প্রযুক্তির কাটাছেঁড়া: কেন পারল না ব্রাজিল?
কত কত প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় এখন ফুটবল মাঠে। এসব প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে চলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। ফুটবল বিশ্লেষণে বিশ্বখ্যাত অপটার প্রযুক্তি-সাহায্য নিয়ে প্রথম আলো অনলাইন বিশ্বকাপের বড় ও আলোচিত ম্যাচগুলো বিশ্লেষণ করে দেখছে। নতুন ধারাবাহিক ‘প্রযুক্তির চোখে’র দ্বিতীয় পর্ব। গতকালের ব্রাজিল-সুইজারল্যান্ড ম্যাচ নিয়েই আজকের আয়োজন
গতকালের ব্রাজিল-সুইজারল্যান্ড ম্যাচটা পর্যবেক্ষণ করলে আমরা পুরো ম্যাচে দুটো ভাগ দেখতে পাই।
এক-গোল দেওয়ার আগে ব্রাজিলের খেলা
দুই-গোল দেওয়ার পর ব্রাজিলের খেলা
গোল দেওয়ার আগে ব্রাজিলের খেলা ছিল দৃষ্টিনন্দন। গ্যাব্রিয়েল জেসুস, নেইমার, উইলিয়ান ও ফিলিপ্পে কুতিনহো চতুষ্টয় চোখধাঁধানো ফুটবলের পসরা সাজিয়ে মুহুর্মুহু আক্রমণ করে যাচ্ছিলেন সুইজারল্যান্ডের রক্ষণভাগে। খেলায় গতিও ছিল বেশ। ব্রাজিলের ডিফেন্সের ডান দিকে যেহেতু দানি আলভেজ নেই, ওপ্রান্ত থেকে খেলার সৃষ্টিশীলতা আনার জন্য সে রকম কেউ ছিলেন না। এই সৃষ্টিশীলতার অভাবটুকু ঘোচানোর জন্যই কোচ তিতে উইং অবস্থান থেকে সরিয়ে কুতিনহোকে মিডফিল্ডের বাঁ দিকে নিয়ে এসেছিলেন, আর কুতিনহোর জায়গায় (রাইট উইং) খেলিয়েছিলেন উইলিয়ানকে।
কুতিনহো মিডফিল্ড থেকে তাঁর কাজটা যথাসাধ্য করার চেষ্টা করেছেন। ডি-বক্সের একটু বাইরে থেকে ডান পায়ের গোলার মতো শটে ব্রাজিলের গোলটিই তার প্রমাণ। এ রকম গোল এর আগেও লিভারপুল বা বার্সেলোনার জার্সি গায়ে অসংখ্যবার করেছেন তিনি, তবে ফুটবলে বোধ হয় কিছু কিছু জিনিস থাকে, যেগুলো অবশ্যম্ভাবী জানা সত্ত্বেও প্রতিপক্ষ তা আটকানোর জন্য কিছু করে না বা করতে পারে না; উল্টো মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকে সেই শিল্পের সার্থক রূপায়ণ দেখে। যেমন ডান উইং থেকে ডি-বক্সের ভেতরে ধীরে ধীরে ঢুকে বাঁ পায়ের জোরালো শটে ডাচ উইঙ্গার আরিয়ান রোবেনের গোল। কুতিনহোর এই ট্রেডমার্ক গোলটা এ রকমই কিছু। সবাই জানেন, ওই অবস্থান থেকে কুতিনহো শট নেবেন, আর শট নিলেই গোল হবে, তবু প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা আটকাতে পারেন না!
পুরো ম্যাচে ৮৯ বার বল টাচ করা কুতিনহোর সফল পাস দেওয়ার হার ৮৯.৬ শতাংশ। আক্রমণে বেশ ভালোই সঙ্গ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু গোল খাওয়ার পরেই ব্রাজিল সবচেয়ে বড় যে ভুলটা করে বসে, তা হলো অযথাই খেলার গতি একটু কমিয়ে দিয়ে রক্ষণাত্মক হয়ে যাওয়ার চেষ্টা। ওদিকে হুট করে একটি গোল পেয়ে যাওয়া সুইস খেলোয়াড়েরাও যেন অপেক্ষাকৃত অধিক রক্ষণ করতে থাকা ব্রাজিলের ওপর চড়াও হতে থাকেন, নেইমারের ওপরও।
ভুলে যাওয়ার মতো একটা ম্যাচ খেলেছেন ব্রাজিলের মূল তারকা নেইমার। ব্রাজিল দলের মূল খেলোয়াড় হবার ‘সুবাদে’ সুইজারল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা একদম কড়া মার্কিংয়ের মধ্যে রেখেছিলেন তাঁকে। বিশেষ করে ভালোন বেহরামি। শান্তিমতো একটু জায়গা নিয়ে নেইমারকে খেলতেই দেননি তিনি। পুরো ম্যাচে নেইমার ফাউলের শিকার হয়েছেন ১০ বার, যা গত ২০ বছরে বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই কড়া ট্যাকলিংয়ের মধ্য থেকে নেইমার সফল পাস দিয়েছেন ৮৬.৫ শতাংশ, যদিও নেইমারের পাস না দিয়ে অযথাই বল নিয়ে কারিকুরি করার প্রবণতাটা দৃষ্টিকটু লেগেছে অনেক। খামাখা কারিকুরি না করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোল করার জন্য অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা উইলিয়ান, জেসুস বা কুতিনহোকে সময়মতো পাস না দেওয়াটা ভুগিয়েছে ব্রাজিলকে। ওদিকে নিজের নেওয়া চার শটের মধ্যে মাত্র দুটো গোলমুখে মারতে পেরেছেন নেইমার। যদিও গোলের সম্ভাবনা সৃষ্টি করার জন্য ‘কি পাস’ দিয়েছেন চারটি।
আক্রমণভাগের চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বাজে খেলেছেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস। জেসুসের কাঁধে এবার ব্রাজিলের মূল স্ট্রাইকার হওয়ার ভার, মূল স্ট্রাইকার হিসেবে রোনালদো-রোমারিওর কীর্তিগুলো ছোঁয়ার গুরুদায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনের প্রথম পরীক্ষায় কি আসলেও উতরেছেন জেসুস? পুরো ম্যাচে মেরেকেটে শট মারতেই পেরেছেন একটা, তা-ও গোলমুখে নয়! পুরো ম্যাচে এতটাই খারাপ খেলেছেন জেসুস যে তাঁকে ফাউল করার প্রয়োজনবোধই করেননি সুইসরা! আর এক নেইমারকেই ফাউল করা হয়েছে ১০ বার, নেইমারকে ফাউল করার জন্য হলুদ কার্ডের সতর্কবাণী পেতে হয়েছে সুইজারল্যান্ডের তিন-তিনজন খেলোয়াড়কে—অধিনায়ক স্টিফেন লিখটস্টেইনার, বেহরামি ও ফাবিয়ার শার।
বিশ্বকাপের আগেই সন্দেহ করা হচ্ছিল, বাছাইপর্বে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ব্রাজিল বিশ্বকাপে হোঁচট খেলে সেটা তিতের কৌশলের জন্যই খেতে পারে। সেটাই প্রথম ম্যাচে দেখা গেল যেন। জেসুস নিষ্প্রভ থাকার পরেও বিকল্প স্ট্রাইকার রবার্তো ফিরমিনোকে নামাতে দেরি করেছেন তিতে, শেষ ১১ মিনিটেই গোলমুখে দুটো শট নিয়ে ফিরমিনো কোচকে যেন নিঃশব্দেই জানিয়ে দিলেন, প্রথম থেকে খেললে ম্যাচের ফল হয়তো অন্য রকম হতেও পারত!
তিতের কৌশলের আরেকটা বড় ফাঁক ছিল মিডফিল্ডে দুজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার খেলানো। ৪-৩-৩ ছকে বাছাইপর্বে নিশ্চিন্তে এই কাজটা তিতে করতে পেরেছিলেন। কারণ, ডান দিক ও বাঁ দিক থেকে দানি আলভেজ ও মার্সেলোর কাছ থেকে সেই সৃষ্টিশীলতা পেয়েছিলেন। এখন যেহেতু আলভেজ নেই, মিডফিল্ডে এমন একজনকে দরকার ছিল, যিনি মিডফিল্ডে থেকেই খেলার গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন নিখুঁত পাস দিয়ে। যে ক্ষতিটা পোষানোর জন্যই মূলত উইং থেকে মিডফিল্ডে আনা হয়েছিল কুতিনহোকে।
কুতিনহো তাঁর কাজটা করলেও আক্রমণে উঠে যাওয়ার প্রবণতার কারণে প্রায় সময়ই মিডফিল্ডে দুই আদর্শ রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার পাওলিনহো ও কাসেমিরো একা পড়ে যাচ্ছিলেন। মিডফিল্ড থেকে সফল পাসের বিচ্ছুরণ ঘটানোর মতো খেলোয়াড় ছিলেন না। পরে রেনাতো অগাস্তো নেমেও লাভ হয়নি কোনো।
নেইমারকে বোতলবন্দী করেই যে ব্রাজিলকে নিষ্প্রভ রাখা যায়, প্রথম ম্যাচে সেটা একদম হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছে সুইজারল্যান্ড ১-১ গোলে ড্র করে। গ্রুপের বাকি দুই দল সার্বিয়া আর কোস্টারিকা বিষয়টা অবশ্যই লক্ষ করেছে।
তিতে নিজে লক্ষ করেছেন তো?