টিকে থাকবে তো চট্টগ্রাম আবাহনী?
উৎসবের আমেজে বাঁকা কথা বলতে নেই। কিন্তু চট্টগ্রাম আবাহনীর স্বাধীনতা কাপ জয়ের উৎসবের মাঝখানেই একটা প্রশ্ন সব আনন্দ যেন ভন্ডুল করে দিতে উদ্যত—বড় শক্তি হিসেবে টিকে থাকবে তো দলটি!
এমন বেরসিক প্রশ্ন মনে আসার কারণ অনেক। দলটির যে কোনো অবকাঠামোই গড়ে ওঠেনি। চট্টগ্রাম আবাহনী স্রেফ দুই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল একটা ক্লাব। এই দুজন সরে গেলেন তো সবাই গেল!
সেই আশির দশক থেকে চট্টগ্রাম আবাহনীকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন চট্টগ্রামের অন্যতম সাংসদ সামশুল হক চৌধুরী, যিনি এই ক্লাবের মহাসচিবও। ২০০৭ সালে পেশাদার লিগ চালু হওয়ার পর তাঁর হাত ধরেই দেশের ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে উঠে এসেছে ক্লাবটি। এত দিন অবনমন অঞ্চলে ঘোরাফেরা করে অবশেষে বড় দল হওয়ার একটা পর্যায়ে আছে তারা।
দলটির হঠাৎ বড় দল হয়ে ওঠার পেছনে আছেন আরেক ব্যক্তি। মহাসচিব সামশুল হক চৌধুরীর হাত ধরে এসে এই ক্লাবের দায়িত্ব নিয়েছেন তরফদার রুহুল আমিন নামের একজন ব্যবসায়ী। সাইফ পাওয়ারটেকের কর্ণধার রুহুল আমিন দেদার টাকা খরচ করছেন বলেই এবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দল গড়তে পেরেছে তারা। তাঁর একটি ঘোষণাই এই মুহূর্তে ক্লাবটির সম্বল। তিনি বলেছেন চট্টগ্রাম আবাহনীকে বড় দলে পরিণত করার কথা। সেই কথা তিনি রেখেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কত দিন? কত দিন রুহুল আমিন চট্টগ্রাম আবাহনীর পেছনে অর্থ ব্যয় করবেন?
গত নভেম্বরে তরফদার রুহুল আমিনের উৎসাহেই চট্টগ্রাম আবাহনী আয়োজন করেছিল শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ফুটবলের আসর। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সেই আমন্ত্রণমূলক প্রতিযোগিতাটি ছিল তরফদার রুহুল আমিনের প্রথম চমক। ওই প্রতিযোগিতা জিতে নেয় স্বাগতিক চট্টগ্রাম আবাহনীই। কিন্তু সেটি ছিল একদল ভাড়াটে ফুটবলারের অবদান। এবার নিজস্ব খেলোয়াড় নিয়েই ঘরোয়া প্রতিযোগিতার প্রথম কোনো শিরোপা ঘরে তুলল দলটি। আক্ষরিক অর্থেই হয়তো বড় দল হওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়েছে চট্টগ্রাম আবাহনী।
স্বাভাবিকভাবেই খেলোয়াড়েরা গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আনন্দ করেছেন, রাতে হোটেলে ফিরেও তা থামেনি। দশ লাখ টাকা বোনাস ঘোষণাও এসে গেছে। খেলোয়াড়দের জন্য তরফদার রুহুল আমিন পার্টি দিচ্ছেন আগামীকাল। খেলোয়াড়েরা তাই অনেক বেশি উৎফুল্ল।
অধিনায়ক জাহিদ হোসেন অবশ্য অসুস্থ বাবার পাশে থাকতে রাতেই হাসপাতালে ছুটে গেছেন। এই প্রতিবেদককে আজ ফোনে বলছিলেন, ‘কী যে ভালো লাগছে বোঝাতে পারব না। এক বন্ধু এসেছে, ওকে আমাদের এই ট্রফি জয়ের গল্পটা বলছি। সে শুনে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। আসলে এটা দারুণ এক সুখবর আমাদের ফুটবলের জন্য।’
চট্টগ্রাম আবাহনীর আগমনী বার্তাটা অবশ্যই দেশের ফুটবলে নতুন সূর্যের আভাসই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এক দুটি ট্রফি জিতে হারিয়ে যাবে না চট্টগ্রাম আবাহনী? সেই নিশ্চয়তা দেখছেন না অনেকেই। ঢাকা আবাহনী, ঢাকা মোহামেডান কিংবা ব্রাদার্স শক্ত কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়েছে, ব্যক্তি সরে গেলেও এই ক্লাবগুলো বড় ক্লাব হয়েই থাকবে। শেখ রাসেল বা শেখ জামালও কাঠামোগতভাবেই এগুচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রাম আবাহনীর ওই পর্যায়ে যেতে আরও অনেক সময় লাগবে।
মুশকিল হচ্ছে, তরফদার রুহুল আমিন সরে গেলে চট্টগ্রাম আবাহনীর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করার লোক আপাতত নেই। হালে তিনি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ (বাংলাদেশ সুপার লিগ) নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এটাই ভয় দলটির অনেকের। তাঁদের শঙ্কা, রুহুল আমিন সাহেব দুদিন পর আর আগ্রহ না দেখালে চট্টগ্রাম আবাহনী হোঁচট খাবে। আগামী বছর এটি বড় দল থাকবে, সেই নিশ্চয়তা তাঁরা কেউই পাচ্ছেন না!
ক্লাবের প্রাণপুরুষ সামশুল হক চৌধুরীকে নিয়েও সমস্যা। সম্প্রতি সালাউদ্দিন-প্যানেলের লোক হয়েও বাফুফে নির্বাচনে হেরে গেছেন তিনি। কানাঘুষা আছে প্যানেলের ভেতর থেকে কলকাঠি নেড়েই নাকি তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাল চট্টগ্রাম আবাহনীর এমন আনন্দের দিনেও সামশুল হক চৌধুরী মাঠে ছিলেন না। তাঁর এই অভিমান, মনঃকষ্ট চট্টগ্রাম আবাহনীর ওপর প্রভাব রাখলে কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু থাকছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম আবাহনীর এক কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘আমাদের থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার জায়গা নেই, কোনো সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। আমরা হলাম ভাসমান। আগামীকাল যদি শীর্ষ কর্মকর্তারা উৎসাহ হারান, তাহলেই সব শেষ! তাই আগামী বছর রেলিগেডেট টিম হলেও অবাক হব না!’
চট্টগ্রাম আবাহনী থাকার জায়গা নেই, কথাটা অবশ্য প্রতীকী। চট্টগ্রামের হালিশহরে প্রায় ২২ বিঘা জমি আছে ক্লাবের, কিন্তু সেখানে কোনো অবকাঠামোই নেই। একটা মাঠ পর্যন্ত করা যায়নি, থাকার ব্যবস্থাও এত দিনে গড়ে ওঠেনি। চট্টগ্রামে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয় খেলোয়াড়দের, ঢাকায় এসে উঠতে হয় হোটেলে। হোটেলে থাকা মানে ব্যয়বহুল একটা ব্যাপার, এভাবে কত দিন হোটেল থেকে ক্যাম্প চালানো যাবে, সেটা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই।
তবে তরফদার রুহুল আমিন আশাই দেখাতে চান। দায়িত্ব নিয়ে যেমন বলছিলেন, বড় দল গড়বেন, একাডেমি করবেন, এগুলো আজও বললেন। তাঁর কথা, ‘আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আমরা এখন আরও প্রতিষ্ঠিত দল হতে চাই। এ জন্য যা করণীয় সবই করব। চট্টগ্রামে ক্লাবের জায়গায় আবাসন, স্টেডিয়াম, কোচিং সেন্টারসহ ক্লাবের স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করব।’
তাঁর আন্তরিকতা হয়তো আছে। কিন্তু ক্লাবের কোনো অবকাঠামো না থাকার কারণেই অলক্ষ্যে যত শঙ্কা!