‘আগেরবার আব্বু বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবার আর নেই’

দাবা অলিম্পিয়াডে জায়গা করে নিয়েও মন ভালো নেই তাহসিন তাজওয়ারের। মায়ের সঙ্গে থাকা তাহসিনকে দেখেই সেটা স্পষ্ট। কদিন আগেই জাতীয় দাবায় খেলতে খেলতে মারা যান তাহসিনের বাবা গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানপ্রথম আলো

তাহসিন দ্বিতীয় প্লে-অফ ম্যাচটা ড্র করেছে...শুনেই আলহামদুলিল্লাহ বললেন পাশের রুমে বসা তাঁর মা তাসমিন সুলতানা। দ্বিতীয় ম্যাচে চাপের মুখে থেকেও এই ড্রয়ে নিশ্চিত হলো ফিদে মাস্টার তাহসিন তাজওয়ারের দাবা অলিম্পিয়াডে খেলা। আগামী সেপ্টেম্বরে হাঙ্গেরিতে হচ্ছে ৪৫তম দাবা অলিম্পিয়াড।

বাংলাদেশ দাবা দলে পঞ্চম ও সর্বশেষ খেলোয়াড় হিসেবে অলিম্পিয়াডে খেলার সুযোগ পেতে তাহসিন আজ প্লে–অফে নামেন রেটেড খেলোয়াড় অনত চৌধুরীর সঙ্গে। বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনে আয়োজিত প্লে–অফের প্রথম ম্যাচটা কালো নিয়ে জেতেন ১৮ বছর বয়সী তাহসিন। দ্বিতীয় ম্যাচে ড্র তুলে নিয়ে তাহসিন পূরণ করলেন সদ্য প্রয়াত বাবা গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন। জিয়া খুব করেই চেয়েছিলেন তাহসিন যেন এবারের অলিম্পিয়াডেও যেতে পারেন। অনন্তলোক থেকে আজ নিশ্চয়ই তিনি খুশি।

সর্বশেষ ২০২২ সালে বাবা-ছেলে একসঙ্গে বাংলাদেশের হয়ে বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে খেলেছেন ভারতের চেন্নাইয়ে। আরেকটি দাবা অলিম্পিয়াডে জিয়ার যাওয়া নিশ্চিতই ছিল ৪৮তম জাতীয় দাবার সেরা পাঁচে থেকে। কিন্তু গত শুক্রবার জাতীয় দাবার ১২তম রাউন্ডে পয়েন্ট তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা জিয়া খেলতে খেলতে চলে যান না ফেরার দেশে।

আরও পড়ুন
খেলতে খেলতেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন জিয়াউর রহমান
সংগৃহীত

বাবাকে হারানোর শোকের মধ্যেই মঙ্গলবার ১২তম রাউন্ড খেলেন তাহসিন। গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের সঙ্গে গতকাল খেলেন শেষ রাউন্ডে। আজ প্লে–অফ জিতে অলিম্পিয়াডের দলে জায়গা পেলেও তাহসিন ছিলেন বিমর্ষ। বাবাকে হারানোর শোক ভুলতে পারছিলেন না কিছুতেই, ‘স্বস্তি লাগছে যে টুর্নামেন্টটা শেষ হলো। কিন্তু আব্বুকে খুব মিস করছি। এখনো আমি মানতে পারছি না, আব্বু নেই। আগের অলিম্পিয়াডেও দলে জায়গা পেতে আমাকে টাইব্রেকে খেলতে হয়। আগেরবার আব্বু বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু এবার আর নেই।’

তাহসিন এ কথা বলতেই পাশে বসা তাঁর মা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘জিয়া বলেছিল, ফেডারেশন রাজি হলে ও কোচ হিসেবে যাবে অলিম্পিয়াডে। তবু তাহসিন যেন যেতে পারে। যেহেতু দুই তরুণ নীড় আর ফাহাদ যাচ্ছে, তাহসিন না যেতে পারলে ওর মনটা খারাপ হবে। জিয়া তাই চেয়েছিল তাহসিন যেন জাতীয় দাবায় পঞ্চম স্থানটা পায়। এসব ভেবে একটা মানসিক চাপ নিয়ে নেয় ও।’

বাবার ইচ্ছেপূরণে তাহসিনকেও সামলাতে হয় পাহাড়সমান মানসিক চাপ। কীভাবে তা সামলেছেন, প্লে–অফ জিতে কথা বলেন তা নিয়েও, ‘বোর্ডে মনোযোগ দিতে সমস্যা হচ্ছিল আমার। তারপরও নিজেকে বলি, আমাকে জিততে হবে। প্রথমটা জিতলেও পরের গেমে আমার পজিশন ভালো ছিল না। প্রতিপক্ষের ভুল চালে খেলা ড্র করতে পেরেছি। জানি না, আল্লাহ হয়তো সহায়তা করেছেন। বাবার চাওয়াটা পূরণ হয়েছে।

আরও পড়ুন
বাবা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তাহসিন তাজওয়ার
প্রথম আলো

এরপরই নিজের স্বপ্নের কথাও বলেন তাহসিন, ‘আব্বু দাবা খেলতে খেলতেই মারা গিয়েছেন। আমি খেলাটা চালিয়ে নেব। এত বছর বাবা খেলেছেন। বাবার মতো খেলার চেষ্টা করব, যাতে আমার খেলার মধ্যে আপনারা বাবাকে দেখতে পান। চেষ্টা থাকবে বাবার মতো বেশি অলিম্পিয়াড খেলা।’

জিয়া ১৯৮৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত রেকর্ড ১৬ বার খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে। দুই বছর পরপর আয়োজিত অলিম্পিয়াডে ২০১০ সালে জিয়া খেলেননি তৎকালীন দাবা ফেডারেশন নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। ২০২০ সালে করোনায় অলিম্পিয়াড হয়নি। এর বাইরে প্রতিবারই তিনি খেলেছেন।

জিয়ার স্ত্রী তাসমিনের সব স্বপ্ন এখন ছেলেকে ঘিরে, ‘জিয়া, আমি ও তাহসিন—তিনজন সব সময় একসঙ্গে ছিলাম। জিয়া আমাদের মাঝে নেই। এটা মানতে পারছি না। এখনো মনে হয়, জিয়া বাইরে আছে, এসে পড়বে।’ জিয়া দেশের বাইরে যেখানেই খেলতে যেতেন, স্ত্রী-সন্তানও সঙ্গী হতেন। এবার ছেলের সঙ্গে হাঙ্গেরি যেতে চান মা তাসমিনও

এ জন্য চান সরকারের আর্থিক সহায়তা, ‘আমার চাওয়া, জিয়ার স্বপ্নপূরণে সবাই এগিয়ে আসুক। ও দেশের জন্য অনেক করেছে, এবার জিয়ার পাশে এসে দাঁড়াক সবাই।’

আরও পড়ুন