ম্যারাডোনার জন্য কেঁদেছিল বাংলাদেশ
দৃশ্যপট ৩০ বছর আগের। ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল কিছুক্ষণ আগে হয়ে গেছে। বিতর্কিত এক পেনাল্টি–গোলে ডিয়েগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছে সে সময়ের পশ্চিম জার্মানি। আর্জেন্টিনা–ভক্তরা ক্ষুব্ধ মেক্সিকান রেফারি কোডেশাল মেন্ডেজের ওপর। শুধুই কি পেনাল্টি? গোটা ম্যাচেই যে একাধিক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তিনি। দুই আর্জেন্টাইন ফুটবলারকে দিয়েছেন লাল কার্ড। মহাপরাক্রমশীল জার্মানদের বিরুদ্ধে তাও দাঁতে দাঁত চেপে লড়েছে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। শেষ পর্যন্ত ওই পেনাল্টিতেই সব শেষ। ম্যাচ শেষে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন ম্যারাডোনা। রাগে–দুঃখে ফিফা সভাপতি জোয়াও হ্যাভালাঞ্জের সঙ্গে হাতও মেলালেন না। ম্যারাডোনার সেই কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা–ভক্তদের। ছুঁয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশকেও। তাঁর কান্নায় সে রাতে কেঁদেছিল পুরো বাংলাদেশ।
ম্যারাডোনার জন্য কী এক অদ্ভুত আবেগ অনুভব করেছে বাংলাদেশ। সব সময়ই। ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে গোটা বাংলাদেশেরই কায়মনো প্রার্থনা ছিল আর্জেন্টিনার জয়। সেটি যতটা না আর্জেন্টিনার, তার চেয়েও বেশি ম্যারাডোনার। রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্তে যখন সেটি হলো না, তখন ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছিল সারা দেশ। সাত সমুদ্র–তেরো নদী এপারের এই ছোট্ট ভূখণ্ড যেন পারলে মেক্সিকান রেফারি মেন্ডেজকে কাঁচা খেয়ে ফেলে। ম্যারাডোনার কষ্টে সম্পৃক্ততা প্রকাশ করে পোস্টার–ভিউকার্ডে ছেয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। বাড়িতে দরজায়, দেয়ালে শোভা পেত ম্যারাডোনার বিভিন্ন আঙ্গিকের ছবি, ম্যারাডোনার কান্নাভরা মুখ। এমন অবাক ভালোবাসার নজির পৃথিবীতে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সে সময় মিছিল হয়েছে বাংলাদেশে। রেফারি মেন্ডেজের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও—এমন স্লোগানও শোনা গেছে। ‘জার্মানির শিরোপা জয় মানি না মানব না’—এসব স্লোগানকে কী বলা যেতে পারে! ‘ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ ম্যারাডোনাকে ফিরিয়ে দাও’—একটা খেলোয়াড়কে কতটা ভালোবাসলে এমন স্লোগান দেওয়া যায়! আপাতদৃষ্টিতে এসব কাণ্ড হাস্যকর মনে হলেও ম্যারাডোনাকে যে এ দেশের মানুষ ভালোবাসেছে পাগলের মতো, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই।
১৯৯০–তে বিশ্বকাপ পেলেন না। ফাইনালে উঠে হেরে গেল আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার প্রতি মানুষের আবেগ কমল না এতটুকুও। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কি ভেবেছিল, চার বছর পর ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা আবারও কাঁদাবেন বাংলাদেশের মানুষকে! ’৯৪ বিশ্বকাপটা ম্যারাডোনার জন্য দুঃস্বপ্নের। নিষিদ্ধ ওষুধ সেবনের দায়ে তাঁকে বহিষ্কার করা হয় বিশ্বকাপ থেকে। গ্রুপ পর্বের তিনটি ম্যাচের মধ্যে প্রথম দুটি খেলেছিলেন। দুটি ম্যাচেই ছিল তাঁর নায়ক হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তৃতীয় ম্যাচের আগেই এল সেই দুঃসংবাদ। নিষিদ্ধ ম্যারাডোনা। এরপর যেন বাংলাদেশের বিশ্বকাপই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আবারও মিছিল, আবারও স্লোগান। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এসেছিল ম্যারাডোনার প্রতি সেই আবেগের কথা। অনেকটা হাস্য–কৌতুকের সঙ্গেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সাংবাদিকেরা তুলে ধরেছিলেন অনেক দূরের একটা ছোট্ট দেশের মানুষের ম্যারাডোনার প্রতি আবেগের কথা। সবাই অবাক হয়েছিল, যে দেশটার বিশ্বকাপ খেলার কোনো সম্ভাবনাই অদূর ভবিষ্যতে নেই, বিশ্ব ফুটবলেও যে দেশটার অবস্থান লেজের দিকে, সে দেশের মানুষ কীভাবে বাঁধভাঙা আবেগে ভেসে যায় আর্জেন্টাইন তারকাকে নিয়ে।
সেই আবেগের উৎস কোথায়? ম্যারাডোনার জাদুকরি দক্ষতা, ফুটবলশৈলী? নাকি অন্য কিছু! এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রতিভাবানদের সবাই ভালোবাসে। কারণ কি কেবল সেটিই? মনে হয় না। তাহলে তো সব প্রতিভাবানকে ঘিরেই একই আবেগ থাকার কথা। আসলে ম্যারাডোনা নিজেই এই অবাক ভালোবাসার কারণ। অবাক ভালোবাসাই তো জন্ম দেয় আবেগের। সব হাসি–আনন্দ ও কান্নার। বাংলাদেশের মানুষের সেই আবেগ, সেই কান্না, সেই হাসি–আনন্দ ম্যারাডোনার প্রতি নিখাদ ভালোবাসা থেকেই। যে ভালোবাসা হয়তো রয়ে যাবে তাঁর মৃত্যুর পরেও। বাড়ির আটপৌরে গিন্নি, গম্ভীর কর্তা থেকে শুরু করে ফুটবল না বোঝা নানি–দাদিরাও যে ম্যারাডোনা বলতে অজ্ঞান, সেই ভালোবাসার আসলেই কোনো ব্যাখ্যা নেই।
আক্ষেপ থেকেই গেল! ম্যারাডোনা কোনো দিন এলেন না বাংলাদেশে। অনুভব করতে পারলেন না ভালোবাসাটা। বাংলাদেশের মানুষের কান্না যে ফুটবলীয় আবেগকে ছাপিয়েও অন্য কিছু, সেটি জানলে হয়তো বারবারই তিনি ফিরে আসতে চাইতেন এ সুজলা, সুফলা, সবুজ–শ্যামল দেশটিতে।