বিশ্বকাপে রেফারিরা যখন খলনায়ক
>ফুটবল বিশ্বকাপের মহাযজ্ঞে রেফারিরা কোন ভুল করে আলোচনায় আসবেন না, তা কি হয়? ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে এরকম উদাহরণ আছে অনেক, এর মধ্যে থেকে সবচেয়ে বিতর্কিত পাঁচটি ঘটনা আলোচিত হলো এখানে
ফুটবলে রেফারিংকে বলা হয় ‘ধন্যবাদহীন চাকরি’। কাজটা ভালো হলে কোনো ধন্যবাদ নেই। কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই সমালোচনার তির। মাঝে-মধ্যে ভুলের খেসারত রেফারিদের দিতে হয় খুব চড়া মূল্যে। রেফারিরাও অনেক সময় বিতর্কের জন্ম দেন। বিশ্বকাপের মঞ্চে রেফারিদের সেই ভুলগুলো অংশ হয়ে যায় ইতিহাসেরই। ইতিহাসের পাতা থেকে বিশ্বকাপের রেফারিং নিয়ে কয়েকটি আলোচিত ঘটনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো...
· জিওফ হার্স্টের ‘গোল’
ঘটনাটি ১৯৬৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও সে বিশ্বকাপে রেফারির এক ভুল আলোচনা ও বিতর্কের ঝড় তোলে আজও। ইংল্যান্ড ও পশ্চিম জার্মানির সে ফাইনালে হেলমুট হ্যালারের গোলে ১২ মিনিটে জার্মানরা এগিয়ে গেলেও ছয় মিনিট পরেই গোল করে ইংল্যান্ডকে সমতায় ফেরান জিওফ হার্স্ট। পরে ৭৮ মিনিটে মার্টিন পিটার্সের গোলে ইংল্যান্ড এগিয়ে গেলে তাদের জয়ের ব্যাপারে সবাই প্রায় নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ৮৯ মিনিটে জার্মান সেন্টারব্যাক উলফগ্যাং ওয়েবার ম্যাচে ফেরান পশ্চিম জার্মানিকে। খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। আসল ‘খেলা’ শুরু হয় তখনই! ইংলিশ মিডফিল্ডার অ্যালান বলের ক্রস থেকে বল পেয়ে হার্স্ট জোরালো শটে জার্মান গোলরক্ষক হ্যান্স তিলকোস্কিকে পরাস্ত করলেও সেটি গোলপোস্টে লেগে মাঠের ভেতরে চলে আসে। বলটা কি আদৌ গোললাইন অতিক্রম করেছিল? সুইডিশ রেফারি গটফ্রিট ডিয়েনস্ট প্রথমে সন্দিহান ছিলেন, পরে সোভিয়েত লাইনসম্যান তোফিক বাখরামভের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দেন বলটা গোললাইন অতিক্রম করেছিল। বর্তমান সময়ের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গোলটা দেখার পর এখন ব্যাপারটা মোটামুটি নিশ্চিত যে হার্স্টের শট গোললাইন অতিক্রম করেনি সেবার। বাখরামভ কেন সেদিন ডিয়েনস্টকে বলেছিলেন বল গোললাইন অতিক্রম করেছিল? মৃত্যুশয্যায় বাখরামভকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে বাখরামোভ উত্তর দেন, ‘স্তালিনগ্রাদ’। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মান নাৎসি বাহিনীর আগ্রাসনের কথা বাখরামভ ভুলতে পারেননি!
· রেফারিই যখন ম্যাচের নায়ক
ফ্রান্সেসকো টট্টি, আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো, জিয়ানলুইজি বুফন, জেনারো গাত্তুসো, ক্রিশ্চিয়ান ভিয়েরির ইতালি ২০০২ সালে জাপান-কোরিয়ায় গিয়েছিল বিশ্বকাপ জিততেই। কিন্তু সেই ইতালির বিদায় ঘণ্টা বেজে যায় দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে হারের সেই ম্যাচটিতে রেফারি নিয়ে উঠেছিল বিতর্কের ঝড়। ম্যাচের ১৮ মিনিটে ভিয়েরির গোলে ইতালি এগিয়ে গেলেও ৮৮ মিনিটে তা শোধ করে দেন কোরিয়ার সিউল কি-হিউন। পরে ১১৮ মিনিটের ‘গোল্ডেন গোলে’ ইতালিকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে ফেলেন আন জুন-হুয়ান। কিন্তু হুয়ান নন, এই ম্যাচে সবাই মনে রেখেছে রেফারি বায়রন মরেনোকে। সে ম্যাচে রেফারিং হয়েছিল রীতিমতো ন্যাক্কারজনক। এ জন্য তিনি হয়তো ইতালীয়দের গালি খান আজও। ইকুয়েডরের এই রেফারির কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্ত সেদিন ইতালিকে ভুগিয়েছিল। তিনি সেই সিদ্ধান্তগুলো ইচ্ছা করেই দিয়েছিলেন, নাকি ভুল করে—সেটি নিয়ে তর্ক হতেই পারে। অতিরিক্ত সময়ে ইতালির ড্যামিয়ানো টমাসি গোল্ডেন গোল করলেও তিনি অফ সাইড বলে তা বাতিল করেন। কিন্তু টেলিভিশন রিপ্লে দেখাচ্ছিল বড় ভুলই করেছেন রেফারি। বিনা কারণে লালকার্ড দেখান টট্টির মতো খেলোয়াড়কে।
হ্যান্ড অফ গড
বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে সমালোচিত গোল বোধ হয় এটাই। ফকল্যান্ড যুদ্ধের ক্ষত থাকতেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল আর্জেন্টিনা। ফকল্যান্ডের যুদ্ধে সাড়ে ছয় শর রও বেশি আর্জেন্টাইন নিহত হওয়ায় যেভাবেই হোক জেতার পণ করেই মাঠে নেমেছিল আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ৫১ মিনিটে ইংল্যান্ডের ডি বক্সে মিডফিল্ডার স্টিভ হজের ভুল ক্লিয়ারেন্সে বল চলে আসে ডিয়েগো ম্যারাডোনা ও ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের মাথার ওপরে। ম্যারাডোনা দেখলেন তাঁর চেয়ে লম্বা শিলটনকে হারানো যাবে না হেড করার লড়াইয়ে। তাই তিনি মুহূর্তের মধ্যেই হেড না করে বাম হাত দিয়ে বলটা ঠেলে দিলেন গোলপোস্টের দিকে। স্তব্ধ শিলটন দেখলেন হাত দিয়ে স্পর্শ করা বল গোলপোস্টে ঢুকে গেল। ইংলিশ খেলোয়াড়দের প্রতিবাদে কাজ হয়নি। রেফারি অনড় থাকেন তাঁর সিদ্ধান্তে। পরে ম্যারাডোনাকে এই গোল সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন ‘হ্যান্ড অব গড’ অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের হাত’ দিয়েই নাকি তিনি গোলটি করেছিলেন।
ল্যাম্পার্ডের না হওয়া সেই গোল
ইংল্যান্ড রেফারির ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয় আরও একবার। ছিয়াশির ‘হ্যান্ড অব গড’ ঘটনার ২৪ বছর পর। ২০১০ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষে সেই ম্যাচে লাইন্সম্যানের ভুলে বাতিল হয়ে যায় ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের একটি নিশ্চিত গোল। ম্যাচে ৩২ মিনিটের মধ্যে লুকাস পোডলস্কি আর মিরোস্লাভ ক্লোসার গোলে জার্মানরা ২-০ গোলে এগিয়ে যাওয়ার পর ৩৭ মিনিটে একটি গোল শোধ করেন ইংল্যান্ডের ম্যাথিউ আপসন।
তার ঠিক দুই মিনিট পরে ল্যাম্পার্ডের এক জোরালো শটে গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যারকে পরাস্ত হলেও তা ক্রসবারে লেগে গোললাইনের বেশ ভেতরে পরে। ইংলিশ দল গোল হয়েছে বলে উল্লাস শুরু করলেও উরুগুয়ের রেফারি তা বাতিল করে দেন। সেই গোলটি হয়ে গেলে ম্যাচের ফল অন্যরকম হতে পারত বলেই বিশ্বাস অনেক ইংলিশ সমর্থকের। ওই ঘটনার পর জার্মানি আরও ২ গোল করে ম্যাচটা জেতে ৪-১ গোলে।
· যে রেফারি হয়েছিলেন ম্যারাডোনাদের শত্রু
১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনাল অনেকের কাছেই ইতিহাসের সবচেয়ে বিরক্তিকর ফাইনাল হিসেবে পরিচিত। আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে হারিয়ে ১৯৭৪ সালের পর বিশ্বকাপ জেতে জার্মানি। সে ম্যাচে মেক্সিকোর রেফারি এডগার্ডো কোডেসাল মেন্ডেজ তাঁর কিছু সিদ্ধান্ত দিয়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া বিতর্কিত পেনাল্টিই সেবার বিশ্বকাপ জিতিয়েছিল জার্মানিকে। ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান সে ম্যাচে যেভাবে পেনাল্টি আদায় করেছিলেন, সেটি নিয়েও বিতর্ক আছে। আর্জেন্টিনাকে একটা ন্যায্য পেনাল্টি থেকেও বঞ্চিত করেন কোডেসাল। আর্জেন্টিনার দুই খেলোয়াড় পেদ্রো মনজন আর গুস্তাভো দেজোত্তিকে লালকার্ড দেখান। ম্যাচ শেষে ম্যারাডোনার কান্না বিশ্বকাপ ইতিহাসেরই অংশ হয়ে আছে।