‘ফুয়েরসা দিয়েগো’— প্রার্থনায় আর্জেন্টিনা

৬০তম জন্মদিনটা এবার তাঁর খুব একটা ভালো কাটেনি। কাটবেই-বা কীভাবে! ডিয়েগো ম্যারাডোনা মানে চারপাশে হাজারো-লাখো ভক্ত। ম্যারাডোনা মানে তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বাস। ম্যারাডোনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ পরিবারের কাছে থাকা, পরিবারের ভালোবাসা।

কিন্তু করোনার কারণে এবার জন্মদিনটা একলা কেটেছে ছিয়াশি বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির। সব মিলিয়ে মন খারাপ ছিল আর্জেন্টাইন ফুটবল-ঈশ্বরের। শরীর আগে থেকেই একটু খারাপ ছিল, সেটি ঠিক রাখার জন্য কড়া ওষুধের ডোজও পড়েছে। এর মধ্যে চিরদিনের বন্ধুরূপী শত্রু হয়ে থাকা অ্যালকোহল তো ছিলই! সেদিন হয়তো একটু বেশি পান করে ফেলেছিলেন ম্যারাডোনা। ফল? আরও খারাপ শরীর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ম্যারাডোনা। মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারও হয়েছে তাঁর। মস্তিষ্কে রক্ত জমাট (ক্লট) বেঁধে ছিল।

ম্যারাডোনার জন্য প্রার্থনায় পুরো আর্জেন্টিনা।
ছবি: টুইটার

সর্বশেষ খবর, অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। অস্ত্রোপচারের ধাক্কাও প্রাথমিকভাবে সামলে নিয়েছেন ম্যারাডোনা। প্রথম রাতটা কোনো ঝামেলা ছাড়াই কাটিয়েছেন বলে জানাচ্ছে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টস। আর যাঁকে মহাতারকা ছাপিয়ে পূজনীয় করে মাথায় তুলে রেখেছে আর্জেন্টাইনরা, সেই ম্যারাডোনার এমন খবর আর্জেন্টিনা জুড়ে মানুষের দুই হাত প্রার্থনায় উঠে যাওয়াই অনুমিত। তা-ই হয়েছে। হাসপাতালের সামনে মানুষের কণ্ঠে, ব্যানারে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগে—চারদিকে একই সুর, ‘ফুয়েরসা দিয়েগো।’ বাংলায় অর্থটা অনেকটা দাঁড়ায়—সৃষ্টিকর্তা আপনাকে শক্তি দিন, ডিয়েগো।

মঙ্গলবার আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে একটা বেসরকারি ক্লিনিকে ম্যারাডোনার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাঁর ব্যক্তিগত ডাক্তার লিওপোলদো লুক জানিয়েছেন, ‘সফলভাবে ক্লটটা সরাতে পেরেছি আমরা। অস্ত্রোপচারের সঙ্গে ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছেন ডিয়েগো।’ ম্যারাডোনাকে নিয়ে লুক অভয়ও দিচ্ছেন, ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। রক্ত সরে যাচ্ছে। তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।’

শরীরটা আগে থেকেই ভালো ছিল না ম্যারাডোনার।
ছবি: রয়টার্স

শরীর ভালো না থাকায় সোমবার ম্যারাডোনার শরীরে কিছু পরীক্ষার জন্য তাঁকে প্রথমে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে স্ক্যানে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট ধরা পড়ে। গত ১০-১৫ বছরে দুবার হার্ট অ্যাটাক করা আর হেপাটাইটিসে ভোগা ম্যারাডোনা করোনায় আক্রান্ত কি না, সেটিও পরীক্ষা হয়েছিল আগেই।

ম্যারাডোনা হাসপাতালে শুনে হাসপাতালের বাইরে ভিড় করেছেন তাঁর ভক্তরা। ‘সর্বকালের সেরা ফুটবলারের পাশে থাকতে আমি আর আমার স্ত্রী চলে এসেছি’—সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলছিলেন অস্কার মেদিনা নামের এক ভক্ত। ম্যারাডোনা অসুস্থতায় মেদিনার দুঃখ অনেক, ‘তাঁর স্বাস্থ্য আরেকবার ম্যারাডোনাকে ভোগাল। তবে মানুষের প্রার্থনা আর তাঁর অ্যান্টিবডি সেটি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। খুব খারাপ লাগছে, কিছু করতেও পারছি না। তবে তিনি সেরে না ওঠা পর্যন্ত তাঁর পাশেই থাকব আমরা।’

ম্যারাডোনাকে নিয়ে অবশ্য ভয় আরেকটু কাটতে পারে নিউরোসার্জন রাউল মাতেরার কথা শুনলে। আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টসে মাতেরা বলেছেন, ‘রক্ত সরিয়ে নিতে ছোট্ট একটু কাটাকাটি করতে হয় অস্ত্রোপচারে। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই রোগী হাসপাতাল ছাড়তে পারেন।’

তবে ম্যারাডোনার জীবনাচরণের কারণেই এই অবস্থা হয়েছে বলে জানালেন লুক। অন্য যেকোনো বারের মতো ৬০তম জন্মদিনে এবার সন্তানদের সবাইকে পাননি ম্যারাডোনা। সেটি নিয়ে কিছুটা মন খারাপ তো ছিলই, তার ওপর অ্যালকোহলের অভ্যাস তো ছিলই। মাঝে কিছুদিনে আবার গুঞ্জন উঠেছিল, ম্যারাডোনা কোকেনেও ফিরেছেন আবার! লুক সেসব নিয়ে বলেননি, শুধু বলেছেন, ‘তিনি একজন বয়সী মানুষ, যাঁর জীবনে অনেক চাপ আছে। এই সময়টাতে সবার তাঁকে সাহায্য করা উচিত। ম্যারাডোনা হওয়াটা সহজ নয়।’ ২০০৫ সালে গ্যাস্ট্রিক বাইপাস সার্জারির কারণে ম্যারাডোনার অ্যামিনিয়ার ঝুঁকি বেড়েছে বলেও জানালেন লুক।

ম্যারাডোনার জন্য ভালোবাসা জানিয়ে সমর্থকদের ভিড়।
ছবি: রয়টার্স

এই সময়েও অবশ্য ম্যারাডোনাকে ঘিরে টানাটানি শুরু হয়েছে। গতকাল তাঁর সাবেক স্ত্রী ও দুই মেয়ে জিয়ান্নিনা আর দালমার মা রোসিও অলিভা অভিযোগ করেছিলেন, ভেরোনিকা ওহেদার সঙ্গে তাঁর বর্তমান পরিবারের সদস্যরা জিয়ান্নিনা ও দালমাকে দেখা করতে দেননি ম্যারাডোনার সঙ্গে। তবে আজ টিওয়াইসি স্পোর্টস জানিয়েছে, জিয়ান্নিনা হাসপাতালে ম্যারাডোনার সঙ্গে দেখা করেছেন। সেখান থেকে বের হয়ে জিয়ান্নিনার টুইট, ‘মাত্রই ক্লিনিক থেকে বের হলাম। আমার বাবা, আমার বোন আর আমাকে নিয়ত ভালোবাসা জানানোর জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। যাঁরা তাঁর জন্য প্রার্থনা করছেন, তাঁদেরও ধন্যবাদ।’

ম্যারাডোনার ভাই উগো ম্যারাডোনা অবশ্য ম্যারাডোনার সেরে ওঠার পরের সময় নিয়ে সন্দিহান। টিওয়াইসি স্পোর্টসে হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘নিশ্চিত আগামীকাল ও আবার উল্টোপাল্টা করা শুরু করবে। ও সবার বড় কিন্তু দেখে মনে হয় ও-ই সবার ছোট!’

তবে সেটার আগে সেরে উঠতে তো হবে ম্যারাডোনাকে। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির সাবেক মুখপাত্র কোপোলা সেটি নিয়ে বলছিলেন, ‘পরিবার আর মাঠ—এ দুটোই পারে ম্যারাডোনাকে বাঁচাতে।’