নেইমারের সঙ্গে বিতর্কে জড়ানো জেসুসই কি হচ্ছেন ব্রাজিলের কোচ

জর্জ জেসুসের সঙ্গে নেইমার, ব্রাজিলিয়ান তারকা যখন আল হিলালে ছিলেনএএফপি

পরবর্তী কোচ খুঁজছে ব্রাজিল। এখনো কেউ নিশ্চিত হননি, তবে আলোচনায় এগিয়ে জর্জ জেসুস। আল হিলালের এই পর্তুগিজ কোচ নাকি সবুজ সংকেতও দিয়েছেন। ব্রাজিল জাতীয় দলের অংশ হতে চান তিনি। তবে জেসুস নিজেই জানিয়েছেন, ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশন (সিবিএফ) থেকে এখনো তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ কথা বলেননি।

ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘ইউওএল’–এর সাংবাদিক মাউরো সিজার পাহেইরা জানিয়েছেন এ খবর। তবে একটি খটকা থেকেই যায়। নেইমারের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো নয় জেসুসের। ব্রাজিল তারকা সৌদি ক্লাবটিতে চোটাক্রান্ত অবস্থায় থাকতে গত জানুয়ারিতে জেসুস বলেছিলেন, সৌদি লিগ যে মানের খেলায় অভ্যস্ত, নেইমার এখন আর সে পর্যায়ে নেই। তারপর অবশ্য জল গড়িয়েছে অনেক দূর।

নেইমার আল হিলাল ছেড়ে যোগ দিলেন সান্তোসে এবং আবারও চোটে পড়েছেন। মার্চে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্রাজিলের দুটি ম্যাচেও খেলতে পারলেন না। দুটি ম্যাচের মধ্যে আর্জেন্টিনার কাছে শেষ ম্যাচে ৪–১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ব্রাজিল কোচের পদ থেকে ছাঁটাই হন দরিভাল জুনিয়র। পরবর্তী কোচের আলোচনায় কার্লো আনচেলত্তির নাম সবার ওপরে থাকলেও রিয়াল মাদ্রিদের এ কোচ ব্রাজিল নিয়ে সেভাবে আগ্রহ দেখাননি এবং তিনি স্প্যানিশ ক্লাবটিতে চুক্তির মেয়াদ শেষ করতে চান বলে খবর। সিবিএফের ‘প্ল্যান বি’ হিসেবে তারপরই আলোচনায় উঠে এসেছে জেসুসের নাম।

চোটের কারণে আপাতত মাঠের বাইরে নেইমার
নেইমারের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডল

প্রশ্ন হলো, ব্রাজিলের কোচ হওয়ার আলোচনায় নেইমারের সঙ্গে তাঁর বাজে সম্পর্ক কি বাধা হবে? উত্তর সময়ের ওপর ছেড়ে দেওয়াই নিরাপদ। তবে আপাত পরিস্থিতি বলছে, জেসুস বিষয়টিকে সমস্যা বলেই মনে করছেন না। কারণ, সিজারের ব্লগে তিনি বলেছেন, ‘নেইমারের সঙ্গে আমার কোনো সমস্যা নেই।’ তবে নেইমারের বিষয়ে কিছুটা যে রক্ষণশীলতা তাঁর আছে, সেটা বোঝা গেছে অন্য মন্তব্যে, ‘কোনো দল বা ক্লাব একজন খেলোয়াড়ের ওপর নির্ভর করতে পারে না।’

সিবিএফ জেসুসকে কোচ বানানোর সিদ্ধান্ত নিতে গেলে নেইমারের সঙ্গে তাঁর বাজে সম্পর্ককে কি আমলে নেবে? ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘ও গ্লোবো’র সাংবাদিক দিওগো দান্তাসের প্রতিবেদনে কিন্তু এসবের কোনো বালাই নেই। তিনি জানিয়েছেন, আগামী সোমবার থেকে নতুন কোচ খোঁজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করবে সিবিএফ। সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট এদনালদো রদ্রিগেজ এখনো কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আগামী সপ্তাহে কথা বলবেন। সেই কথা কিংবা আলোচনায় বসাটা জেসুসের সঙ্গে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। দান্তাস প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ‘সিবিএফে এবং ব্যাপারটির মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে যে আলোচনা, সেই বিচারে এ মুহূর্তে জেসুসই ফেবারিট

পর্তুগিজ কোচ প্রস্তাবের অপেক্ষায় আছেন এবং ব্রাজিল জাতীয় দলের দায়িত্ব নিতে এরই মধ্যে সবুজ সংকেত দিয়েছেন।’ শুধু তাই নয়, দান্তাস আরও জানিয়েছেন, জেসুসের ঘনিষ্ঠজন যাঁদের সিবিএফের সঙ্গেও যোগাযোগ আছে, তাঁদের দাবি পর্তুগিজ এই কোচের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে মৌখিকভাবে অনেক কিছুই ঠিক হয়ে আছে। এখন সিবিএফ প্রেসিডেন্ট রদ্রিগেজকে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহ প্রকাশ করতে হবে জেসুসের প্রতি।

আরও পড়ুন
রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি
রয়টার্স

ঝামেলা হলো, রদ্রিগেজের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আনচেলত্তি। অনেক দিন ধরেই রিয়াল কোচের পিছু ছুটছেন। দান্তাস জানিয়েছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে রিয়ালে চুক্তির মেয়াদ পুরো করার কথা বললেও পর্দার পেছনের খবর হলো, ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের পর দায়িত্ব নিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন আনচেলত্তি। কিন্তু সিবিএফ তত দিন অপেক্ষা করতে রাজি নয়। ১৪ জুন শুরু হবে ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ। আর ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ৪ ও ১০ জুন ম্যাচ আছে ব্রাজিলের। বিশ্বকাপের প্রায় ১ বছর ৩ মাস সময় হাতে রেখেই সিবিএফ জুনের বাছাইপর্বের আগেই নতুন কোচ নিয়োগ দিতে চায়।

জেসুসের ক্লাব আল হিলাল এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলছে। ফাইনালে পৌঁছাতে পারলে সেটি হবে ৩ মে জেদ্দায়। একই মাসে শেষ হবে সৌদি প্রো লিগও। তবে জেসুস চুক্তিপত্র বাতিল করে জুনে ক্লাব বিশ্বকাপ শুরুর আগেই ব্রাজিলের দায়িত্ব নিতে পারবেন। চুক্তিপত্র বাতিলের ব্যাপারটি আলোচনাসাপেক্ষ এবং সিজারের ব্লগে জেসুস বলেছেন, সিবিএফ থেকে ‘কেউ আমার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করেননি।’

ইতিহাসের ইঙ্গিত কিন্তু জেসুসের পক্ষেই। মানে, ব্রাজিল ফুটবল এখন যে টালমাটাল সময় পার করছে, তার মধ্যে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য জেসুসই যোগ্য ব্যক্তি। ব্যাপারটি বুঝতে একটু পেছনে তাকানো দরকার। ব্রাজিলের জেতা পাঁচটি বিশ্বকাপের মধ্যে সর্বশেষ তিনটি শিরোপাই এসেছে টালমাটাল সময়ে। ১৯৭০ বিশ্বকাপে যেমন হোয়াও সালদানাকে নিয়ে বিতর্ক ছিল। রগচটা ও পেলের সঙ্গে ঝামেলার কারণে সালদানাকে নিয়ে তুমুল বিতর্ক তৈরি হয়েছিল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে। পরে মারিও জাগালো কোচের দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বকাপ জেতান। যদিও তোস্তাওকে দলে রাখার জন্য প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল জাগালোকে। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে রাইকে বাদ দেওয়ার জন্য গোটা ব্রাজিলের রোষানেল পড়েছিলেন কোচ কার্লোস আলবার্তো পাহেইরা। আর ২০০২ বিশ্বকাপের আগে রোমারিওকে বাদ দিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক ও আলোচনার জন্ম দেন লুইস ফেলিপে স্কলারি। কিন্তু নিজের চিন্তাভাবনায় অটল থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপও জিতিয়েছেন এই তিন কোচ।

আরও পড়ুন
ব্রাজিলের সাবেক কোচ লুইস ফেলিপে স্কলারি
এএফপি

২০০২ বিশ্বকাপের আগের পরিস্থিতির সঙ্গে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের বর্তমান সময়ের তুলনা চলে। ভ্যান্ডারলি লুক্সেমবার্গ, এমারসন লেয়াও, কান্দিনিওর হাত বদল হয়ে বিশ্বকাপ শুরুর ১১ মাস আগে কোচের দায়িত্ব পেয়েছিলেন স্কলারি। ব্রাজিল ২০০১ সালের কোপা আমেরিকার শেষ আট থেকে ছিটকে পড়েছিল হন্ডুরাসের কাছে হেরে—যেটাকে সে সময় জাতীয় বিপর্যয়ের চোখেই দেখেছিল ব্রাজিল, যেমনটা এখন দেখা হচ্ছে কয়েক দিন আগে আর্জেন্টিনার কাছে ব্রাজিলের ৪–১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়াকে।

প্রশ্ন হচ্ছে, জেসুস বর্তমান টালমাটাল পরিস্থিতি ঠিক করতে কীভাবে মানানসই? ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের সংস্কৃতি সমন্ধে খোলনলচে জানেন ৭১ বছর বয়সী কোচ। ২০১৯ সালে তাঁর মন্ত্রণায় চোখধাঁধানো ফুটবল খেলে কোপা লিবার্তোদোরেস জেতে ফ্ল্যামেঙ্গো। সময়ের সদ্ব্যহারও তাঁর জানা। ২০১৯ কোপা আমেরিকার বিরতি চলাকালীন ফ্ল্যামেঙ্গোর দায়িত্ব নিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ক্লাবটির খেলার ধাঁচ পাল্টে ফেলেন জেসুস। আক্রমণাত্মক ও সংঘবদ্ধ ফুটবল খেলে নজর কেড়েছিল ফ্ল্যামেঙ্গো, যেটা এ মুহূর্তে প্রয়োজন ব্রাজিল জাতীয় দলে। আর নেতৃত্বগুণ? সেটাও আছে জেসুসের। নেইমার জানেন জেসুস জাতীয় দলের কোচ হলে তাঁর কোনোরকম টালবাহানা তিনি মানবেন না। নিজের যত্ন নিতে হবে নেইমারের, ফিরতে হবে ছন্দেও এবং খেলতে হবে দল হিসেবে।

খুব পরিকল্পনা করে কিছু করে সাফল্য না পাওয়াটা পুরোনো বিষয় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে। টেলে সান্তানার ’৮২ বিশ্বকাপ এর উদাহরণ। এমন আরও আসবে; জাগালোর ১৯৯৮ বিশ্বকাপ, পাহেইরার ২০০৬ বিশ্বকাপ, দুঙ্গার ২০১০ বিশ্বকাপ; সময় পেয়েও ও শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও ব্রাজিল ফুটবল এসব সময়ে সাফল্য পায়নি। তাই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের জন্য টালমাটাল সময় আসলে অতটা খারাপও নয়। প্রয়োজন শুধু সঠিক সিদ্ধান্তের। শেষ পর্যন্ত জেসুস কি সেই সঠিক সিদ্ধান্ত হবেন?

আরও পড়ুন