পাতানো ম্যাচ বাংলাদেশের ফুটবলেরই একটা ক্যানসার। চ্যাম্পিয়ন হতে বা অবনমন ঠেকাতে সমঝোতার ভিত্তিতে পয়েন্ট দেওয়া-নেওয়া এ দেশের ফুটবলের পুরোনো রোগ। তবে হালে ঢাকার ফুটবলে থাবা পড়েছে অনলাইন বেটিংয়েরও। ক্যাসিনো–কাণ্ডে আগে থেকেই বিতর্কে থাকা আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের কিছু খেলোয়াড়-কর্মকর্তা জড়িয়ে পড়েছেন এই বেটিংয়ের সঙ্গে। ঢাকার ক্লাব ফুটবলের অন্ধকার অধ্যায়ের কথা এখন চলে গেছে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) কানেও।
অনলাইন বেটিংয়ের অভিযোগের ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) চিঠি দিয়েছে আরামবাগ ও ব্রাদার্সকে। আজ এর লিখিত জবাব দেওয়ার কথা আরামবাগের। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াকুব আলী অবশ্য আগেই বাফুফেকে মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন, যাঁরা তাঁদের ফুটবল দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তাঁদেরই অনলাইন বেটিংয়ের ব্যাপারে সন্দেহ করা হচ্ছে। অন্যদিকে ব্রাদার্সের ম্যানেজার আমের খান বলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, সেটি সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়ে বাফুফেকে পাল্টা চিঠি দিয়েছে ব্রাদার্স।
অনলাইন বেটিং কী
অনলাইন বেটিংয়ে শুধু একটি দলের জয়-পরাজয়ই নয়, কোনো দল ম্যাচে কতগুলো গোল খাবে, খেলোয়াড়েরা কয়টি কার্ড দেখবেন—এসব নিয়েও বাজি ধরা যায়। ইন্টারনেটে বিভিন্ন বেটিং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এটি চলে। বাংলাদেশের আইনে অনলাইন বেটিং নিষিদ্ধ।
আরামবাগ যেভাবে জড়াল
আরামবাগের দুই কর্মকর্তা, ভারতীয় কোচ ও কিছু খেলোয়াড়ের যোগসাজশে অনলাইন বেটিং হয়েছে বলে দাবি দলের একাধিক সূত্রের। বেটিংয়ের অভিযোগেই গত ফেডারেশন কাপের পর দলের ভারতীয় কোচকে বরখাস্ত করে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। একই অভিযোগে ১৪ ফেব্রুয়ারি ম্যানেজারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় গওহর জাহাঙ্গীরকে। আরামবাগের কোচ এবং কিছু খেলোয়াড়-কর্মকর্তার অনলাইন বেটিংয়ে জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে কয়েক দিন ধরে করা প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও।
চলতি প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে এখন পর্যন্ত ৯ ম্যাচ খেলে ৭ গোল করা আরামবাগ হজম করেছে সর্বাধিক ৩২টি গোল। এর আগে ফেডারেশন কাপের তিন ম্যাচে ৪ গোল করে তারা খেয়েওছিল ৪ গোল। ফেডারেশন কাপে একটি জয় পেলেও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত জয়শূন্য ক্লাবটি। অনলাইন বেটিংয়ে জড়িয়ে পড়ার কারণেই দলটি এখন বেশি গোল খাচ্ছে বলে মনে করেন দলের কিছু খেলোয়াড়।
ফেডারেশন কাপে আরামবাগের শেষ ম্যাচের পর দলের ৬ ফুটবলার ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলীর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সন্দেহের কথা জানান।
আরামবাগের সাবেক ভারতীয় কোচ সুব্রত ভট্টাচার্যের কিছু কর্মকাণ্ডই খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রথম সন্দেহ তৈরি করে। ডাগআউটে সঙ্গে মুঠোফোন রাখা নিষিদ্ধ হলেও ফেডারেশন কাপে ডাগআউটে তার সঙ্গে মুঠোফোন থাকত। গত ২৬ ডিসেম্বর উত্তর বারিধারার বিপক্ষে ম্যাচে কোচকে ডাগআউটে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে কথা বলতে দেখেন কয়েকজন খেলোয়াড়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খেলোয়াড় বলেন, ‘ম্যাচের শেষ দিকে তাঁকে গলার নিচে বুকের সামনে মোবাইল চেপে ধরে কথা বলতে দেখে অবাক হই। ক্রিস্টোফার (নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার) ও স্মিথের (অস্ট্রেলিয়ান ডিফেন্ডার) ব্যাপারে কী যেন বলছিলেন কোচ।’ সে ম্যাচে ২-৩ গোলে হারে আরামবাগ।
ফেডারেশন কাপ শেষে গত ৩ জানুয়ারি ভারতে ফিরে যান সুব্রত। যোগাযোগ করা হলে মুঠোফোন নিয়ে ডাগআউটে দাঁড়ানোর কথা প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তিনি বলেন, ‘আমার মোবাইল আমার পকেটেই থাকে। আমি মোবাইলে টাইমার দিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে স্টপওয়াচ দেখি। মোবাইলে আমি কোনো কথা বলিনি।’ সুব্রতর উল্টো অভিযোগ, ‘দেশে ফেরার আগে হোটেল রুম থেকে আমার মোবাইল চুরি হয়েছে। সিসিটিভিতে দেখা গেছে, আমার রুমে ক্লাবের লোকজন গিয়েছিল। কেন চুরি করা হলো, জানি না। হতে পারে আমার কাছে কিছু প্রমাণ ছিল।’
ফেডারেশন কাপে আরামবাগের শেষ ম্যাচের পর দলের ৬ ফুটবলার ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলীর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সন্দেহের কথা জানান। সাধারণ সম্পাদক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু খেলোয়াড় আমার কাছে এসে বিষয়টি জানায়। খোঁজ নিয়ে বুঝতে পারি, ভারতীয় গ্রুপটাই এর সঙ্গে জড়িত। আজিজুল, মাইদুল নামে দুজন ভারতীয় এজেন্ট ছিলেন, যাঁরা বিদেশি খেলোয়াড় ও কোচদের এনেছেন। পরে বুঝলাম, এই দুজনের সঙ্গে কোচও জড়িত। ওদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে বিদায় করে দিয়েছি।’
বেটিংয়ে সহায়তা করতে পারবেন, এমন খেলোয়াড়দের নিয়েই কোচ ও ক্লাবের দুই কর্মকর্তা দল গঠন করেন বলে জানিয়েছে দলের একটি সূত্র। সুব্রত যদিও দাবি করেছেন, তিনি বেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত নন, তবে তাঁর কথায়ও ইঙ্গিত মেলে ক্লাবের অন্যদের জড়িত থাকার, ‘নামগুলো (কর্মকর্তাদের) আমাকে দিয়ে বলাবেন না। খেলোয়াড়দের জিজ্ঞাসা করুন। আমার সামনে সাধারণত নীলফামারীর কর্মকর্তারা আসতেন। তাঁরা আমাকে তালিকা দিয়ে বলতেন, এই দল খেলাতে হবে।’
আরামবাগে নীলফামারীর কর্মকর্তা দুজন—মিনহাজুল ইসলাম ও গওহর জাহাঙ্গীর। বসুন্ধরা কিংস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিনহাজুল এই মৌসুমের আগে ক্লাবের জন্য পৃষ্ঠপোষকের ব্যবস্থা করে দল গঠনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এর আগে তিনি বসুন্ধরা থেকে চাকরিচ্যুত হলেও তা জানা ছিল না আরামবাগ কর্তৃপক্ষের। মিনহাজুল দল গঠনের আগ্রহ দেখালে আর্থিক সংকটে থাকা ক্লাবটি তাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। মিনহাজুল সঙ্গে নেন গওহরকেও এবং তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ফুটবল দলের ম্যানেজার ও সম্পাদকের। ভারতীয় কোচিং স্টাফ নিয়োগসহ দল গঠনের যাবতীয় কাজ তাঁদের মাধ্যমেই হয়েছে।
আরামবাগের সাবেক ভারতীয় কোচ সুব্রত ভট্টাচার্যের কিছু কর্মকাণ্ডই খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রথম সন্দেহ তৈরি করে।
প্রায় প্রতি ম্যাচের আগেই এই দুই কর্মকর্তা দলের নতুন কয়েকজন খেলোয়াড়কে নিয়ে আলাদা সভা করেন বলে জানান ক্লাবের একাধিক খেলোয়াড়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খেলোয়াড় বলেন, ‘যারা তাঁদের (মিনহাজুল ও গওহর) সঙ্গে মিটিং করে, তাঁরাই আমাদের কাছে এসে গল্প করেছেন। তাঁদের হাফ টাইমের আগে পাঁচটা থ্রো, তিনটা কর্নার করতে বলা হয়েছে।’ ওই খেলোয়াড়ের দাবি, দলের আরেক খেলোয়াড় তাঁকে প্রথমার্ধের আগে পাঁচটি কর্নার করতে বলেছেন। কথা অনুযায়ী কাজ করলে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয় তাঁকে।
প্রিমিয়ার লিগের প্রথম ম্যাচে মোহামেডানের কাছে ৩-০ গোলে হারে আরামবাগ। সে ম্যাচের আগের এক ঘটনা নিয়ে দলের আরেক খেলোয়াড় বলেন, ‘আমাকে মিনহাজ ভাই হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে আসতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তুই শুধু ওকে বলবি।” সেখানে বিদেশি একজন ছিল।’
১৩ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জে (ঢাকার বাইরে প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচ হয় মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা ও টঙ্গীতে) হওয়া ম্যাচে আবাহনীর কাছে ৪-০ গোলে হারে আরামবাগ। পরদিন ম্যানেজারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় গওহরকে। ইয়াকুব আলী জানান, মিনহাজুলের অভিযোগের ভিত্তিতেই তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নেন। তবে গওহরও সাধারণ সম্পাদকের কাছে মিনহাজুলের বিরদ্ধে বেটিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন বলে জানিয়েছেন ইয়াকুব।
অভিযুক্তরা যা বললেন
অনলাইন বেটিংয়ে জড়িত থাকার সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গওহর ও মিনহাজুল। গওহর বলেন, ‘আমার সামনে বেটিং–সংক্রান্ত কোনো কথাই হয়নি।’ ম্যানেজারের পদ থেকে নিজেই সরে দাঁড়িয়েছেন বলে দাবি তাঁর। আর মিনহাজুল বলেছেন, ‘কে কী বলছে, জানি না। আমি এ দলটাকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।’ কোনো খেলোয়াড়ের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলে কথা বলেননি বলেও তাঁর দাবি, ‘এগুলো বোগাস কথা।’
গওহর জাহাঙ্গীরের অভিযোগের আঙুল আবার দলের গোলরক্ষক আবুল কাশেমের দিকে। কাশেম বেটিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন, এমন সন্দেহ থেকেই নাকি ৯ ফেব্রুয়ারি শেখ রাসেলের বিপক্ষে ম্যাচের শুরুতে তাঁকে নামানো হয়নি। তবে কাশেম বলেছেন, ‘এগুলোর সঙ্গে আমি কোনো দিন জড়িত ছিলাম না, জানিও না। তারা যদি প্রমাণ দিতে পারে, দিক।’
ম্যাচগুলোর ব্যাপারে দুই ক্লাবের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে এরই মধ্যে তা পেয়েও গেছে বাফুফে
অভিযোগ ব্রাদার্সের বিরুদ্ধেও
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম গতকাল প্রথম আলোকে জানান, আরামবাগের পাশাপাশি ব্রাদার্সের বিরুদ্ধেও আছে ম্যাচ পাতানো এবং অনলাইন বেটিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগ। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রিমিয়ার লিগের আরামবাগের তিনটি ও ব্রাদার্সের দুটি ম্যাচের সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ নিয়ে কাজ করছি। ম্যাচগুলো পাতানো, স্পট ফিক্সিং বা অনলাইন বেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ আছে। এএফসিও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত।’
ম্যাচগুলোর ব্যাপারে দুই ক্লাবের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে এরই মধ্যে তা পেয়েও গেছে বাফুফে। ‘পাতানো ম্যাচ শনাক্তকরণ কমিটি পরবর্তী সময়ে বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে’ বলেছেন আবু নাঈম। আরামবাগের যে তিনটি ম্যাচের ব্যাপারে বাফুফে অভিযোগ পেয়েছে, সেগুলো ছিল মোহামেডান, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র ও আবাহনীর বিপক্ষে। ব্রাদার্সের সন্দেহজনক ম্যাচ দুটি আবাহনী ও বসুন্ধরা কিংসের বিপক্ষে।