‘“ভণ্ড” ক্লপ রেফারিদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন’
আগামী রোববার মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে। বিশ্ব ফুটবলে যে ম্যাচে নজর থাকে সবচেয়ে বেশি ফুটবল দর্শকের, সেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুল ম্যাচ।
ঐতিহ্যের বাইরেও অন্য এক কারণে মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এ ম্যাচ। বহুদিন পর লিগ শীর্ষস্থানের লড়াই ঠিক করে দেওয়া এক ম্যাচে নামছে দুই মহারথী ক্লাব।
এবারের প্রিমিয়ার লিগে শীর্ষে ওঠা দলের সংখ্যা কম নয়। তবে প্রায় মাঝপথে চলে যাওয়া লিগ চমকে দিয়েছে ১৭ রাউন্ড শেষে। দেড় মাস আগেও চাকরি খোয়ানোর শঙ্কায় থাকা উলে গুনার সুলশার ইউনাইটেডকে শীর্ষে নিয়ে এসেছেন।
দুইয়ে থাকা লিভারপুলের চেয়ে ৩ পয়েন্টে এগিয়ে আছে দলটি। রোববার তাই জয় ছাড়া অন্য কোনো ফল লিভারপুলের কাছে প্রত্যাশিত নয়।
এ ম্যাচের আগেই ইউনাইটেডের ভাগ্য নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ক্লপ। গত মৌসুমেই প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পেনাল্টি আদায় করেছিল ইউনাইটেড।
এ মৌসুমেও পেনাল্টি ‘উপহার’ধারা চলছে তাদের। এ নিয়েই কথা বলেছেন ক্লপ। আর ক্লপের মন্তব্য প্রশ্নবিদ্ধ মনে হচ্ছে সাবেক রেফারি মার্ক ক্ল্যাটেনবার্গের। তাঁর ধারণা, পেনাল্টি নিয়ে কথা বলাটা একধরনের ভণ্ডামি। মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচের আগে রেফারিদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন লিভারপুল কোচ।
গত সপ্তাহে সাউদাম্পটনের কাছে হারের পর ক্লপ বলেছিলেন, ‘আমি শুনলাম, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড গত দুই বছরে যত পেনাল্টি পেয়েছে, সেটা আমার সাড়ে পাঁচ বছরে পাওয়া পেনাল্টি থেকে বেশি। আমার কোনো ধারণা নেই, আমার ভুলে এটা হচ্ছে নাকি কীভাবে সেটা হচ্ছে।’
ক্লপ ভুল বলেননি, ২০১৮-১৯ মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে ইউনাইটেড ৩২টি পেনাল্টি পেয়েছে লিগে। ওদিকে ২০১৫ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্লপের অধীন লিভারপুল পেয়েছে ৩০টি পেনাল্টি।
ইউনাইটেড কীভাবে এত বেশি পেনাল্টি পাচ্ছে, সেটার কোনো ব্যাখ্যা পরিসংখ্যান বা খেলার ধরন দিয়ে বের করতে অপারগ বিশ্লেষকেরা। গত পাঁচ বছরে শীর্ষ পাঁচ লিগে সবচেয়ে বেশি পেনাল্টি পেয়েছে ইউনাইটেড (৪৮)।
সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এরপরই জুভেন্টাস। তবে ব্যবধানটা বেশ বড়—১১। সাধারণত পেনাল্টি পাওয়ার পেছনে কয়েকটি বিষয় প্রভাব ফেলে। একটি দল কতটা দাপুটে খেলে, কত বেশি বল দখলে রাখে, দলটি প্রতি–আক্রমণে কত ভালো, সে দল প্রতিপক্ষের রক্ষণে কত বেশি ফাউল আদায় করে।
প্রিমিয়ার লিগেই প্রতিপক্ষের অঞ্চলে বল ধরায় ৫ নম্বরে আছে ইউনাইটেড, সব লিগ মিলিয়ে দশে। ফাউল আদায়ে ইউনাইটেড আছে দশে, প্রতিপক্ষের ডি–বক্সের আশপাশে অবশ্য ইউনাইটেডের অবস্থান ভালোই (৫)।
কিন্তু বল দখলে রাখা বা দাপুটে ফুটবলে শীর্ষ পাঁচে নেই দলটি। অর্থাৎ খেলার দাপুটে ছন্দে যে পেনাল্টি আদায় করছে দলটি, এটি বলা যাবে না কোনোভাবেই।
পেনাল্টি আদায়ে প্রতি-আক্রমণে ভালো হওয়াও প্রভাব ফেলে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে দাপট যাদের, সেই পিএসজি এ সময়ে পেনাল্টি আদায় করেছে ইউনাইটেডের অর্ধেকের কম।
প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটি, এমনকি উলভারহ্যাম্পটনও প্রতি–আক্রমণে ইউনাইটেডের চেয়ে এগিয়ে। তবু প্রতি ৩ ম্যাচে অন্তত একটি পেনাল্টি পাচ্ছে ইউনাইটেড! ক্লপ তাই এই ব্যাখ্যাতীত পরিসংখ্যান নিয়ে সবাইকে একটু ভাবতে বলছিলেন।
তবে ক্ল্যাটেনবার্গ ক্লপের দেখানো পথে হাঁটতে রাজি নন। তাঁর ধারণা, রোববারের ম্যাচে রেফারিদের চাপে রাখার জন্যই ক্লপ চাল চালছেন। এর মধ্যে তিনি কিংবদন্তি কোচ অ্যালেক্স ফার্গুসনের ছায়াও খুঁজে পাচ্ছেন।
রেফারিদের চাপে রেখে নিজের দলের পক্ষে সিদ্ধান্ত আদায় করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন ইউনাইটেডের স্কটিশ কোচ।
ডেইলি মেইলের কলামে ক্ল্যাটেনবার্গ বলেছেন, ‘ক্লপের মন্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার। প্রথমত, ইউনাইটেডের খেলোয়াড়েরা পেনাল্টি আদায় করার জন্য মুখিয়ে থাকে। এ ইঙ্গিত দিয়ে থাকলে তাঁকে ভণ্ড মনে হয়। মোহাম্মদ সালাহ এবং সাদিও মানেও এমন কৌশল প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখে।’
সাবেক রেফারির ধারণা, বড় ম্যাচের আগে দল নিয়ে আত্মবিশ্বাসী নন ক্লপ। আর এটাই তাঁর এমন কৌশলী হতে প্রভাব রাখছে, ‘এটা পরিষ্কার যে তিনি অস্থির হয়ে উঠেছেন। কারণ, ফার্গির পর আমি আর কাউকে দেখিনি বড় ম্যাচের আগে রেফারিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে। লিভারপুল গত মৌসুমে যখন প্রতি সপ্তাহে জিতছিল, তখন ক্লপ এমন কিছু করেননি। তিনি হারতে পছন্দ করেন না। কখনোই না। মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু উনি যদি বলেন, ইউনাইটেডের খেলায় এমন কিছু আছে যাতে সুবিধা পাচ্ছেন, তাহলে ভুল করছেন। ফার্গি যখন ছিলেন, তখন এমনটা হতো। কিন্তু উনি চলে যাওয়ার পর এটা ভালোভাবেই কেটে গেছে।’
ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষ ও রেফারিকে কোণঠাসা করার জন্যই ক্লপ এমনটা করছেন বলে ধারণা ২০১৬ চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ইউরো ফাইনালের দায়িত্বে থাকা ক্ল্যাটেনবার্গের, ‘এটা আসলে মনস্তত্ত্বের খেলা। ম্যাচের রেফারি পল টারনিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা। রোববার লিভারপুল ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে তাঁর মাথার ভেতর ঢোকার চেষ্টা।’
সাবেক রেফারি বলছেন, ইউনাইটেডকে সাহায্য করা হচ্ছে, এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা বলে লাভ নেই, ‘ক্লপ যখন বলেছেন, ইউনাইটেড দুই বছরে যত পেনাল্টি পেয়েছে, তাঁর লিভারপুল সাড়ে পাঁচ বছরে তত পায়নি, সেটা সঠিক। উনি বুদ্ধিমান। কারণ, এ মন্তব্যে কেউ তাঁর দোষ দেবে না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রেফারি বা কর্মকর্তাদের কোনো ষড়যন্ত্র নেই। ক্লপ কি বোঝাতে চাইছেন, ষড়যন্ত্র হচ্ছে? নাকি বলছেন, ইউনাইটেডের খেলোয়াড়দের ডাইভ দিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে? যদি প্রথমটার ইঙ্গিত দেন, তাহলে আমি এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। কারণ, সেটা সত্যি নয়। কিন্তু যদি তিনি বোঝাতে চান, ইউনাইটেডের কিছু খেলোয়াড় পেনাল্টি বক্সে সহজে পড়ে যায়, তাহলে আমার মনে হয় যুক্তিসংগত কথা। যদিও এ কথাও ভুলে যাচ্ছেন যে তাঁর কিছু তারকার ক্ষেত্রেও একই সন্দেহ করা হয়।’
ইউনাইটেডের আন্থনি মার্শিয়াল ও মার্কাস রাশফোর্ড ২০১৮-১৯ মৌসুমের পর থেকে ১৮টি পেনাল্টি আদায় করেছেন। ওদিকে লিভারপুলের সালাহ-মানে করেছেন ১৪টি। ক্ল্যাটেনবার্গের ইঙ্গিত কি সেদিকেই?