হিটলারের ডেথ ক্যাম্প এড়ানো বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের মৃত্যু
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ইহুদিদের ওপর নাৎসি বাহিনীর চালানো ধ্বংসযজ্ঞ (হলোকাস্ট) থেকে বেঁচে ফেরেন। পরে হেলসিঙ্কি ও মেলবোর্ন অলিম্পিক মিলিয়ে জেতেন পাঁচটি সোনার পদক। দীর্ঘ দিন ধরে তিনিই ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন।
সেই আগনেস কেলেটি অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। গতকাল নিজ দেশ হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টের একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। স্থানীয় ক্রীড়া দৈনিক নেমজেতি স্পোর্টকে কেলেটির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তাঁর ছেলে রাফায়েল বিরো। পরে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বিষয়টি জানিয়েছেন কেলেটির প্রেস কর্মকর্তা তামাস রোথ। কিংবদন্তি এই নারী জিমন্যাস্টের বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর গত সপ্তাহে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আগনেস কেলেটি। তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমেই অবনতি হতে থাকে। মায়ের মৃত্যুর খবর জানাতে গিয়ে ছেলে রাফায়েল বিরো স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা তাঁর জন্য প্রার্থনা করি। তাঁর জীবনীশক্তি ছিল অবিশ্বাস্য।’
আগনেস কেলেটির মৃত্যুতে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি টমাস বাখ। এক বিবৃতিতে বাখ বলেছেন, ‘তিনি (হলোকাস্ট) ট্রাজেডি কাটিয়ে উঠতে দৃঢ় সংকল্প ও অসীম সাহস দেখিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দশটি অলিম্পিক পদক জিতেছেন, এর মধ্যে পাঁচটি সোনা।’
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেলেটির একটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘পাঁচবারের অলিম্পিক সোনাজয়ী, জাতির শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ, বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন—সবকিছুর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি শান্তিতে থাকুন।’
হলোকাস্ট ট্রাজেডি ও অলিম্পিকের গৌরব নিয়ে বেঁচে থাকা আগনেস কেলেটির জীবনের গল্পটা যেন হলিউড সিনেমার মতো। অনেক বাধাবিপত্তি, প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি হাল ছাড়েননি। সব সময় প্রাণবন্ত থাকার চেষ্টা করেছেন।
১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি ও ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক মিলিয়ে ৫টি সোনাসহ জেতেন ১০টি পদক, সব কটিই ৩০ পেরোনোর পর এবং তাঁর চেয়ে অনেক কম বয়সী প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়ে। হাঙ্গেরির ইতিহাসে সফলতম জিমন্যাস্ট তিনিই।
গৌরব আর সাফল্যের পেছনে ছোটা নয়; বরং কমিউনিস্ট শাসিত হাঙ্গেরি থেকে নিজেকে আয়রন কার্টেনের (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্মিত রাজনৈতিক, সামরিক ও আদর্শিক বাধা) বাইরে নিয়ে যাওয়াই ছিল আগনেস কেলেটির খেলাধুলার প্রেরণা। ২০১৬ সালে এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খেলাধুলা পছন্দ করতাম বলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি; বরং আমি বিশ্ব ঘুরে দেখতে চেয়েছিলাম বলে খেলেছি।’
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর পর, অর্থাৎ ১৯২১ সালে ৯ জানুয়ারি ইহুদি পরিবারে জন্ম নেন আগনেস কেলেটি। পরিবার তাঁর নাম রেখেছিল আগনেস ক্লাইন। পরবর্তীতে নিজেই নামের পদবি পরিবর্তন করেন। ক্লাইন থেকে হয়ে যান কেলেটি, যেন তাঁকে আরও বেশি হাঙ্গেরিয়ান মনে হয়।
কেলেটির জিমন্যাস্টে হাতেখড়ি মাত্র ৪ বছর বয়সে। ১৬ বছর বয়সে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হন আর জাতীয় দলে প্রথমবারের মতো ডাক পান ১৯৩৯ সালে। কিন্তু ইহুদি হওয়ার কারণে ১৯৪০ সালের পর থেকে তাঁকে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।
১৯৪৪ সালের মার্চে নাৎসি বাহিনী হাঙ্গেরি দখল করে। প্রাণে বাঁচতে কেলেটি তখন নিজেকে খ্রিস্টান নারী পরিচয় দেন এবং নিজের কাছে যা কিছু ছিল, সেসবের বিনিময়ে জাল নথিপত্র তৈরি করেন। এভাবেই তিনি ডেথ ক্যাম্পে (মৃত্যু শিবিরে) নির্বাসন থেকে রক্ষা পান। ওই বছরই তিনি সতীর্থ জিমন্যাস্ট ইস্টভান সারকানিকে বিয়ে করেন। সেই সংসার টেকে ৬ বছর। ১৯৫০ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়।
হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নৃশংসতা থেকে নিজে বাঁচলেও বাবাকে বাঁচাতে পারেনি আগনেস কেলেটি। অশভিটৎস বন্দিশিবিরে তাঁর বাবা ফেরেঙ্ক ক্লাইনসহ পরিবারের আরও কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। তবে সুইডিশ কূটনীতিক রাউল ভালেনবার্গের সহায়তায় তাঁর মা ও বোনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। গ্রামাঞ্চলে লুকিয়ে থাকার সময় কেলেটি একটি বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন। অবসর সময়ে দানিউব নদীর তীরে গোপনে অনুশীলন করতেন।
১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরির ব্যর্থ সোভিয়েত বিরোধী বিদ্রোহের কয়েক সপ্তাহ পর শুরু হয় মেলবোর্ন অলিম্পিক। সেই অলিম্পিকে অংশ নিতে যাওয়া হাঙ্গেরির অনেক অ্যাথলেটের মতো কেলেটিও দেশে ফেরেননি।
পরের বছর তিনি ইসরায়েলে স্থায়ী হন। সেখানে হাঙ্গেরিয়ান ক্রীড়া শিক্ষক রবার্ট বিরোর সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৫৯ সালে দুজন বিয়ে করেন।
খেলোয়াড়ি জীবন শেষে শিক্ষকতা শুরু করেন আগনেস কেলেটি। শিক্ষকতা জীবনের শুরু করেছিলেন শারীরিক শিক্ষা বিভাগে। পরবর্তীতে ইসরায়েল জাতীয় দলের কোচ হন। ১৯৮৩ সালে বিশ্ব জিমন্যাস্টিকস চ্যাম্পিয়নশিপ উপলক্ষে তিনি তৎকালীন কমিউনিস্ট হাঙ্গেরিতে ফেরার অনুমতি পান। ২০১৫ সাল থেকে হাঙ্গেরিতেই বাস করতে শুরু করেন। গতকাল নিজ দেশেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন; ১০৪তম জন্মদিনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে।
কেলেটির মৃত্যুর পর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বয়সী অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের তকমাটা পেয়ে গেছেন ১০০ বছর বয়সী চার্লস কস্তে। ফ্রান্সের এই সাবেক সাইক্লিস্ট ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকে সোনা জেতেন। গত বছর প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মশালবাহকও ছিলেন কস্তে।