মেসি একা কী করবেন?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরে একটা কথা বেশ ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেসব ম্যাচে বার্সেলোনা বা আর্জেন্টিনা খারাপ খেলে, কিন্তু মেসি একাই প্রাণপণ চেষ্টা করে যান, তা দেখে মেসিভক্তরা বলে উঠতেন 'মেসি একা কী করবে!'
সে আক্ষেপ দেখে মেসি যেসব ম্যাচে খারাপ খেলেন, তখন মেসি-বিরোধীরা আবার ওই একই কথা বলেন ঠাট্টার ছলে। কিন্তু গত রাতে লিওনেল মেসি নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দল জুভেন্টাসের বিরুদ্ধে যেভাবে খেললেন, তা তাঁর সতীর্থরা যা খেলা দেখালেন, তা দেখে আবারও মনে হতেই পারে— 'মেসি একা কী করবেন!'
গোটা ম্যাচে গোল বরাবর শট নিলেন সাতটা। আক্রমণভাগে নিখুঁত লং বল বাড়ালেন তিনটার মতো। পাঁচবার সফলভাবে ড্রিবলিং করে এগিয়ে গেলেন গোল করার উদ্দেশ্যে। সফল পাসের হার নব্বই শতাংশ। নিচে নেমে গেছেন বারবার। আদর্শ আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের মতো নিচে নেমে বল কুড়িয়ে এনে আক্রমণ তৈরি করেছেন। সতীর্থদের সঙ্গে ওয়ান-টু করে আবার বিপজ্জনকভাবে ঢুকে গেছেন ডিবক্সে, শট নিয়েছেন একের পর এক।
তা-ও দিন শেষে তাঁর দল পরাজিত। ৩-০ গোলে হেরেছে তাঁর দল। উল্টো গোলমুখের সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদোর কার্যকারিতা দেখেছেন নিষ্পলক চোখে। মেসিকে দর্শক বানিয়ে জোড়া গোল করেছেন রোনালদো, হোক না গোল দুটি পেনাল্টি থেকে।
মেসির তুলনায় রোনালদো বরং অনেক বেশি 'হিসেবি' ছিলেন শট নেওয়ার ক্ষেত্রে। মোটে চারটা শট নিয়েছেন, তিনটাই গোল বরাবর। দুটো থেকে তো গোলই হয়েছে। মেসিরই কপাল খারাপ। সতীর্থ মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেনের কিছু করার ছিল না রোনালদোর গোল দুটি আটকাতে। ওদিকে টাইম মেশিনে চড়ে জুভেন্টাসের গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফন যেন ফিরে গিয়েছিলেন এক দশক আগে।
যেভাবে মেসিকে একের পর এক গোলবঞ্চিত করেছেন, কে বলবে এই ভদ্রলোকের বয়স ৪২! কে বলবে এই লোক ইতালিয়ান লিগে ফি হপ্তায় পোলিশ তারকা ভয়চেখ সেজনির জন্য মূল একাদশে জায়গা পান না? কিংবদন্তি বুফন আবারও সবাইকে সেই চিরাচরিত বাক্যের অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছেন, 'ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পারমানেন্ট!'
অবশ্য রোনালদো হিসেবি খেলবেন না-ই বা কেন? প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে বার্সার কাছে ২-০ গোলে হারতে হয়েছে দেখেই কি না, এই ম্যাচে জুভেন্টাসের প্রত্যেকটা খেলোয়াড় যেন তেতে ছিল। বুফনের আগুনে ফর্ম তো ছিলই, যে রাইটব্যাকের সঙ্গে মেসির জুটি বেঁধে আক্রমণ শানানোর কথা, সে সের্হিনিও দেস্ত বোতলবন্দী হয়ে থাকলেন জুভের লেফট উইংব্যাক আলেক্স সান্দ্রোর আধিপত্যে।
আর্সেনাল থেকে নীরবে বেরিয়ে জুভেন্টাসে আসা অ্যারন র্যামসে আর বার্সায় কল্কে না পাওয়া আর্থুর মেলো নাচিয়ে ছেড়েছেন বার্সেলোনার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং আর আর্থুরের বদলে জুভ থেকেই বার্সায় যাওয়া মিরালেম পিয়ানিচকে। এই যদি হয় দলের অবস্থা, প্রশ্ন তো উঠতেই পারে, মেসি একা কী করবে!
শেষ দিকে বার্সার একাডেমির ছাত্র মিডফিল্ডার রিকি পুচের কল্যাণে মেসি একটু সাহায্য পেয়েছিলেন মাঝমাঠ থেকে। পুজ আর ডি ইয়ংয়ের খেলা দেখে মনে হয়েছে, ডি ইয়ং নয়, পুচকেই বুঝি সাড়ে সাত কোটি ইউরোর বিনিময়ে আয়াক্স থেকে এনেছিল বার্সা, আর পুচই বুঝি বার্সা একাদশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নিজেরা যে একদমই ভালো খেলেননি, সেটা বোঝা গেছে বার্সা তারকাদের কথায়। আঁতোয়ান গ্রিজমান তো নিজেদের পারফরম্যান্সের মধ্যে ভালো কিছুই পাচ্ছেন না, 'আমরা ঠিক সময়ে জ্বলে উঠতে পারিনি। জয়ের ইচ্ছা, মনোভাব, দৌড়ানো-রক্ষণ করা, কিছুই আমরা ঠিকমতো করিনি।'
কোনো ধরনের অজুহাতের ধার ধারতে চাননি গ্রিজমান, 'আমরা চাইলেই অজুহাত দিতে পারি কিন্তু সেটা দেব না। অজুহাতকে এক পাশে সরিয়ে রেখে আমাদের আরও ভালো খেলতে হবে, খাটতে হবে আরও।' টের স্টেগেনও একমত গ্রিজমানের সঙ্গে, 'আমাদের আরও খাটতে হবে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সমানে পরিশ্রম করে যেতে হবে। শুরু থেকেই ভালো খেলতে হবে আমাদের।'
খেলোয়াড়েরা তো বটেই, কোচ নিজেও বিরক্ত খেলোয়াড়দের খেলা দেখে, 'প্রথম তিরিশ মিনিটেই আমরা হেরে বসেছি। প্রথম থেকেই আমরা ভয়ে ভয়ে খেলেছি। জেতার কোনো ইচ্ছেই ছিল না, ছিল না সেই আগ্রাসী মনোভাব। জুভেন্টাস প্রেস করে গেছে, আমরা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি খেলা। রক্ষণের দিক দিয়েও আমরা ভালো ছিলাম না। দ্বিতীয়ার্ধে ভালো খেললেও, ম্যাচ হারা প্রথমার্ধেই হয়ে গিয়েছিল।'
ফর্মহীন এই খেলোয়াড়দের ভিড়ে মেসি একাই ছিলেন ভিন্ন স্রোতের কাণ্ডারি!