হাসি-আড্ডা আর আগুনঝরা দিনগুলোতে ফেরা...স্বাধীন বাংলা দলের এক বিকেল
অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি তাঁরা। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে জাকারিয়া পিন্টু, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, সাইদুর রহমান (প্যাটেল), প্রতাপ শঙ্কর হাজরাদের পায়ে ফুটবলই হয়ে ওঠে অস্ত্র। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় একবার দেশ স্বাধীনের উদ্দেশ্যে এক হয়েছিলেন এই ফুটবলাররা।
আজ আবারও এক ছাদের নিচে জড়ো হলো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে সংবর্ধনা দিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। অনুষ্ঠানে সবাইকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়, এরপর তাঁদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অনেকে বেঁচে নেই। কিন্তু যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের এই অনুষ্ঠানে এসে আবেগে ভেসে গেলেন। পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণায় মেতে ওঠেন পুরোনো খেলার সঙ্গীকে পেয়ে।
কানাডাপ্রবাসী সাবেক ফুটবলার এনায়েতুর রহমান ঢাকায় এসেছেন কিছুদিন আগে। তাঁকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বাফুফের পক্ষ থেকে। কিন্তু স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম ম্যাচের গোলদাতা এনায়েতুর দেশে থাকলেও আসেননি এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে!
সবার আগে ফুটবল ভবনের কনফারেন্স রুমে ঢুকলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার তানভীর মাজহার (তান্না)। এরপর একে একে এলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু, সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, শেখ আশরাফ আলী, বিমল কর, কাজী সালাউদ্দিন, সুভাষ চন্দ্র সাহা, ফজলে সাদাইন খোকন, আমিনুল ইসলাম (সুরুজ), আবদুল মমিন জোয়ার্দার, আবদুস সাত্তার, মজিবুর রহমান, সাইদুর রহমান (প্যাটেল), মোজাম্মেল হক, বীরেন দাস (বিরু), মইন উদ্দিন সিনহা, আবুল কাশেম খান এবং এ এফ এম বদিউজ্জামান।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এসে উচ্ছ্বসিত জাকারিয়া পিন্টু ধন্যবাদ দিলেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনকে, ‘সংবর্ধনা আমরা অনেক পেয়েছি। এই সংবর্ধনা পাওয়াটা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু আজকের আয়োজনটা একেবারে অন্য রকম। অনেক পুরোনো বন্ধু ও ফুটবলারদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এমন উদ্যোগের জন্য সালাউদ্দিনকে ধন্যবাদ জানাই।’
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৩৫। তবে ২০০৩ সালের ২৫ অক্টোবর প্রকাশিত সরকারি গেজেটে সংখ্যাটা ৩১। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের পতাকাতলে এই ফুটবলাররা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, বেনারস, মুম্বাইসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে ১৭টি প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ খেলেন। ম্যাচগুলো থেকে সব মিলিয়ে আয় হয় ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ভারতীয় রুপি। এই অর্থ দেওয়া হয় স্বাধীন বাংলা সরকারের তহবিলে।
কীভাবে কেমন করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠন করা হয়েছিল, সেই স্মৃতিচারণা সাইদুর রহমানের, ‘২৬ মার্চ যখন পাকিস্তানি ঘাতকেরা ঘুমন্ত অবস্থায় নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে গেন্ডারিয়ার লালকুঠিতে বিশ্রাম নিচ্ছিল, সেই অন্ধকার ভোরে ২৭ জনকে নিয়ে আমরা সূত্রাপুর থানা লুট করি। সেই থেকে আমাদের যুদ্ধের শুরু। এরপর বিক্রমপুর হয়ে আগরতলা ও কলকাতা যাই আমরা। ভারতে গিয়ে জাতীয় চার নেতার অন্যতম কামারুজ্জামান সাহেব ও প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করি। আমি স্বাধীন বাংলা দল গড়ার জন্য আমার প্রস্তাবের ব্যাখ্যা দিলাম তাঁকে। উনার মতো বড়মাপের নেতা এটা শুনে বুকে জড়িয়ে ধরে দল গড়ার পরিকল্পনার অনুমোদন দেন।’
ভারতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম প্রদর্শনী ম্যাচটি ছিল ২৪ জুলাই ১৯৭১ সালে। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামের ওই ম্যাচে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করার অনুমতি মিলছিল না। শেষ পর্যন্ত সেই অনুমতি পেয়েছিল স্বাধীন বাংলা দল। নদীয়া জেলা একাদশের বিপক্ষে বিপুলসংখ্যক দর্শক ওই ম্যাচটি উপভোগ করেন।
বর্তমানে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের স্মৃতিচারণা, ‘আমাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, গোটা ভারতে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি করা। এখন আমি যখন রোহিঙ্গাদের দেখি, তখন খুব খারাপ লাগে। কারণ, আমরাও তখন ভারতে গিয়ে ওই রকম অবস্থায় ছিলাম। আজ নিজের দায়িত্বে এই দলের অনেককে একত্র করেছি। এ জন্য আমার খুব ভালো লাগছে।’