বঙ্গবন্ধু বললেন, এই ছেলেটা কী খেলবে রে...
>১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার বিখ্যাত ফুটবল টুর্নামেন্টে মারদেকা খেলতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল গেল গণভবনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফুটবলারদের অভ্যর্থনা জানান। দলের সবচেয়ে ছোট খেলোয়াড় আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নুকে দেখে বলেন, ‘এ তো ছোট। কী ফুটবল খেলবে রে...’
ছোট্ট একটা স্মৃতি। অথচ কী বিশাল! সারা জীবন মনে রাখার মতো। আজকের দিনে যেমন বিশেষভাবে মনে পড়ছে সাবেক ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নুর। তিনি তখন সদ্যই নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা নবীন এক ফুটবলার। ১৯৭৪ সালে রহমতগঞ্জের জার্সিতে কিছু ম্যাচ খেলা হয়েছে।
অল্প দিনেই চুন্নু ঢুকে গেলেন ১৯৭৫ সালে মারদেকাগামী জাতীয় দলে। সেই দল গণভবনে গেল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর শুভেচ্ছা নিতে। জাতীয় দল তখন দেশের বাইরে খেলতে গেলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার অলিখিত রেওয়াজ ছিল। এই সুযোগেই বাংলাদেশের ফুটবলারদের জীবনে ধরা দিল বিরল এক ক্ষণ। সেই দলে একেবারেই নতুন মুখ ছিলেন ৫ জন। মোহামেডানের শামসুল আলম মঞ্জু, ব্রাদার্সের হাসানুজ্জামান বাবলু, শহীদউদ্দীন সেলিম, আবাহনীর আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু ও রহমতগঞ্জরে আবু ইউসুফ।
ফটোসেশনে সবার চেয়ে ছোট চুন্নু ফটোসেশনে বসলেন বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে। এ এক বিশেষ মুহূর্ত। সবার মনে রোমাঞ্চ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কিছুটা অবাক। সংগঠক হারুনুর রশিদ ও শেখ কামালকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই ছোট্ট ছেলেটা (চুন্নু) খেলতে পারবে তো?’ শেখ কামাল তাঁর আব্বাকে বলেন, ‘ও ভালো খেলবে আব্বা।’ সেদিন জাতীয় দলের এক নবীনের ওপর আস্থা রেখেছিলেন শেখ কামাল। বলা যেতে পারে নক্ষত্রের আলোটা আগেই দেখতে পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে। চুন্নুও সেই আস্থার প্রতিদান দেন। ’৭৫-’৮৮ সাল পর্যন্ত টানা আবাহনীতে খেলে অবসরের আগ পর্যন্ত মাঠ কাঁপান। আন্তর্জাতিক ফুটবলে তিনিই বাংলাদেশের প্রথম হ্যাটট্রিকম্যান। সেটি ছিল ১৯৮৩ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে নেপালের বিপক্ষে। স্ট্রাইকার না হলেও শেখ আসলামের আগে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক গোল এই লেফট উইঙ্গারের। ব্যক্তিগত হিসেবে তাঁর আন্তর্জাতিক গোল ২১টি।
সে যাই হোক, ক্যারিয়ারে শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়া মানে চুন্নুর মনে তখন খেলে যাচ্ছে শিহরণ। জাতির স্থপতির বাসভবনে এসেছেন। তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন। আজ বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী শুরুর দিকে বাংলাদেশের ফুটবলে অন্যতম বড় নাম আশরাফ উদ্দিন চুন্নু আপ্লুত। মারদেকা যাওয়ার আগের সেই স্মৃতি তুলে এনে বলেন, ‘দিনটা কখনোই ভোলার নয়। আমি ঠিক ওনার পায়ের সামনে বসেছিলাম। দলে নতুন ডাক পেয়েছি। মাত্র ১৬-১৭ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর মতো প্রবল ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপ্রধানের আশীর্বাদ পাওয়া আমার জীবনে অমূল্য এক স্মৃতি।’
সেই সফরে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। জাতীয় দলে সেটিই তাঁর প্রথম অধিনায়কত্ব পাওয়া। ১৯৭৫ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচটি খেলে মারদেকায়। ইন্দোনেশিয়ার কাছে হার ৪-০ গোলে। এরপর থাইল্যান্ডের সঙ্গে ১-১ ড্র। জাপান ও মালয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে হার। তৎকালীন বার্মার কাছে ৭-১ এবং হংকংয়ের কাছে ৯-১ গোলে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ শেষ ম্যাচেও হারে। কোরিয়া রিপাবলিকের কাছে এই হার ছিল ৪-০ গোলে। টুর্নামেন্টটা ভালো যায়নি বাংলাদেশের। প্রাপ্তি বলতে আন্তর্জাতিক ফুটবলের স্বাদ।
আজকের মতো তখন এত ম্যাচ খেলত না জাতীয় দল। দেখা যেত বছরের একটি বা বড়জোর দুটি টুর্নামেন্ট খেলছে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর বাংলাদেশ প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলে এই মারদেকাতেই, ১৯৭৩ সালে। পরের বছর আর আন্তর্জাতিক ম্যাচই খেলা হয়নি। ’৭৫ সালে গিয়ে মারদেকায় ৭টি ম্যাচ খেলা হয়েছে। এবং শেষ ম্যাচটি কোরিয়ার সঙ্গে মাঠে নামার আগেই খবর আসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় বসে বাংলাদেশের ফুটবলাররা ম্যাচটি খেলতে চাননি। তবে শেষ পর্যন্ত আয়োজকদের অনুরোধে তাঁরা মাঠে নামেন।
এসবই আজ ইতিহাসের পাতায় লেখা ঠাঁই নিয়েছে। কিন্তু স্মৃতিগুলো নিরন্তর আপ্লুত করে ফুটবলারদের। চুন্নুর সঙ্গে সেই সফরে যাওয়া নবীন আরেক ফুটবলার হাসানুজ্জামান বাবলু পেছন ফিরে বলছিলেন, ‘রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে দেখা হওয়া, কথা বলা, এসব স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। ১৫ আগস্টের কদিন আগে আমরা গণভবনে যাই। উনি বললেন,‘‘ তোরা আমার সঙ্গে আয়। উনি ওনার বাড়ির সামনে লেকের পাড়ে সিঁড়ির মধ্যে নিয়ে নিয়ে গেলেন আমাদের। হাত দিয়ে পানিতে নাড়া দিলেন। অনেক মাছ চলে এল। তখন উনি বলেছিলেন, দেখ, মাছ আমার কথা শুনে। উনি প্রতিদিন মাছদের খাওয়া দিতেন। বলেছেন, তোরা ভালো খেলবি। দেশের জন্য ভালো খেলবি। শৃঙ্খলা রাখবি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে হাত মেলানো আমার জীবনে সেরা অর্জন।’
সেই দেখার কয়েক দিন আগেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় এই ফুটবলারদের। মারদেকায় যাওয়ার আগে বাংলাদেশ দলের ক্যাম্প চলছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের জিমনেশিয়ামের দোতলায়। সেখান থেকেই শেখ কামালের বিয়েতে যান ফুটবলাররা। হাসানুজ্জামান বাবলু বলছিলেন, ‘গণভবনে ভিড়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, তোরা এই সময় আসছিস। তোদের কোথায় বসাব, কোথায় খাওয়াব। আমরা পরে ফিরে আসি এবং তিনি আমাদের সঙ্গে খাওয়া পাঠান ক্যাম্পে।’
বঙ্গবন্ধু নিজেও ফুটবল খেলেছেন। গায়ে তুলেছেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের জার্সি। আজ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী শুরুর মাহেন্দ্রক্ষণে গোটা ফুটবল সমাজ এবং ক্রীড়াঙ্গন তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।