নেইমারকে ছাপিয়ে ব্রাজিলের সেরা তারকা কি এখন ভিনিসিয়ুস
রিয়াল মাদ্রিদ বনাম পিএসজি। বেনজেমা, মদরিচ, ভিনিসিয়ুস বনাম মেসি, নেইমার, এমবাপ্পে। জিবে জল এনে দেওয়া লড়াইয়ের সম্ভাবনা নিয়েই আসছে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোর এই দ্বৈরথের দ্বিতীয় কিস্তি। রিয়ালের মাঠে বাংলাদেশ সময় আজ রাত ২টায় দ্বিতীয় লেগে মূলত আলোটা কিলিয়ান এমবাপ্পের ওপরই। সেটি প্রথম লেগে তাঁর গোলেই পিএসজি ১-০ ব্যবধানে জিতেছে বলে নয়, পিএসজিতে চুক্তি শেষে আগামী মৌসুমে তাঁর রিয়ালে যোগ দেওয়ার ‘সর্বজনবিদিত গোপন’ গুঞ্জনের কারণেও। তবে এই ম্যাচই কি ব্রাজিল দলে ভবিষ্যতের রূপরেখা ঠিক করে দেবে? বিবিসির বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য -
খবরটা শুনতেই ফোন হাতে নিলেন প্যারিস সেন্ট-জার্মেইয়ের ক্রীড়া পরিচালক লিওনার্দো। ফোন করলেন নেইমারকে। গত অক্টোবরে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডিএজেডএনে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে যখন পিএসজির ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো দামি তারকা বললেন, এই বছরের বিশ্বকাপই হতে যাচ্ছে তাঁর শেষ, অন্য সবার মতো লিওনার্দোও বিস্মিত। নেইমার কারণ কী দেখালেন? ফুটবলের দাবির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মতো মানসিক শক্তি তাঁর কতদিন থাকবে, সে নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন।
এর কয়েক মাস আগেই নেইমার ও পিএসজি চুক্তিটা ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছে। লিওনার্দোকে মূল উৎস থেকেই তাই আসল কথাটা জানতে হতো। জানতে হতো, তাঁর স্বদেশী মহাতারকা আসলে এই কথা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন! নেইমারের কাছের লোকেরা দ্রুতই লিওনার্দোর উদ্বেগ কমাতে উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁদের অভিযোগ, ডিএজেডএনই নেইমারের কথাগুলোকে উল্টো ব্যাখ্যা করেছে।
কিন্তু গত মাসে যখন ব্রাজিল কিংবদন্তি রোনালদো নাজারিওর সঙ্গে টুইচে (ভিডিও সম্প্রচার মাধ্যম) কথা বলছিলেন নেইমার, ব্রাজিলের বর্তমান নাম্বার টেন আবার জানিয়ে দিলেন তাঁর অবসর-পরিকল্পনার কথা, ‘বন্ধুদের মজা করে বলি যে আমি ৩২ বছর বয়সে অবসর নিয়ে নেব। তবে সেটা শুধু মজা করেই বলা। আমি জানি না (সত্যিই কখন অবসর নেব)। সত্যি বলতে যতদিন মন ক্লান্ত না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত খেলে যাব।’
অক্টোবরের পর ফেব্রুয়ারি—নেইমারের সাক্ষাৎকারগুলোই একটা ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে যে, কদিন আগে মাত্র ৩০তম জন্মদিনের কেক কাটলেও নেইমার এরই মধ্যে নিজের সেরাটা দিয়ে ফেলেছেন, ফুটবলটাও আর আগের মতো ভালো লাগে না তাঁর।
আজ বার্নাব্যুতে চ্যাম্পিয়নস লিগে যখন মুখোমুখি হবে রিয়াল মাদ্রিদ ও পিএসজি, নেইমারকে ঘিরে থাকা আলোচনা-গুঞ্জনে আরও ডালপালা যোগ হচ্ছে। একটি ডালে, হয়তো সবচেয়ে বড় ডালেই জড়িয়ে ভিনিসিয়ুস।
রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান সেনসেশন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র এই মুহূর্তে আছেন জীবনের সেরা ছন্দে। মৌসুমে এরই মধ্যে ১৬ গোল করেছেন—আগের তিন মৌসুমে তাঁর গোলের যোগফলের চেয়েও বেশি। নেইমারের উল্টো দিকেই আজ থাকছেন তিনি। একটা ধারণা দিন দিন আরও জোর পাচ্ছে যে, মাঠে ফুটবল পায়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা ভিনিসিয়ুস নেইমারকে ছাপিয়ে ইউরোপে খেলা সেরা ব্রাজিলিয়ানের মুকুট নিজের করে নেওয়ার পথেও ছুটছেন জোর কদমে।
প্রতি সপ্তাহে ভিনিসিয়ুস যা করে যাচ্ছে, তাতে ও-ই যে এই মুহূর্তে ইউরোপে খেলা ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে সেরা, এ নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই
পরিসংখ্যান সে ধারণায় সায় দেয়। তবে নেইমারকেই আদর্শ মেনে ফুটবল নিয়ে ছোটা ভিনিসিয়ুস আজ নেইমারকে ছাপিয়ে যেতে পারেন কি না, সে প্রশ্ন এ ম্যাচের আকর্ষণ বাড়াবে। প্রথম লেগে প্যারিসের মাঠে শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে ১-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা রিয়ালের ব্যবধান ঘুচিয়ে ভিনিসিয়ুস মাদ্রিদের কূলীনদের শেষ আটে তুলতে পারবেন?
ভিনিসিয়ুস তৈরি? কতটা?
তাঁকে বর্ণনায় স্প্যানিশ পত্রিকা এল মুন্দো একবার লিখেছিল, ভিনিসিয়ুস এমন একজন ‘উইঙ্গার যাঁর পা আর পায়ের পাতা একতালে দৌড়ায় না।’ একের পর এক সহজ সুযোগ হারানোয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক ‘মিম’-এ জায়গা করে নিয়েছেন ভিনিসিয়ুস। এই মৌসুমে কার্লো আনচেলত্তির অধীনে সেই ২১ বছর বয়সী ভিনিসিয়ুসের পায়েই ফুটবল অসাধারণ সুর তুলছে। তাল-লয়-মাত্রায় মনে গেঁথে যাওয়ার মতো সে সুর।
২০১৭ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সী ভিনিসিয়ুসের জন্য কেন ৪৫ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে রিয়াল, সেটি অবশেষে বোঝাতে শুরু করেছেন ‘ভিনি।’ পাঁচ বছর আগে তাঁকে পেতে রিয়ালের মরিয়া ভাবকে মনে করা হতো ‘পরবর্তী নেইমার’ খুঁজে বের করার চেষ্টা, এখন সেটিকে মিথ্যা প্রমাণ করে নেইমারকেও ছাপিয়ে যাওয়ার সুযোগ ভিনিসিয়ুসের সামনে। তা-ও ভরা বার্নাব্যু গ্যালারির সামনে!
ব্রাজিলও তো এদিকে তাকিয়ে থাকবে!
‘বর্তমান ফর্ম বিবেচনায় ভিনিসিয়ুস আর নেইমারের মধ্যে মাদ্রিদে ম্যাচটার ভাগ্য বদলে দেওয়ার প্রশ্নে ভিনিসিয়ুসই অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে আছে’—বিবিসিকে বলছিলেন ব্রাজিলের বিখ্যাত ফুটবল বিশেষজ্ঞ পাওলো ভিনিসিয়ুস কোয়েলহো। ‘আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ওরা কে কোন অবস্থায় থাকবে সেটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। তবে প্রতি সপ্তাহে ভিনিসিয়ুস যা করে যাচ্ছে, তাতে ও-ই যে এই মুহূর্তে ইউরোপে খেলা ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে সেরা, এ নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। নেইমার সাধারণত মৌসুমের শুরুটা ভালো করে, পরে মিইয়ে যায়। এবার অবশ্য উল্টোটা করার জন্যও যথেষ্ট সময় ওর হাতে আছে’—কোয়েলহোর বিশ্লেষণ।
এক বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেছে চ্যাম্পিয়নস লিগে গোল পাননি নেইমার, সর্বশেষ গোল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ইস্তাম্বুল বাসাকসেহিরের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকে। এই মৌসুমে এ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগে ৫ ম্যাচে গোল না পাওয়া নেইমারকে নিয়ে পিএসজি ভক্তদের কিছুটা হতাশা থাকতে পারে, তবে তাঁর মান নিয়ে সংশয় সম্ভবত কারও নেই।
সংশয় যা, সেটি নেইমারের চোটমুক্ত থাকা নিয়ে। তাঁর পিএসজি ক্যারিয়ারই যে চোটে জেরবার। ২০১৭ সালের আগস্টে তিনি পিএসজিতে যাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ফরাসি ক্লাবটি যে ২৫৫ ম্যাচ খেলেছে, এ চোট-ও চোটে লম্বা সময়ের জন্য মাঠের বাইরে যাওয়া নেইমার তার মধ্যে খেলতে পেরেছেন মাত্র ১৩৪টি! গত মাসে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে প্রথম লেগেও নেইমারকে খেলতে দেয়নি চোট।
নেইমার একদিকে চোটে যুঝেছেন, এদিকে গত এক বছরে মাদ্রিদে পাদপ্রদীপের আলো নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন ভিনিসিয়ুস। ইএসপিএনের ফুটবল বিশ্লেষক লিওনার্দো বের্তোজ্জির বিশ্লেষণ, ‘গত এক বছরে খেলাটায় ভিনিসিয়ুসের পরিচিতি অবশ্যই অনেক বদলে গেছে। এক বছর আগেও ওর রিয়াল মাদ্রিদের মূল খেলোয়াড়দের একজন হয়ে ওঠা নিয়ে নিঃসংশয় ছিলাম না আমরা। (রিয়ালের ডাগআউটে) আনচেলত্তির আগমন ওর খেলায় অনেক বড় প্রভাব রেখেছে। আনচেলত্তির আস্থা অর্জন করে নিয়েছে ও, নিয়মিত খেলছে, আক্রমণে করিম বেনজেমার সঙ্গে দারুণ একটা জুটি গড়ে তুলেছে।’
তবে নেইমারকে ভিনিসিয়ুস ছাপিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে এখনো পরিমিতি ধরে রাখছেন বের্তোজ্জি, ‘এখনো অনেক দূর যাওয়ার বাকি আছে ওর। তাই আমার মনে হয় না আমরা এখনো ব্যাটন হাতবদল করার প্রক্রিয়ায় এসে গেছি।’
ভিনিসিয়ুস আছে, নেইমারের কী দরকার
নেইমারের হয়েছে এক যন্ত্রণা, ক্যারিয়ারের বড় একটা অংশজুড়েই তা ছিল। যা-ই করেন, সবার মন জয় করা হয়ে ওঠে না তাঁর। মাঝে মাঝে দেখে মনে হতে পারে, নেইমার আর ব্রাজিলভক্তদের সম্পর্কটা এমন অবস্থানে চলে গেছে, যেখান থেকে ফিরে আসার কোনো পথ নেই। ভিনিসিয়ুসের উঠে আসা পরিস্থিতি কি একটু জটিল করে দিয়েছে নেইমারের জন্য? হয়তো।
কোয়েলহো অবশ্য সেভাবে দেখেন না, ‘যদি রিয়াল মাদ্রিদ পিএসজিকে হারিয়ে দেয়, তাহলে ‘‘ভিনিসিয়ুস আছে, নেইমারের আর দরকার নেই’’ ধারণাটা আরও জোর পাবে। কিন্তু ব্যাপারটা তো এভাবে কাজ করে না। ওদের দুজনকেই আমাদের দরকার। আগের প্রজন্মগুলোর ক্ষেত্রে আমরা যে ভুল করেছি, সেটি আবার যাতে না করি।’
আগের ভুল কোনটা? ব্রাজিলের ফুটবলে ব্যাটন-বদলের প্রক্রিয়াটা ঠিক না থাকা। সাফল্য আসছে না? একে বাদ দিয়ে ওকে নাও—এমনটাই দেখে আসছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল। আবেগই সেখানে মূল অনুঘটক হয়ে দাঁড়ায় বোঝাতে কোয়েলহো বললেন, ‘রোনালদিনিও, কাকা ও আদ্রিয়ানোর ২০১৪ বিশ্বকাপে জায়গা না পাওয়ার কারণ একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম, তবে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম দুই ২২ বছর বয়সী—নেইমার ও অস্কারকে আমাদের আক্রমণের নেতা বানিয়ে। ব্রাজিলে ব্যাটন-বদলের প্রক্রিয়াটাই ঠিক নয়, আমাদের ভেঙেচুরে গড়তেই ভালো ভালো লাগে। ব্যাপারটা ‘‘নেইমারের সময় শেষ, এখন ভিনিসিয়ুসের সময়’’ এমন হওয়ার তো দরকার নেই। দুজনই ইউরোপে ভালো করছে, দুজনকেই তো রাখতে পারি আমরা।’
সে না হয় রাখা গেল, কিন্তু কতদিন? নেইমারের বয়স ৩০, ভিনিসিয়ুস ৯ বছরের ছোট। ব্যাটনটা এক সময় হাতবদল হবেই, কিন্তু সময়টা কি সামনেই? ক্যারিয়ারের ১৩ বছর পেরিয়েও এখনো প্রতিভার পুরোটা প্রমাণ করতে না পারার ব্যর্থতা নেইমারের সঙ্গী। মেসি-রোনালদোর সঙ্গে ব্যালন ডি’অরের লড়াইয়ে যাঁর থাকার কথা ছিল, সেই নেইমার বর্ষসেরা ফুটবলারের তালিকার সেরা দশেই জায়গা পাননি সর্বশেষ তিন বছর।
দলীয় শিরোপা? পিএসজিকে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর স্বপ্ন নিয়ে বার্সেলোনা ছেড়েছিলেন, একবার ফাইনালে ওঠাই সার! বার্সেলোনায় তবু একবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। ব্রাজিলের হয়ে এক ২০১৩ কনফেডারেশনস কাপ ছাড়া কোনো বড় শিরোপা নেই—কনফেডারেশনস কাপ তো এখন বাতিলই হয়ে গেছে। বিশ্বকাপ জেতা পরের কথা, ফাইনালেও খেলা হয়নি কখনো। আর কোপা আমেরিকা? তিনি খেলা শুরু করার পর যে একবার ব্রাজিল মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বসূচক শিরোপাটা জিতেছে, ২০১৯ কোপা আমেরিকার সে ব্রাজিল দলে নেইমার ছিলেনই না! ব্রাজিলিয়ানদের নেইমারকে নিয়ে হতাশ হতে আর কী লাগে?
এ বছরটা বিশ্বকাপের। অক্টোবরের সাক্ষাৎকারই সত্যি মানলে নেইমারের শেষ বিশ্বকাপ। কাতারে শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারবেন কি না নেইমার, সে পরের প্রশ্ন। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের আশার কেন্দ্রেই তিনি থাকবেন কি না, সেটি হয়তো অনেকটা ঠিক করে দেবে আজ রিয়াল-পিএসজির আড়ালে ‘নেইমার-ভিনিসিয়ুস’ দ্বৈরথ।
বের্তোজ্জি বলছিলেন, ‘অনেক ব্রাজিলিয়ানের চোখে আমাদের ফুটবলারদের মূল মাপকাঠি যা—বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার আর বড় ট্রফি জেতা, নেইমার এখনো সেটি অর্জন করতে পারেননি। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনেকেই তাঁর ওপর সে প্রত্যাশা রাখে, তিনি এখনো সেটি পূরণ করতে পারেননি।’
পূরণ করার মতো সময় কি নেইমার পাবেন? নিজেই-বা নিজেকে সে সময় দেবেন?