প্যারিসে এসে কোনো পর্যটক যদি একটা ছবিই তোলেন, বলুন তো, তা কী হবে? উত্তরটা সবাই জানেন বলেই অনুমান করি। প্রায় সোয়া শতাব্দী ধরে আকাশে উঠে যাওয়া ওই স্তম্ভটাই তো প্যারিসের প্রতীক হয়ে আছে। ছবিতে আইফেল টাওয়ার না থাকলে কীভাবে বোঝাবেন যে আপনি প্যারিসে এসেছিলেন! একটামাত্র ছবি তুললেও এটাই তো তুলতে হবে।
এই অলিম্পিকে বিচ ভলিবল খেলোয়াড়দের অনেকেই প্রথমবারের মতো প্যারিসে এসেছেন। আইফেল টাওয়ারকে পেছনে রেখে একটা ছবি নিশ্চয়ই তাঁরা সংগ্রহে রাখতে চাইবেন। সেই ছবি যে নিজেকেই তুলতে হবে, এমন নয়। অলিম্পিক কাভার করছেন এত এত ফটোসাংবাদিক। বিচ ভলিবলে অন্তত একবার উঁকি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছেন না বলতে গেলে তাঁদের কেউই। সেই ফটোসাংবাদিকদের কারও কাছে চেয়ে নিলেই হয়ে যাচ্ছে।
অন্য খেলার প্রতিযোগীরা বিচ ভলিবল খেলোয়াড়দের হয়তো একটু ঈর্ষাই করছেন। আইফেল টাওয়ারের নিচে খেলছেন—এই ছবি তো শুধু ৯৬ জন বিচ ভলিবল খেলোয়াড় ছাড়া আর কারও তোলার সুযোগ নেই। বিচ ভলিবল খেলা হয় জোড়া বেঁধে। ৯৬ জন থেকেই আপনি তাই হিসাব করে নিতে পারবেন দলের সংখ্যা। পুরুষ ও মহিলা বিভাগে ২৪-২৪ মোট ৪৮ দল। প্রতি বিভাগের সেই ২৪ দল যে ২৪টি দেশ থেকেই হতে হবে, এমন নয়। এক দেশ থেকে একাধিক দলও থাকতে পারে। কোয়ালিফাই করার ব্যাপারটি ঠিক হয় র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে।
দুই বিভাগেই নকআউট পর্যায়ের জোড়াগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলেরই শুধু একাধিক দল আছে। সেটাই স্বাভাবিক। বিচ ভলিবল এই দুই দেশের তীব্র দ্বৈরথেরই গল্প। সেই প্রসঙ্গ পরে। আগে আইফেল টাওয়ারের নিচে ভলিবল দেখার অভিজ্ঞতাটা বলে নিই। খেলার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে খেলোয়াড়েরা যা বলছেন, তাতে একটা সুর অভিন্ন থাকছে। আইফেল টাওয়ারের নিচে ভলিবল খেলছেন, এটা বিশ্বাস হচ্ছে না।
দেখার অভিজ্ঞতা নিয়েও একই কথা বলতে হয়। টিকিট কেটে ঢুকতে হয়, বিশ্বজুড়ে এমন যত মনুমেন্ট আছে, সেগুলোর মধ্যে দর্শনার্থীর সংখ্যায় আইফেল টাওয়ার ১ নম্বরে। সেই আইফেল টাওয়ার সামনে রেখে খেলা দেখাটা তো বাকি জীবন গল্প করার মতোই। বিচ ভলিবলের জন্য বানানো অস্থায়ী আইফেল টাওয়ার স্টেডিয়ামের মিডিয়া ট্রিবিউনটা বানানো হয়েছে ঠিক উল্টো দিকে। যেখানে বসে সামনে তাকালেই আইফেল টাওয়ার। যেটি সুন্দরতম রূপে দেখা দেয় সন্ধ্যা নামার পর। নানা রঙের আলোতে যখন তা ঝিকমিক করতে থাকে।
গ্রীষ্মের প্যারিসে ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দিনের আলো থাকে। সেই আলো থাকতে থাকতেই পরশু আইফেল টাওয়ার স্টেডিয়ামে। যেখানে বসে দেখছি লাল আর হলুদ রঙের লিফট আইফেল টাওয়ারে উঠছে-নামছে। সেই লিফটে করে একেবারে চূড়ায় চলে যাওয়া যায়। যেখানে দাঁড়ালে পুরো প্যারিস শহরটা চোখের সামনে। গুস্তাফো আইফেল বানানোর সময় এই টাওয়ারের উচ্চতা ছিল ৩০০ মিটার। মাথায় রেডিও আর টেলিভিশনের অ্যানটেনা যোগ করায় ২০২২ সালের মার্চে যা বেড়ে হয় ৩৩০ মিটার। ১০৮৩ ফুট বললে উচ্চতাটা বুঝতে সহায়ক হতে পারে। আরও সহজভাবে বোঝাতে, একটা ৮১ তলা ভবনের সমান। অনেক দর্শকের ওই এত উঁচু থেকে বিচ ভলিবল দেখার অভিজ্ঞতাও হয়ে যাচ্ছে এই অলিম্পিকে।
১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিকে পদকের খেলা হিসেবে অভিষেকের পর থেকেই বিচ ভলিবল অলিম্পিকের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাগুলোর একটি। খেলাটার চেয়ে যেটির বড় কারণ আবহ। চিৎকার-চেঁচামেচি-হইচই...যেন কোনো পার্টি চলছে। গান-বাজনার তালে তালে কখনো দর্শক গ্যালারিকে কখনো হাত তুলে নাচতে বলা হচ্ছে, কখনোবা কোনো আওয়াজ করতে।
নামে বিচ ভলিবল হলেও মাত্র দুটি অলিম্পিকেই বিচ ভলিবল হয়েছে সত্যিকার বিচে। ২০০০ সালে সিডনির বন্ডাই আর ২০১৬-তে রিওর কোপাকাবানায়। তারপরও সিডনি-রিও মনে হয় প্যারিসের কাছে হেরে যাচ্ছে আইফেল টাওয়ারের কারণেই। বিচ ভলিবলের চেয়েও হয়তো ভেন্যুর টানেই গ্যালারিতে কোনো না কোনো তারকা থাকছেনই। খেলার জগতের লেব্রন জেমস, নোভাক জোকোভিচ, জিনেদিন জিদান, টম ব্র্যাডি, ইগা সুয়াটেককে দেখা গেছে। র্যাপার স্নুপ ডগ ও ফারেল উইলিয়ামসকেও। ডেনমার্কের রানি মেরি-ও ঘুরে এসেছেন একদিন। পরশু রাতে ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো ছিলেন দর্শকসারিতে। বেরোনোর সময় দেখা হয়ে গেল প্যারিস সেন্ট–জার্মেইয়ের মালিক নাসের আল খেলাইফির সঙ্গে।
ও হ্যাঁ, বিচ ভলিবলে যুক্তরাষ্ট্র আর ব্রাজিলের দ্বৈরথের কথা বলছিলাম। সোনার সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র অনেক এগিয়ে থাকলেও ফাইনাল খেলায় ব্রাজিল প্রায় সমানে সমান। তিন বছর আগে টোকিও অলিম্পিকেই বিচ ভলিবল এই দুই দেশের একটিকেও ছাড়া প্রথম ফাইনাল দেখেছে। অলিম্পিকে পদক জেতার জন্য বাড়তি কোনো প্রেরণা লাগে না। পদকটাই যথেষ্ট। তবে এবার মনে হয় বিচ ভলিবলে আরেকটি জিনিস যোগ হয়েছে। গলায় অলিম্পিক পদক, পেছনে আইফেল টাওয়ার—এমন একটা ছবি কার না স্বপ্ন, বলুন!