পেয়ালায় ডুবে মরলেন দেবদূত
২২ অক্টোবর, ২০০১। সেদিন আফগানিস্তান হামলা, অ্যানথ্রাক্স জীবাণু কিংবা বিশ্বকাপে খেলা না খেলা নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না ব্রাজিলিয়ানদের। পেয়ালায় ঝড় তুলেছিল রগরগে এক কাহিনী। তার বিস্তারিত এখানে না লেখাই ভালো। শুধু এটুকু জানতে পারেন। কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এক বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ কিছুর আকার। গারিঞ্চার!
ব্রাজিলে রিও ডি জেনিরো থেকে দূরবর্তী গ্রাম পাউ গ্রান্দে'র সমাধিস্থলে চিরঘুমে তিনি। কবির (ভিনিসিয়াস ডি মোরায়েস) চোখে গারিঞ্চা বাঁকানো পায়ের দেবদূত, কারও কাছে ছোট পাখি, কেউ ডেকেছেন 'জয় অব পিপল' বা জনগনের আনন্দ। তাঁর খেলার সঙ্গে এ কথার সাযুজ্যই সবচেয়ে বেশি। গারিঞ্চা ব্রাজিলিয়ানদের কাছে আপনজন। ঘরের ছেলে।
ফুটবল, সাম্বা, নারী, কাশাচা, সুমদ্র, সৈকত, মোটাদাগে এই তো একজন ব্রাজিলিয়ানের জীবন! গারিঞ্চার জীবনে সুমদ্রটা ড্রিবলিংয়ের, সৈকত নারীর। মানুষকে 'সুমদ্র' দেখিয়ে কাশাচায় চুর হয়ে পড়ে থেকেছেন সেই 'সৈকতে'। এভাবে একদিন টের পেলেন- তিনি নিঃসঙ্গ, কর্পদকশূন্য, যে কি না খুনীও!
অনুশোচনার ঢেউয় টিকতে না পেরে হলো আত্মহত্যার চেষ্টা। সবাই তা পারে না। মুখ তুলে তাকালেন সৃষ্টিকর্তা। তুলে নিলেন পঞ্চাশ পেরোনোর আগেই। দেহাবশেষ থেকে গেল রাইজ দে সেরা সমাধিস্থলে। বিতর্ক আছে। গারিঞ্চার দুটো কবর, দেহাবশেষ কোনটায়, কোথায়?
২০১৪ বিশ্বকাপে জানা গেল, পাহাড়ি সেই সমাধিতে তবু পড়ে থাকে কাটা মুরগি। গ্রামের লোকজন জাদুটোনা করে। গারিঞ্চা থেকে গেছেন তাঁদের কাছে, সহজাত ড্রিবলারদের গল্পে, অপরিণামদর্শী জীবনের ফোয়ারায় ডুবে যাওয়াদের কাতারে। তাঁর জীবন-মুদ্রার এক পিঠ যদি হয় ড্রিবলিং, বিশ্বকাপ জয়, আরেক পিঠ তবে নারীসঙ্গে মত্ত, কাশাচায় চুর, গাদা গাদা সন্তানের এক পিতার ছবি। সে কেমন ছবি?
আসক্তি ছিল তাঁর রক্তেই। ভীষণ দরিদ্র পরিবারে বাবা ছিলেন মদ্যপ। ভাগ্য সুবিচার করেনি। গারিঞ্চা নিজেও করেননি নিজের প্রতি। শরীরের মেরুদন্ড ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট। অনেকটাই ইংরেজি 'এস' আকৃতির। ডান পা বাইরের দিকে বাঁকানো ছিল। বাম পা ছিল ডান পা থেকে ছয় সেন্টিমিটার ছোট ও ভেতরের দিকে ঘোরানো। এমন শারীরিক গড়নের কেউ রমনীমোহন হওয়া দূরে থাক কখনো যে হাঁটতে পারবে, চিকিৎসকেরা সেই আশাও করেনি। অবশ্য ফুলনিও গোত্রে বেশিরভাগ মানুষের পা অমনই ছিল। গারিঞ্চার পূর্ব পুরুষেরা যে আমাজনের এই আদিবাসি গোত্রের, তা জানিয়েছেন ব্রাজিলিয়ান লেখক অ্যালেক্স বেলোজ।
আখের রস থেকে বানানো অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় কাশাচা ছিল গারিঞ্চার ভীষণ প্রিয়। বাস্তব-বোধবুদ্ধি বলতে যা বোঝায়, সেসব তাঁর ছিল না। ফুটবল-দর্শনেও অদ্ভুত সারল্য। খেলাটা শুধুই উপভোগের, আর ছিল কাশাচা। মাঠে নামার আগে, বিরতিতে, মাঠ থেকে বেরিয়ে তো বটেই।
১৯৫৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের মনোবিদ তাঁর প্রতিবেদনে লেখেন, গারিঞ্চার বুদ্ধিমত্তা শিশুদের পর্যায়ে। আক্রমণাত্মক মানসিকতা শূন্য। আইকিউ টেস্ট ও শারীরিক পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। সে সময় গারিঞ্চার বয়স ২৫ বছর।
মাঠে ডান পাশ দিয়ে ড্রিবলিং ছাড়া আর কিছু বুঝতেন না। এ নিয়ে অবিশ্বাস্য সব গল্প আছে। আর বুঝতেন নারীসঙ্গ। গারিঞ্চার মাঠের বাইরের জীবনকেও স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল ব্রাজিলিয়ানরা। যেন এ আর নতুন কী! ব্রাজিলে জীবন মানেই তো উপভোগ।
নাইর মারকুয়েস তা টের পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। নাইর গারিঞ্চার জীবনে প্রথম নারী। ছেলেবেলার প্রেয়সী। পরিণতিতে বিয়ে। নাইর অন্তঃস্বত্তা হয়ে পড়ায় ১৮ বছর বয়সে তাঁকে বিয়ে করেন গারিঞ্চা। খেলার বাইরে এমনিতে তাঁর শরীরে ছিল রাজ্যের আলস্য। পাউ গ্রান্দের কারখানা থেকে এই আলসেমির জন্যই হন চাকরিচ্যূত। কারখানার মালিকের ক্লাব ছিল। বাধ্য হয়েই গারিঞ্চাকে ফের নিতে হয় কারখানায়। কারখানাকর্মী নাইরের সঙ্গে পরিচয় এখান থেকেই। দুজনে মিলে প্রায় এক যুগের মধ্যে নিয়ে আসেন ৮টি নতুন মুখ। গারিঞ্চার প্রণয়ের খাতায়ও এ সময় যোগ হয় নিত্য-নুতন মুখের সমাহার।
রোনালদিনহোকে নিয়ে বই লেখা ইংরেজ লেখক জেথরো সউতার গার্ডিয়ানে লিখেছিলেন, 'গারিঞ্চা পান করেছে গলা পর্যন্ত, ফূঁকেছে ইচ্ছেমতো আর কোথাও গেলে প্রথমেই খোঁজ নিয়েছে স্থানীয় পতিতালয়ের।
নাম না জানা সেসব বার-বণিতার সঙ্গে যোগ হয়েছে চেনা-জানা নামও। কিন্তু এসবের বিপরীতে বিয়ে মাত্র তিনটি! নাইরের সঙ্গে সংসার ভেঙে নতুন করে ঘর বেঁধেছিলেন ব্রাজিলের কিংবদন্তি সাম্বা গায়িকা এলজা সোয়ারেসের সঙ্গে। ঘরের বাইরে ছিলেন ইরাচি ও অ্যাঞ্জেলিতা মার্টিনেজ। প্রথমজন ব্রাজিলের সহকারি প্রেসিডেন্টের সাবেক প্রেমিকা ও অভিনেত্রী। নাইর পঞ্চম সন্তান জন্ম দেওয়ার দিন গারিঞ্চার প্রথম সন্দান গর্ভে আসার ঘোষণা দেন ইরাচি।
মার্টিনেজ ছিলেন গায়িকা ও 'শো গার্ল'। ও হ্যাঁ, বোটাফোগো ইউরোপ সফরে গেলে সুইডেনে জুটিয়ে নিয়েছিলেন স্থানীয় এক তরুণী; ভ্যান্ডারলে। তাঁর সন্তান উলফ লিন্ডবার্গের বাবার নামও গারিঞ্চা। এই লিন্ডবার্গ সহ গারিঞ্চার বৈধ সন্তান সংখ্যা অন্তত ১৪ জন। কেউ কেউ বলেন সংখ্যাটা আসলে ৩৬। কিন্তু এর পক্ষে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না।
সুইডেন বিশ্বকাপ জয়ের পরের বছর ১৯৫৯ সালে ভ্যান্ডারলের সঙ্গে সখ্য হয় গারিঞ্চার। বোটাফোগো সুইডেন সফরে থাকতে সতীর্থদের সঙ্গে গারিঞ্চা একদিন বেরিয়ে পড়লেন। স্থানীয় পতিতালয়ে যাওয়ার অভ্যাস থাকলেও সেদিন গিয়েছিলেন ভ্যান্ডারলের বাসায়। পরদিন হোটেলে হাজির দুই নারী পুলিশ কর্মকর্তা। গারিঞ্চাকে খুঁজছেন। সবাই ভাবল নিশ্চিত কিছু ঘটিয়ে এসেছে। গারিঞ্চাকে ধরে নিয়ে যাবে! ভুল। তাঁরাও গারিঞ্চার সখ্য চায়। বাবার পয়-পরিচয় থাকলে সুইডিশ সরকার তখন একক মায়েদের পেনশন দিত।
গারিঞ্চার জীবনে এলজার আগমন ১৯৬২ সালে চিলি বিশ্বকাপে। ১২ বছর বয়সে ধর্ষকের সঙ্গে জোরপূর্বক বিয়ের ফাঁদে পড়া এলজা নিজের প্রথম তিন শিশু সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি। চিলি বিশ্বকাপের আগেই দুজনের পরিচয়। এলজা বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখতে গিয়ে মন দিয়ে বসেন। গারিঞ্চা তাঁকে ভালোবেসে বলেছিলেন 'তোমাকে বিশ্বকাপ এনে দেব।' বাকিটা ব্রাজিলের শোকেসে।
গারিঞ্চা এলজাকে ধরে রাখতে পারেননি। সাম্বার রানি, আর ফুটবলের রাজা। রাজ-যোটক। গারিঞ্চার সংসার ভেঙে যাওয়ায় শুরুতে এলজার ওপর খেপেছিল সাধারণ ব্রাজিলিয়ানরা। পরে সব ঠিক হয়ে আসে। কিন্তু গারিঞ্চা হননি। সহ্যের শেষ সীমায় গিয়ে এলজাও বুঝিয়ে দেন, আগুনের কাছে গিয়েও মোম সব সময় গলে না।
গারিঞ্চার জঘন্য ড্রাইভিং ছিল এর শেকড়। নেশাতুর হয়ে একবার বাবার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেন। এলজাও দাঁত হারিয়েছেন স্বামীর স্টিয়ারিংয়ে ভরসা রেখে। হারিয়েছেন মা কে-ও।
আগের সন্তানদের দেখতে এলজার মা কে সঙ্গে নিয়ে গারিঞ্চা যাচ্ছিলেন পাউ গ্রান্দেতে। ফেরার পথে নেশার ঘোওে গাড়ি লাগিয়ে দেন একটি লরির সঙ্গে। এলজার মা মারা যান সেই দূর্ঘটনায়। অনুশোচনায় দগ্ধ গারিঞ্চার জীবন এরপর পুরোপুরি ঢুকে পড়ল মদের বোতলে। আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন কয়েকবার। এর মধ্যে ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশনের কাছে একবার বাড়ি বানাতে টাকা ধার চাইলেন। কেউ সাড়া দেয়নি। ঠিক সেদিনই তিনি লাপাত্তা। খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল রিও সিটি সেন্টারে গির্জার সামনে অসহায়ের মতো কাঁদছেন।
অ্যালেক্স বেলোজের কলমে উঠে এসেছে গারিঞ্চার অর্থকড়ির প্রসঙ্গও। একবার বন্ধু-বান্ধব মিলে গারিঞ্চাকে খুব করে ধরল। আর্থিক বিষয়াদির খেয়াল রাখতে কাউকে নিয়োগ দাও। এদিকে গারিঞ্চার সরলতা ব্রাজিলে সবাই জানে। সুযোগটা নেয় বোটাফোগো। চুক্তিপত্রে কিছু না দেখেই সই করতেন গারিঞ্চা। অঙ্কটা বসাতো বোটাফোগো।
আর্থিক বিষয়াদি নিয়ে কথা বলতে দুজন ব্যাংক প্রতিনিধি একবার পাউ গ্রান্দে-তে গারিঞ্চার বাসায় গেলেন। বাসা না বলে বস্তি বলাই ভালো। গিয়ে তারা দেখলেন আলমারির তাক থেকে অন্যান্য আসবাবের পেছনে, ফলের বাটির মধ্যে, ম্যাট্রেসের নিচে টাকা-পয়সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকতে থাকতে বেশিরভাগই পচে গেছে কিংবা পোকায় কাটা।
এলজা ভেবেছিলেন জায়গা পাল্টালে হয়তো গারিঞ্চাও পাল্টে যাবেন। রোমে চলে গেলেন দুজন। গায়িকা হিসেবে এলজার ব্যস্ততা বাড়ল। তবে গারিঞ্চার চুমুক দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। খেলা ছেড়েছেন বহুদিন। কোচিং? অরণ্যে রোদন। ব্রাজিলিয়ান কফি ইনস্টিটিউট তাঁকে 'কফি দূত' বানিয়েছিল। কাজ-টাজ কিছু নেই। শুধু ধোপ-দুরস্থ পোশাকে হেসে হেসে হাত মেলাতে হবে। বোলোনিয়ায় ব্রাজিলিয়ান কফি প্রদর্শনীতে এক ইতালিয়ান তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ব্রাজিলের এই কফি কি ভালো? গারিঞ্চার জবাব, 'জানি না। কখনো খাইনি। তবে ব্রাজিলিয়ান কাশাচা দুর্দান্ত জিনিস!'
গারিঞ্চার সারল্যের আড়ালে লুকায়িত জীবনকে ততদিনে পোকায় কাটতে শুরু করেছে। এলজাকে মাতৃহারা করার যন্ত্রণাটা আর নিতে পারছিলেন না। ১৯৭৬ সালে এলজার কোল আলো করে গারিঞ্চা জুনিয়র এলেও সংসার টেকেনি। অনুশোচনা ও মদের মিশ্রণে চারপাশে নরক সৃষ্টি করে রাখা স্বামীর মার খেতে শুরু করলেন এলজা। পরিণতিতে ভেঙে গেল ১৫ বছরের ঘর-সংসার।
গারিঞ্চা নতুন আরেকটি গড়ে নিলেন। তৃতীয় বউ উপহার দিল ফুটফুটে মেয়ে। গারিঞ্চা সেই শিশু, বাকিসব সন্তান, বউ, বান্ধবীসহ সবাইকে উপহার দিলেন মনে রাখার মতো এক তারিখ, ১৯ জানুয়ারি, ১৯৮৩।
অভ্যাসমতো সেদিন সকালে পান করতে বের হলেন। বাসায় ফিরলেন বিকাল নাগাদ। নেশায় চুর এবং অসুস্থ। স্থানীয় হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স পাঠাল। চিকিৎসকেরা তাঁকে চিনতে পারছিলেন না। মদের প্রভাবে শরীরটা একদম থলথলে। অ্যালকোহলিক কোমায় চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হলো মানসিক হাসপাতালে। পরদিন সকাল ৬টায় গারিঞ্চা শেষ ড্রিবলিংটা করলেন।
বেলোজের ভাষায়, গারিঞ্চা মারা যাওয়ার পর জাতীয় আত্মগ্লানিতে ভুগেছিল ব্রাজিল। আয়তাকার সবুজ গালিচায় আনন্দ দিয়ে যাওয়া মানুষটির এমন মর্মান্তিক মৃত্যু! সেই অনুশোচনাবোধ আর মাঠে পাওয়া আনন্দের প্রাপ্তিস্বীকার হিসেবেই সম্ভবত মারাকানায় কফিন পৌঁছানোর পর, সেখান থেকে পাউ গ্রান্দে পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের ঢল নেমেছিল।
সমাধিফলকে লেখা হয়, 'এখানে শান্তিতে ঘুমোনো মানুষটি এক সময় মানুষকে আনন্দ দিয়েছেন-মানে গারিঞ্চা।'
অপরিণামদর্শী আর আত্মঘাতী হলেও ব্রাজিলিয়ানদের কাছে এই আনন্দটুকুই সম্ভবত জীবনের মহিমা। বেলোজের ভাষায়, 'ব্রাজিল কিন্তু (যদিও পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন) জয়ীদের দেশ নয়, লোকে সেখানে আনন্দ ভালোবাসে। আর তাই পেলেকে ওরা পছন্দ করলেও ভালোবাসে গারিঞ্চাকে।'