সাবেক ট্যাক্সিচালক থেকে বিশ্বকাপে - পেকারম্যানের গল্প
হোসে পেকারম্যানের খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি ঘটেছিল অকালেই। এরপর জীবনযুদ্ধে নেমে চালিয়েছেন ট্যাক্সি। কিন্তু ফুটবল ছেড়ে যাননি। বয়সভিত্তিক দলগুলোকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা পেকারম্যানকে তুলে এনেছে বড়দের মঞ্চে। গতবারের মতো এবারও তাঁর হাতে কলম্বিয়ার ‘স্বপ্নগাড়ি’
আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের নাম শুনেছেন? আচ্ছা, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে, এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো, ফার্নান্দো রেদোন্দোদের নাম তো শুনেছেন? আর্জেন্টিনার ইতিহাসে অন্যতম সেরা কিছু ফুটবলারের জন্মদাতা এই আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের বয়সভিত্তিক দল। হোসে পেকারম্যানের খেলোয়াড়ি জীবনও শুরু হয়েছিল এই ক্লাবের বয়সভিত্তিক দলে। অর্থাৎ চোখে বড় ফুটবলার হয়ে ওঠার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্নের সূর্য অস্ত গেছে বহু আগেই।
খেলতেন মিডফিল্ডে। কিন্তু সেভাবে আলো কাড়তে পারলেন না। পরিণামে আর্জেন্টিনোস তাঁকে বেচে দেয় কলম্বিয়ার ইন্দিপেন্দিয়েন্তে ক্লাবে। পেকারম্যান সেখানেও খুব একটা পাত্তা পেলেন না। ১০১ ম্যাচে মাত্র ১৫ গোল। আসলে সৃষ্টিকর্তা নিজেই চাননি পেকারম্যান ফুটবলার হয়ে উঠুন। তাই ২৮ বছর বয়সেই মারাত্মক চোট পেলেন হাঁটুতে। অকালমৃত্যু ঘটল তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের। পেকারম্যান এরপর শুরু করলেন নতুন জীবন। সে জীবন কখনো তেতো, কখনো স্বাদু, কখনো আবার লড়াইয়ের ঘামে ভেজা নোনতা অনুভূতি।
টানাটানির সংসারে জন্মানোয় পেকারম্যানকে একটা চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছিল। খেলোয়াড়ি জীবন তো গেল, এখন চলবে কীভাবে? পরিবারের কী হবে? এসব প্রশ্নের সমাধান করতে পেকারম্যান ধরনা দিলেন তাঁর ভাই টিটোর কাছে। একটা গাড়ি চাই। না, গাড়ি চড়ে দুঃখবিলাস বা ভাবনাবিলাসে সময় কাটানোর কোনো ইচ্ছাই ছিল না পেকারম্যানের। ভাইয়ের কাছ থেকে রেনাল্ট ১২ মডেলের গাড়ি ধার করে পেকারম্যান তাঁর জীবনের ‘দ্বিতীয় অধ্যায়’ শুরু করলেন ট্যাক্সিচালক হিসেবে!
বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় ১৯৭৯ সালেও ধার করা গাড়ি নিয়ে যাত্রী ওঠানামা করাতেন পেকারম্যান। ৩৯ বছর পর তিনি এখনো ‘গাড়ি’র চালক, সেটা তাঁর নিজের গাড়িও নয়, কিন্তু চালাচ্ছেন ছয় বছর ধরে সফলতার সঙ্গেই। তাঁর সেই গাড়ির যাত্রীদের নামগুলো চিনতে পারেন কি না দেখুন—হামেস রদ্রিগেজ, রাদামেল ফ্যালকাও, হুয়ান কুয়াদ্রাদো, ইয়েরি মিনা, ডেভিড ওসপিনা।
ঠিকই ধরেছেন, পেকারম্যান অর্ধযুগ ধরেই কলম্বিয়া দলের কোচ। তাঁর ফুটবল-মস্তিষ্কের ‘স্টিয়ারিং’-এ ভরসা রেখেই রাশিয়া বিশ্বকাপ অভিযানে যাবে কলম্বিয়া। আর্জেন্টাইন এই কোচের ওপর এর আগেও ভরসা রেখে ফল পেয়েছে ‘লা ট্রাইকালার’রা। কলম্বিয়া তাদের বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালের দেখা পেয়েছিল গত টুর্নামেন্টে, তাঁর হাত ধরেই। ৬৮ বছর বয়সী ওই বুড়ো হাত দুটি এবার নিশ্চয়ই আরও পরিণত ‘ড্রাইভার’ হয়ে টপকে যেতে চায় কলম্বিয়ার গতবারের স্টেশন!
ব্রাজিল বিশ্বকাপে এসে (২০১৪) টানা নয় ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়েছিলেন কলম্বিয়ার এই কোচ। তার আগে ২০০৬ সালে ছিলেন আর্জেন্টিনার কোচ। পেকারম্যান নিশ্চিতভাবেই জন্মভূমির কোচ হওয়ার সেই অধ্যায়টি ভুলে যেতে চাইবেন। টানা চার ম্যাচ জেতার পর কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে হেরেছিল পেকারম্যানের আর্জেন্টিনা। এই ম্যাচে কিশোর লিওনেল মেসিকে বেঞ্চে বসিয়ে এবং হাভিয়ের জানেত্তিকে স্কোয়াডের বাইরে রেখে তুমুল সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন পেকারম্যান। পরিণামে ম্যাচটা হারের পরই তিনি মেসিদের কোচ পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
এরপর ছয় বছর বড় কোনো দলের দায়িত্ব নেওয়া থেকে নির্বাসনে ছিলেন পেকারম্যান। তাঁর সময় কেটেছে মেক্সিকোর ঘরোয়া ফুটবলে। ২০১২ সালে এসে ঘুরল পাশার দান। দায়িত্ব পেলেন কলম্বিয়া দলের। পেকারম্যান ইউরোপকেন্দ্রিক তরুণ ও অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের মিশেলে গড়লেন দারুণ এক দল। তাঁর অধীনে বাছাইপর্ব টপকে ১৬ বছর পর কলম্বিয়াকে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলার টিকিট এনে দেয় সেই দলটা। ব্রাজিলে টানা চার ম্যাচ জিতে কোয়ার্টারে সেই ব্রাজিলের কাছে হেরেছিলেন পেকারম্যান।
ফুটবলে কৌশলগত জ্ঞানের জন্য পেকারম্যান কোচিং মহলে শ্রদ্ধার পাত্র। এবার রাশিয়ায় তিনি পা রাখবেন দক্ষিণ আমেরিকার জাতীয় দলগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দীর্ঘমেয়াদি কোচ হিসেবে। কলম্বিয়া দলে পেকারম্যানের প্রভাব কতটা, তা ব্যাখ্যা করলেন তারকা স্ট্রাইকার ফ্যালকাও, ‘তিনি আসার পর দলের সবকিছু পাল্টে গেছে। সেটা খেলার ধাঁচ, ফল কিংবা আত্মবিশ্বাস। আমরা নিজেদের মতো খেলার স্বাধীনতা পেয়েছি যেমনটা আমরা খেলতে অভ্যস্ত।’
অথচ ৩৯ বছর আগে ফিরে তাকালে আমরা কী দেখি? বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় ট্যাক্সি চালাচ্ছেন পেকারম্যান। দুই বছর এভাবে চলার পর আর্জেন্টিনা প্রিমেরা লিগের ক্লাব চাকারিতা জুনিয়র্সের বয়সভিত্তিক দলে প্রথম সুযোগ পেলেন কোচিং করার। এরপর ধীরে ধীরে খুলতে লাগল দুয়ার। আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব-২০ দলকে জেতালেন তিনটি বিশ্বকাপ। তারপর থেকেই বড়দের বিশ্বকাপে ডাগআউটে—সত্যিই জীবন কখনো তেতো, কখনো স্বাদু, কখনো আবার লড়াইয়ের ঘামে ভেজা নোনতা অনুভূতি।
পেকারম্যানের কাছে এখন সেই অনুভূতিটুকু নিশ্চয়ই মিষ্টি!