দরিভাল, ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ফাইনাল কত দূর

ব্রাজিল কোচ দরিভাল জুনিয়রএএফপি

—চাচা, ঢাকা কত দূর?

— ওই দেখা যায় সদরঘাট, সামনে নবাবপুর।

বাংলাদেশে প্রচলিত সরস সংলাপ। পাশাপাশি দেশীয় সিনেমায়ও এই সংলাপ ব্যবহার হয়েছে, র‍্যাপ গান হয়ে উঠে এসেছে প্রয়াত আজম খান ও চারুর কণ্ঠেও। চাইলে এই সংলাপ এখন খানিকটা ঘুরিয়ে ব্রাজিল কোচ দরিভাল জুনিয়রকেও বলা যায়। বয়স যেহেতু ৬২ বছর, তাই ‘চাচা’ সম্বোধন করলেও তিনি হয়তো খুব বেশি আপত্তি করবেন না। তারপর অত্যন্ত ভদ্র-নম্র কণ্ঠে তাঁকে জিজ্ঞেস করা যায়, চাচা ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ফাইনাল কত দূর?

দরিভাল উদাস চোখে সুদূরে তাকিয়ে হয়তো বলতে পারেন, ওই দেখা যায় বিশ্বকাপ, সামনেই ফাইনাল।

আরও পড়ুন

রসিকতাটুকু এমনিতেই হচ্ছে না। ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে টানা তিন ম্যাচ হারের পর গত শনিবার ইকুয়েডরের বিপক্ষে ১-০ গোলে জেতে ব্রাজিল। সেই জয়ের পর দরিভাল সম্ভবত ভেতরকার আবেগ দমিয়ে রাখতে পারেননি। প্যারাগুয়ে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে ব্রাজিল কোচ গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল দিয়ে বসেন! মানে, বাছাইপর্ব টপকানোর আগেই বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার নিশ্চয়তা দেন ব্রাজিলকে, ‘আমরা ২০২৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলব। আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত। আমার কথাটা মনে রাখুন। এই কথা যখন বলছি, চাইলে ভিডিও করেও রাখতে পারেন।’

প্যারাগুয়ের কাছে হারের পর বিমর্ষ ব্রাজিলের দুই খেলোয়ড় মারকিনিওস ও এস্তেভাও
এএফপি

দরিভাল সত্যিই ফাইনালে কথা বলেছিলেন তো, নাকি বলেছিলেন ফাইনালসের কথা। ফাইনালস মানে তো চূড়ান্ত পর্ব। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে ব্রাজিল ছিল না কবে!

তো, প্যারাগুয়ে ম্যাচের ফল তো সবারই জানা। ১-০ গোলে আবারও হেরেছে ব্রাজিল। এমন পরিস্থিতিতে দরিভালের সেই আশ্বাস নিয়ে রসিকতা হওয়াই তো স্বাভাবিক! টানা তিন হারের পর সামান্য ১-০ গোলের জয়েই যদি দুই বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপ ফাইনালে কেউ দলকে দেখেন এবং সেটির নিশ্চয়তাও দিয়ে বসেন, তখন পরের ম্যাচে তো সবারই চোখ থাকে। প্যারাগুয়ের বিপক্ষে সেই চোখ রাখার ম্যাচেই ব্রাজিলের হারের পর দরিভালকে নিয়ে তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘মিম’ হওয়াই স্বাভাবিক—চাচা, ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ফাইনাল কত দূর?

আরও পড়ুন

সময় ও পরিস্থিতি বিচারে ব্রাজিলের ২০২৬ বিশ্বকাপের ফাইনালের প্রসঙ্গই আসলে আসে না। দরিভাল সেখানে আগেভাগেই বাছাইপর্ব ডিঙিয়ে বিশ্বকাপের বিভিন্ন পর্বও পাড়ি দিয়ে একেবারে ফাইনাল খেলার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা কারও কারও কাছে রাজনৈতিকও মনে হতে পারে! মানে, রাজনৈতিক নেতারা তো এমন কত প্রতিশ্রুতিই দেন! সেটি হতে পারে চেয়ার টিকিয়ে রাখা কিংবা জনমতকে পাশে পাওয়ার স্বার্থে। সে যাহোক, দরিভাল নিজের চাকরি বাঁচাতে এমন কথা বলেছেন কি না, তা শুধু তিনিই জানেন। প্যারাগুয়ের কাছে হারের পর আপাতত তাঁর সংবাদ সম্মেলন থেকে যা জানা গেল, ম্যাচের প্রথমার্ধে ব্রাজিল যেমন খেলেছে, সেটি দরিভালের অধীনে দলটির সবচেয়ে বাজে প্রথমার্ধ।

শুনুন দরিভালের মুখেই, ‘প্রত্যাশাটা খুব ইতিবাচক ছিল যে আমরা আরেকটু ধারাবাহিক খেলতে পারব। গোল হজমের আগপর্যন্ত আমরা তেমন পরিস্থিতিতেই ছিলাম...কিন্তু গোল হজমের পর আমরা পথ হারিয়েছি। প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত আমরা যা কিছু করেছি, সেটা আসলে হাল ছেড়ে দেওয়াই। আমরা এখানে আসার পর থেকে এটাই সবচেয়ে বাজে প্রথমার্ধ। আর তাতেই ম্যাচের ফলটা নিশ্চিত হয়েছে।’

ব্রাজিলের প্রথমার্ধের খেলায় সন্তুষ্ট নন দরিভাল
এএফপি

প্রথমার্ধের ২০ মিনিটে প্যারাগুয়ে মিডফিল্ডার দিয়েগো গোমেজের গোলে এগিয়ে যায় প্যারাগুয়ে। গোল হজমের আগে থেকেই এলোমেলো ফুটবল খেলেছে দরিভালের দল। পিছিয়ে পড়ার পর বাজে খেলেছে আরও। ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো, এনদ্রিকদের নিয়ে সাজানো ব্রাজিলের তারকাখচিত আক্রমণভাগ বলার মতো একটি আক্রমণ পর্যন্ত করতে পারেনি! তবে দরিভাল এই হারের দায় খেলোয়াড়দের কাঁধে চাপাচ্ছেন না। দায়টা তিনি নিজের ওপরই নিয়েছেন, ‘নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা সব সময় সফল হয় না। আমি এটা বুঝি আর ব্যাপারটা শুধু ভিনির সঙ্গেই নয়। প্রথমার্ধে আমাদের অনেক ঘাটতি ছিল। এই দায় আমার। এ জন্য কোনো খেলোয়াড়কে দোষ দিতে চাই না। তবে আমাদের এটা বুঝতে হবে, যে পর্যায়ে আমরা ওঠার চেষ্টা করছি সে জন্য আরও বেশি নিংড়ে দিতে হবে। আমরা সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছি। ব্যাপারটা সহজ নয়। কাজটা কঠিন। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে আমাদের কাজ করতে হবে।’

আরও পড়ুন

সংবাদ সম্মেলনে নেইমারের প্রসঙ্গও উঠেছে। ব্রাজিলের সর্বোচ্চ এই গোলদাতা গত বছর অক্টোবরে চোট পাওয়ার পর আর মাঠে নামতে পারেননি। আপাতত চোট সারিয়ে মাঠে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নেইমার। কিন্তু সেই ফেরাটা কবে, তার সঠিক দিনক্ষণ জানাতে পারলেন না দরিভাল, ‘সবার আগে তাকে ক্লাবের (আল হিলাল) দলে ফিরতে হবে। তার আগপর্যন্ত আমরা কিছুই করতে পারব না। সব সময়ই যোগাযোগ হচ্ছে, আমরা নেইমারের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। সুস্থতার আশায় আছি। কিন্তু সে জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’

৮ ম্যাচে ১০ পয়েন্ট নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা বাছাইপর্ব টেবিলের পাঁচে ব্রাজিল। দেশটির সংবাদমাধ্যম ‘ও গ্লোবো’ জানিয়েছে, বাছাইপর্বে ব্রাজিল এর আগে কখনোই এত বাজে শুরু করেনি। তবে আশা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এই মহাদেশ থেকে বাছাইপর্বে ১৮টি করে ম্যাচ খেলবে প্রতিটি দল। টেবিলের শীর্ষ ছয় দল সরাসরি জায়গা পাবে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ২০২৬ বিশ্বকাপের চূড়ান্তপর্বে। সপ্তম দলটিকে খেলতে হবে প্লে–অফ। এই সমীকরণ বিচারে ব্রাজিলের ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনা এখনো ভালোভাবেই টিকে আছে। কিন্তু দুশ্চিন্তা অন্য জায়গায়। ব্রাজিল যেভাবে খেলছে, সর্বশেষ পাঁচ ম্যাচে চার হার, তাতে এই ১৮ ম্যাচ পর্যন্ত ধারাটা অপরিবর্তিত থাকলে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা বিশ্বকাপে খেলার টিকিট পাবে তো!

উত্তরটা সম্ভবত দরিভাল আগেভাগেই জানেন। তাই হয়তো বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন আগেভাগেই। কিন্তু আপাতত যে পরিস্থিতি, তাতে আসুনসিওন থেকে দরিভাল দেশে ফেরার পর স্বয়ং ব্রাজিলিয়ানরাই রসিকতা করে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, চাচা, বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার কত দূর?