কদিন ধরেই দুঃসংবাদটা আসি আসি করছিল। গতকাল রাতে তা এসেই গেল। একেএম নওশেরুজ্জামান আর নেই। করোনা নিয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বেশ কয়েক দিন ধরেই ছিলেন সাবেক এই ফুটবল তারকা। আর ফিরে আসতে পারেননি। ৭২ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
নওশেরুজ্জামানকে মনে রাখতে হবে তাঁর বহুমুখী প্রতিভার জন্য। পড়াশোনায় ছিলেন তুখোড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন জীববিজ্ঞানে। তাঁর ছোট ভাই শরিফুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই পদার্থ বিদ্যার ছাত্র ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় ফুটবল দলে ছিলেন দুই ভাইই। তাঁরা মালয়েশিয়ার বিখ্যাত টুর্নামেন্ট মারদেকায় খেলেছিলেন। বাংলাদেশ জাতীয় দলে তাঁরাই প্রথম মাস্টার্স ডিগ্রিধারী ফুটবলার সহোদর। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম ডাকসু নির্বাচনে অ্যাথলেটিকস সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলেন নওশের। তবে শেষ পর্যন্ত জানতে পারেননি জিতেছেন না হেরেছেন! ওই নির্বাচনের ভোট গণনা পণ্ড হয়ে গিয়েছিল।
স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্লু নওশের ক্লাব পর্যায়ে ফুটবল-ক্রিকেট দুটোই খেলেছেন। তবে সব ছাপিয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য হিসেবে। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১০০ টাকায় নিজের প্রিয় ঘড়িটি বিক্রি করে ১৯৭১ সালে তিনি ভারতে ছুটে যান স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যোগ দিতে।
স্বাধীন বাংলা দলে যাওয়ার অনেক আগেই ১৯৬৭ সালে ঢাকার ফুটবলে তাঁর শুরু বাংলাদেশ রেলওয়ের জার্সিতে। ’৬৮-তে ওয়ারী, ’৬৯-এ ফায়ার সার্ভিস, ’৭০-এ ভিক্টোরিয়ায় খেলেন। ’৭২-’৭৪-এ ওয়াপদা, ’৭৫-’৭৭-এ মোহামেডান। ’৭৮-’৮০ সালে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে খেলে ফুটবল জীবনের ইতি। জাতীয় দলে খেলেন ১৯৭৩-’৭৬ সাল অবধি। ফুটবল অধিনায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলের। ক্রিকেটে ৩ বছর ভিক্টোরিয়া ও ৫ বছর কলাবাগানের অধিনায়ক ছিলেন তিনি।
এ দেশের ফুটবল নস্টালজিয়ায় ঘুরেফিরেই আসে নওশেরের কথা। তরুণ বয়স থেকেই তাঁর নিশ্বাস-প্রশ্বাসে থাকত শুধুই ফুটবল। সেই গল্প শুনতে সম্প্রতি নওশেরুজ্জামানের মগবাজারের বাসায় গিয়েছিলাম। স্মৃতির ডালি খুলে ফিরে তিনি যান অতীতের দিনগুলোতে। বলেছিলেন, তাঁর ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প। নওশেরদের পরিবারকে অনায়াসে ‘ফুটবল পরিবারের’ তকমা দেওয়া যায়। দারুণ এক উদাহরণ গড়ে তাঁদের পাঁচ ভাই খেলেছেন ঢাকার ফুটবলে। নওশেরের চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট শরিফ ফুটবলে আসেন ভাইকে দেখেই। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার বদরপুরে, বর্তমানে চাঁদপুরের মতলব। তবে তাঁদের জন্ম মুন্সিগঞ্জে।
শরিফের শারীরিক গঠন ছিল চমৎকার। ১৯৭৫ সালে চোটের কারণে মারদেকা টুর্নামেন্টে খেলতে না পারার আক্ষেপ আছে তাঁর। দুই ভাই-ই ১৯৭২-’৭৪ পর্যন্ত ছিলেন ঢাকার প্রথম বিভাগের দল ওয়াপদায়। তখন ওয়াপদায় একজন বিদেশি প্রকৌশলী আসেন। স্যান্ডি নামের সেই ভদ্রলোক স্কটল্যান্ডের প্রথম বিভাগের সাবেক খেলোয়াড় ছিলেন। ওয়াপদার ফুটবল দল আছে জেনে আগ্রহী হন দলটিকে অনুশীলন করাতে। বয়স হয়ে গেলেও নওশেররা তাঁর সঙ্গে ট্যাকলে পেরে উঠতেন না। নওশের বলেছিলেন, ‘এই স্যান্ডিই আমাকে আর শরিফকে আলাদা অনুশীলন করাতেন। ফিটনেস বাড়াতে ঢাকা ক্লাবে নিয়ে গিয়ে স্কোয়াশ শেখাতেন। তাঁর কারণেই ফুটবলার হিসেবে নিজেকে উন্নত করতে পেরেছিলাম।’
ওই সময়ই ১৯৭৪ সালে আবাহনীর কোচ হলেন আয়ারল্যান্ডের বিল হার্ট। আবাহনীতে সব সেরা খেলোয়াড় থাকায় হার্টের কাজটা সহজই ছিল। কিন্তু ওয়াপদায় খেলতেন কিছু ‘অফিশিয়াল ফুটবলার’, যাঁদের নিয়ে পরিশ্রমটা বেশিই হতো স্যান্ডির। সেই শ্রম বেড়ে যায় ভিক্টোরিয়ায় লেফট আউটে খেলা নওশেরকে স্ট্রাইকার হিসেবে তৈরির মিশনে। তিনি সফর হয়েছিলেন নওশের হতে পেরেছিলেন সমীহ কাড়া এক স্ট্রাইকার। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে অসমাপ্ত লিগে দুটি হ্যাটট্রিকসহ ৮ ম্যাচে ১৬ গোল করেন নওশের ( দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ গোল বড় নাজিরের)।
১৯৭৫ সালে ভাই শরিফকে নিয়ে তিনি যোগ দিলেন মোহামেডানে। সেবার হয়ে গেলেন লিগের সর্বোচ্চ ( ২১) গোলদাতা। তবে তাঁর উঠে আসার ভিত্তিটা গড়ে দেয় ওয়াপদাই। যেখানে চাকরি করতেন ছোট ভাই শরিফ। ১৯৭৩ সালে মারদেকায় প্রথম জাতীয় দলে ওয়াপদা থেকেই ডাক পান আট খেলোয়াড়। ১৭ জনের স্কোয়াডে টিকলেন চারজন, নওশের, শরিফ, সুনীল ও দিলীপ বড়ুয়া। সেই সফরে চোখ কাড়েন দুই ভাই। ছোট ভাইকে নিয়ে নওশের বলেছিলেন, ‘শরিফ নিজের প্রতি অবহেলা করত। মাঝে মাঝে তাই মাসল পুল করেছে ওর। পঁচাত্তরে মারদেকায় সে যেতে পারেনি এ কারণেই। নিজেই নাম প্রত্যাহার করেছে।’
মোহামেডানের হয়ে হ্যাটট্রিক আছে শরিফের। পঁচাত্তরের লিগে নওশেরের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পেছনে বড় অবদান ছোট ভাইয়ের। নওশের বলেছিলেন, ‘আমার ভাই বলে বলছি না। ও ছিল দারুণ এক খেলোয়াড়। আমার খেলাটা বুঝত। বলটা ঠিক জায়গায় দিতে পারত। শরিফের পাসে অনেক গোল আছে আমার।’
প্রথম জয়ের নায়ক
১৯৭৩ সালে মারদেকায় গিয়ে বাংলাদেশ দল রোমাঞ্চিত ছিল যতটা, দুশ্চিন্তাও কম ছিল না। নওশের স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, ‘প্রথম ম্যাচটা দেখে নিজেরা বলাবলি করছিলাম, ওরা এত সুন্দর ও গতিময় খেলে। আমরা কী পারব?’ বাংলাদেশ দল পেরেছিল, থাইল্যান্ডের সঙ্গে ২-২, দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ১-১ ড্র। তৎকালীন বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার) কাছে ০-৬, কুয়েতে কাছে ১-২ আর থাইল্যান্ডের কাছে ০-২ গোলে হারলেও প্রথম সফরে খারাপ করেনি লাল-সবুজের দল। নওশেরের স্মৃতিতে সেই দিনগুলো ছিল এমন, ‘কুয়ালালামপুরে যাওয়ার সময় ব্যাংককে রাতের আলো ঝলমলে বাতি দেখে অভিভূত ছিলাম আমরা। দারুণ অভ্যর্থনা পেয়েছিল বাংলাদেশ। রাস্তায় আলাদা সম্মান। পুলিশি পাহারায় চলাফেরা। কিন্তু ঢাকায় এসে মনে হলো, এত অন্ধকার কেন! তখন থাই এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ দলের একটা ছবি তুলেছিল।'
মারদেকা শেষ করে সিঙ্গাপুরে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে একটি ড্র, অন্যটি জয়। দেশের বাইরে সেটিই বাংলাদেশের প্রথম জয়। সেই ম্যাচে মনোয়ার হোসেন নান্নুর ক্রস থেকে একমাত্র গোলটি করেন নওশের। স্মৃতিতে ডুবে তিনি বলেছিলেন, ‘ওই ম্যাচে বিরতির সময় নান্নুকে বললাম, ‘দোস্ত, দুই এটা ক্রস আমাকেও দে। দ্বিতীয়ার্ধে একটা ক্রস দিয়েছে সে, বুক দিয়ে নামিয়ে কিছুটা সামনে এসে বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের গড়ানো শটে জালে পাঠালাম।’
কর্নার থেকে সরাসরি গোল
স্বাধীন বাংলা দল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে প্রীতি ম্যাচে খেলে আলোড়ন তুলেছিল। তাতে বাড়তি অবদান নওশেরের। বোম্বের (এখন মুম্বাই) ম্যাচটাই তাঁর কাছে বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে। ওই ম্যাচে দর্শক সারিতে বলিউড অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরসহ ছিলেন ভারতের রুপালি পর্দার অনেক তারকা। তাঁদের সামনেই কর্নার থেকে সরাসরি গোল করেন নওশের। ‘তখন আমি লেফট আউটে খেলি। তবে দুই পা সমান চলে। ডান পায়ে কর্নার থেকে ‘রেইন বো কিক’ নিয়েছিলাম। বাতাস অনুকূলে ছিল। প্রথম পোস্ট দিয়ে বলটা ঢুকছে জালে। সরাসরি গোল। গোলকিপার বুঝতেই পারেনি। ৩-১ গোলে জিতলাম আমরা।’ নওশেরের কাছে স্বাধীন বাংলা দলে ওটা ছিল তাঁর স্মরণীয় গোল।
অনেক গল্প না বলেই চলে গেলেন
স্বাধীনতার পর ঢাকা একাদশের হয়ে আসাম সফরে যান তিনি। সেখানে সব অনুষ্ঠানেই গান গাইলেন। গানের গলা ভালো ছিল। তিয়াত্তরে মালয়েশিয়া সফরে ওখানকার রাজা-রানির দেওয়া একটা অনুষ্ঠানেও গান গেয়েছেন। খেলোয়াড়ি জীবনে প্রতি শুক্রবার সিনেমা মুক্তি পেলে হলে গিয়ে দেখতেন। সারা দিন ক্রিকেট খেলে গুলিস্তানে সিনেমা দেখেছেন গোলাম সারোয়ার টিপুর সঙ্গে। অনেক অনেক গল্প রেখেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
দারুণ এ ক্রীড়াবিদকে ভুলবে না বাংলাদেশ
ফুটবল খেলেন ১৪ বছর। তবে ক্রিকেট আরও বেশি— ১৭ বছর। বলেছিলেন, ‘আমি আসলে ফুটবলার নই, ক্রিকেটার।’ ১৯৭৪ সালে শুরু প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে। পঁচাত্তরে আসেন মোহামেডানে। ছিয়াত্তরে সাদা-কালো শিবিরের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তিনি! ক্রিকেটে ইতি টানেন ১৯৯০ সালে, ফুটবল ছাড়ারও ১০ বছর পর। ক্রিকেটে শেষ সাত মৌসুম কলাবাগানে খেলে পাঁচ বারই অধিনায়ক। ভিক্টোরিয়ায় ৩ বছর খেলে ২ বছর অধিনায়ক। অলরাউন্ডার নওশের মোহামেডান ছেড়ে গিয়ে মোহামেডানকে গুটিয়ে দেন ১১০ রানে। খেলার জগতের এ সব্যসাচী নক্ষত্রকে ভুলবে না এ দেশ।
দেশের জন্য ফুটবল পায়ে যুদ্ধ করেছেন ১৯৭১ সালে, এই যোদ্ধার অমর স্মৃতির প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।