্যারালিম্পিক। এ প্রতিযোগিতায় শরণার্থী দলের হয়ে খেলবেন জাকিয়া। তবে তাঁর লড়াই হবে আফগান নারীদের জন্য, যাঁরা গত তিন বছরে ধীরে ধীরে অধিকার বঞ্চিত হয়েছেন। প্যারিসে পরশু অনুশীলন করার ফাঁকে বার্তা সংস্থা এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন।

জাকিয়া বলেছেন, ‘এটা আমার জন্য কঠিন। কারণ, আমি আমার দেশের পতাকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সব আফগান নারীকে (খেলাধুলায়) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই সেই সম্ভাবনা শেষ। এবার আমি প্যারিসে তাঁদের জন্য একটি পদক জিততে চাই। আমি আফগানিস্তানের সব নারীকে শক্তি দেখাতে চাই।’

আরও পড়ুন

তালেবান সরকার মেয়েদের খেলাধুলাকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় আফগানিস্তানের পতাকা নিয়ে খেলতে পারছেন না জাকিয়া। একই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হচ্ছে কিমিয়া ইউসুফিকেও। তালেবানের আগের শাসনামালে কিমিয়ার মা–বাবা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে ইরানে চলে যান। সেখানেই তাঁর জন্ম হয়। ২৮ বছর বয়সী এই স্প্রিন্টারও প্যারিস অলিম্পিকে আফগানিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু অনুমতি পাননি। এপিকে তিনি বলেছেন, ‘আমি আফগান মেয়েদের কণ্ঠস্বর হতে চেয়েছিলাম।’

জাকিয়া জানান, ১১ বছর বয়সে তায়কোয়ান্দোতে তাঁর হাতেখড়ি। জন্মস্থান আফগানিস্তানের হেরাতে তখন থেকেই গোপনে অনুশীলন করে গেছেন। পরিবারের সমর্থন তাঁকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁর লড়াইকে আরও জটিল করে তোলে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’–এর মতে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রায়ই আফগান সমাজ থেকে দূরে রাখা হয় এবং অবরুদ্ধ করা হয়। প্রতিবন্ধী নারীরাই বেশি ভুক্তভোগী।

আফগানিস্তানের পতাকা নিয়ে খেলতে পারছেন না জাকিয়া
ইনস্টাগ্রাম

একটি বাহু ছাড়াই জন্ম নেওয়া জাকিয়া তাই এক হাত লুকিয়ে রেখেই বড় হয়েছেন। তায়কোয়ান্দো খেলতে শুরু করার পর ধীরে ধীরে সবাই এটি জানতে পারে, ‘খেলাধুলা শুরু করার আগে (হাত ঢেকে রেখে) নিজেকে অনেকবার রক্ষা করেছি। কিন্তু ধীরে ধীরে...আমি আমার বাহু দেখাতে শুরু করি। তবে এটা শুধু ক্লাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময়।’

আরও পড়ুন

এই তায়কোয়ান্দোই জাকিয়ার জীবন বদলে দেয়, স্বাধীনতার পাথেয় হয়ে ওঠে। তিনি বুঝতে পারেন, একটি হাত না থাকা মানেই অক্ষমতা নয়। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রথম পদক জয়ের পর বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন জাকিয়া।

তবে ২০২১ সালের আগস্টে নাটকীয়ভাবে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদল হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়ে নিলে ক্ষমতা দখল করে তালেবান। প্যারালিম্পিকে অংশ নেওয়ার অপেক্ষায় থাকা জাকিয়া এরপর রাজধানী কাবুলে আটকা পড়েন।

স্বপ্নকে প্রতিনিয়ত তাড়া করছেন জাকিয়া
ইনস্টাগ্রাম

আফগানিস্তানের বেগতিক পরিস্থিতি দেখে আন্তর্জাতিক প্যারালিম্পিক কমিটি ঘোষণা দেয়, দেশটির প্যারা অ্যাথলেটরা টোকিও প্যারালিম্পিকে অংশ নেবেন না। উপায় না দেখে জাকিয়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেই আকুতিতে সাড়া দিয়ে টোকিও প্যারালিম্পিকে তাঁর অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম আফগান নারী প্যারালিম্পিয়ান বনে যান জাকিয়া।

আফগানিস্তান ছেড়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আশ্রয় নেন জাকিয়া। প্যারিস প্যারালিম্পিক তাই তাঁকে ঘরের আমেজই দেওয়ার কথা। তবে জাকিয়া এপিকে জানিয়েছেন, সংস্কৃতির এই মিশ্রণের সঙ্গে তিনি অভ্যস্ত হতে পারেননি। এ সংস্কৃতি তাঁর দেশকে ফুটিয়ে তোলে না। তাঁর আশা আফগানিস্তানে আবারও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, তিনি দেশে ফিরতে পারবেন, ‘আমার বিশ্বাস একদিন আফগানিস্তানে ফিরে যেতে পারব। স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণভাবে একসঙ্গে জীবন যাপন করতে পারব।’