২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ম্যারাডোনার মতো করে বাঁচার কেউ আছেন!

বল আর ম্যারাডোনা যেন একই বৃন্তে দুটি কুসুম—তাঁর জীবনটাও ছিল বর্ণিলছবি: টুইটার

জীবনটা আসলে কী?

‘জীবন হলো খেলা, উপভোগ করো; জীবন একটা চ্যালেঞ্জ, মুখোমুখি হও; জীবন একটা সুযোগ, লুফে নাও’—বহু পুরোনো প্রবাদ। বক্তার নাম পাওয়া যায়নি। তবে জীবনকে এভাবে প্রতি চুমুকে চুমুকে ভোগ করা মানুষ পৃথিবীতে খুব কম।

মানুষ ঝুঁকি নিতে ভয় পায়। জীবনটা তাই আটপৌরে হয়ে যায়। এর মধ্যে যাঁরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে জীবনকে সাজান নিজের মতো করে তারাই তো কিংবদন্তি! ম্যারাডোনা যদি ফুটবল নাও খেলতেন, তবু তিনি জীবনকে যেভাবে উপভোগ করেছেন, তা পারেন কজন!

ম্যারাডোনা অনেকের কাছে ভালোবাসার ‘ধর্ম’
ছবি: টুইটার

ম্যারাডোনার সঙ্গে টাচলাইনের বাইরের পৃথিবীর এপিঠ-ওপিঠ দেখেছে ফুটবল। ফিদেল কাস্ত্রো-শাভেজ...ড্রাগ...নারীসঙ্গ। সেসব টাচলাইনের বাইরে। কিন্তু টাচলাইনের ভেতরে, তিনি ‘ঈশ্বরতুল্য’! তুল্য—কথাটাতেও আপত্তি তুলতে পারেন অনেকে।

১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপের আলো-আঁধার—দুইই ম্যারাডোনার। আঁধারটুকুকে কেউ যদি বলেন হাত দিয়ে গোল, ভক্তরা বলবেন সে তো চাঁদের কলঙ্ক, ওটুকু না থাকলে জীবনের কী মর্ম!

জীবন তো আর একমুখী স্রোতের বহতা নদী নয়, সে নানারকম বাঁকের খেরোখাতা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার সেই হাত দিয়ে গোল (হ্যান্ড অব গড) তেমনই এক বাঁক, যা বিতর্ক নয়, আদরের সঙ্গে মনে করা হয়। কিন্তু এখন? ম্যারাডোনা ‘ঈশ্বরের হাতে নিজেকে সমর্পণ’ করার পর?

ফটোগ্রাফাররা ঘিরে ধরেছেন ম্যারাডোনাকে। এমন জীবন কজনের হয়!
ছবি: টুইটার

নিচ থেকে আমরা বলতে পারি, এ তাঁর স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, জীবনকে তিনি কখনো পাত্তা দেননি বলেই সেই বিতর্কিত গোলটা যেন তাঁর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি—দেশকে জেতাতে যেভাবেই হোক গোল করো!

এটুকু আবেগ না থাকলে তাঁর জাদুকরি বাঁ পা-ও হয়তো কথা বলত না। অমরত্ব পাওয়ার অন্যতম শর্তই যে আবেগ। ম্যারাডোনা এই আবেগ থেকেই গোল করেছিলেন দেশাত্মবোধের জালে।

১৯৮২ সাল। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে ইংল্যান্ড-আর্জেন্টিনার মধ্যে চলছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ম্যারাডোনা তখন কিংবদন্তি হয়ে ওঠার পথে। সে সময় তাঁর সাক্ষাৎকার চেয়েছিলেন কিছু ব্রিটিশ সাংবাদিক। এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা ব্রিটিশরা আগে আমাদের মালভিনাস (ফকল্যান্ডের স্প্যানিশ নাম) ফেরত দাও।’

ম্যারাডোনা নাপোলিতে থাকতে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন মাদকে। তখন ভীষণ চিন্তায় পড়েছিলেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেনেম ও ক্রীড়া সচিব ভিক্টর লুপো। বুয়েনস এইরসে তাঁরা আর্তি জানিয়েছিলেন সংবাদমাধ্যমের কাছে, ‘আমাদের ছেলেটাকে ড্রাগ থেকে বাঁচাতেই হবে।’

বস্তুত, ম্যারাডোনার জন্য এই আর্তিটাই ছিল সবার হৃদয়ের কথা। সেই হৃদয়ের একপাশে যদি থাকে তাঁর খেলা দেখে সাজানো ভালোবাসার অযুত ডালি, আরেক পাশে তাঁর জন্য দুশ্চিন্তা।

মানুষ যে ভালোবাসার ধনকে কোনোভাবেই হারাতে চায় না, মৃত্যু অমোঘ জেনেও হৃদয় বিরুদ্ধচারণ করে—যেন বলতে চায়, ম্যারাডোনাকে মাদকাসক্তি থেকে বাঁচাতে পারলে হয়তো আরও কিছুদিন...।

সত্যি বলতে, এমন জীবনকে তুলনা করা যায় মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের সঙ্গে। যার এক পাশে আনন্দ, আরেক পাশে ব্যাখ্যাতীত সব বিতর্ক, অপরিণামদর্শী জীবন। যেমন ধরুন, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার দুটি গোল—প্রথমটি যদি হয় শঠতার চূড়ান্ত উদাহরণ, পরেরটি প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। মিডফিল্ড থেকে একক প্রচেষ্টায় গোল।

এই যে অতিমানব থেকে সাধারণ, চূড়া থেকে অতল, বন্ধুর কিন্তু ভেতরে কোমল—এসব মিলিয়েই তো ডিয়েগো ম্যারাডোনা। পার্টি-ড্রাগ-বিতর্ক-বিপ্লব, আর হ্যাঁ বাঁ পায়ের জাদু। এই জাদুই তাঁর জীবন-মুদ্রার একপাশে দিয়েছে অমরত্ব, অপরপাশের রাশি রাশি বিতর্ক যেন সেই ‘আবেহায়াত’কে (অমরত্বের সুরা) করেছে আরও সুস্বাদু।

সমুদ্রে নৌ বিহারে মজেছেন ম্যারাডোনা। এমন ছবি এখন শুধুই স্মৃতি
ছবি: টুইটার

আর তাই নাপোলিতে ম্যারাডোনা ‘ঈশ্বরতুল্য’। একটা কথা আছে এমন—‘নাপোলিভক্তদের জন্য দলটা হলো ধর্ম আর ম্যারাডোনা ঈশ্বর।’ আর মেসির জন্মস্থান রোজারিওতে? সেখানেও আছে এক ধর্ম।

১৯৯৮ সালে ম্যারাডোনার ৩৮তম জন্মদিনে তাঁর ভক্তরা জন্ম দেন নতুন এক ধর্মের ‘ইগলেসিয়া ম্যারাডোনা।’ এই ধর্মেরই প্রতিষ্ঠাতাদের একজন আলেহান্দ্রো ভেরন বলেছিলেন, ‘যৌক্তিকভাবে আমি একজন ক্যাথলিক। কিন্তু হৃদয়ে ভালোবাসা দিয়ে একটি ধর্ম লালন করি—ডিয়েগো ম্যারাডোনা।’

অযুত-নিযুত মানুষের মনে ভালোবাসার ‘ধর্ম’ হিসেবে ঠাঁই পাওয়া এই মানুষটি তাঁর জীবনকে কীভাবে উপভোগ করেছেন তা নিদর্শন হতে পারে একটি অনুশীলনের চিত্র। সম্ভবত উয়েফা কাপে বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে ম্যাচের আগে।

মাঠে বাজছিল ‘হিপ হপ’ মিউজিক। ম্যারাডোনা তাঁর সতীর্থদের নিয়ে গা গরম করলেন একটু অন্যভাবে। বাজনার তালে তালে অনুশীলন। কখনো গা দোলাচ্ছেন কিংবা গানের তালে তালে বল রিসিভ করছেন।

বাঁ পায়ে বলটা এমনভাবে লুফে নিলেন যেন আকাশ থেকে ঈশ্বর ফুল পাঠিয়েছেন তাঁকে—ম্যারাডোনা এই অর্ঘ্য তুলে নেন আলতুশি পায়ের স্পর্শে। যেন সামান্য এই গা গরমকে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই, যেভাবে তিনি পাত্তা দেননি নিজের জীবনকেই!

কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে ম্যারাডোনা
ছবি: টুইটার

পাত্তা দেননি ১৯৯৪ বিশ্বকাপে গ্রিসের বিপক্ষে গোল করে সেই ভয়ংকর উদযাপনের পর ফিফার নিষেধাজ্ঞাকে। বরং মাদক নিয়ে নিষিদ্ধ হয়েও ফিফার নানা বিতর্কিত কাজের সমালোচনা করতে তাঁর কখনো এতটুকু বাঁধেনি। যেমন বাঁধেনি ডিফেন্ডারদের সামনে পেলে।

রাস্তায় দ্রুতগামী গাড়ি যেভাবে একে একে সবাইকে পেছনে ফেলে ছুটে যায় অভীষ্ট লক্ষ্যে—ম্যারাডোনার বাহারি সব ড্রিবলে টপকে গেছেন ডিফেন্ডারদের। কিন্তু মৃত্যুকে তো আর ড্রিবল করা যায় না—ম্যারাডোনা এই অমোঘ সত্য জেনেই বুঝি জীবনটাকে সাজিয়েছিলেন বল, সুরা, নারীসঙ্গ, দেশাত্মবোধের পানপাত্রে!

আর তাই, অনেকের জীবনটা বাস্তবে চরম হিসেবি হলেও শয়নে-স্বপনে তো কেউ কেউ এমন জীবনই চেয়ে থাকেন। যে জীবন কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর মানুষ কাঁদবে, ভালোবাসা আরও বাড়বে।

কে জানে, এই সব দিনরাত্রির কোনো খুদে ফুটবলার হয়তো মনে মনে স্বপ্ন দেখছে—ম্যারাডোনার মতো করে বাঁচতে চাই। কিংবা ম্যারাডোনাকে চর্মচক্ষুতে বা টিভি পর্দায় দেখা কোনো বুড়ো হয়তো ভাবছেন, এই আটপৌরে জীবনকে ছুড়ে ফেলে ম্যারাডোনার মতো করে যদি একবার বাঁচার স্বাদ নিতে পারতাম, একবার!

নাপোলিতে প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন ম্যারাডোনা
ছবি: টুইটার