এমবাপ্পেই কি এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ফুটবলার?
‘তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে পিএসজিকে। এ মুহূর্তে এমবাপ্পেকেই সবাই সই করানোর চেষ্টা করবে। বার্সার সব খেলোয়াড়ের জীবন অতিষ্ঠ করেছে সে। পারফরম্যান্সটা ব্রাজিলের পুরোনো রোনালদোর মতো। চুক্তির এক বছর বাকি থাকতে ২২ বছর বয়সে এমন পারফরম্যান্স। সে নিখাদ এক হীরা'—বিটি স্পোর্টসকে বলেছেন ইংল্যান্ড ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক মিডফিল্ডার ওয়েন হারগ্রিভস।
চ্যাম্পিয়নস লিগে কাল রাতে বার্সেলোনা-পিএসজি ম্যাচটা দেখে থাকলে এমন মন্তব্যে ভ্রু না কুঁচকানোই স্বাভাবিক। ক্যাম্প ন্যু-তে আক্ষরিক অর্থেই বার্সা খেলোয়াড়দের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন এমবাপ্পে।
তাঁর অসাধারণ এক হ্যাটট্রিকে শেষ ষোলোর প্রথম লেগে ৪-১ গোলে জিতেছে পিএসজি। ২০০৩ চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল ফিরতি লেগে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ইউনাইটেডের বিপক্ষে অসাধারণ এক হ্যাটট্রিক করেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান তারকা রোনালদো।
কাল এমবাপ্পের হ্যাটট্রিকে ‘ফেনোমেনন’কে মনে পড়েছে অনেকের। প্রতিপক্ষের মাঠে এমন একক পারফরম্যান্স খুব বেশি দেখা যায় না।
আর সে কারণেই ইংল্যান্ডের সাবেক মিডফিল্ডার জো কোল বলেছেন, ‘এ মুহূর্তে এমবাপ্পে বিশ্বের সেরা ফুটবলার। সে ফুটবলের “আলফা ডগ”। কোনো দল গড়তে চাইলে সবার আগে এমবাপ্পেকে নিন। এ মুহূর্তে এই গ্রহে সে-ই সবচেয়ে প্রভাব জাগানিয়া ফুটবলার।’
কোলের কথায় লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অভিমান হতে পারে। আর মুচকি হেসে আঁটঘাট বেঁধে নামতে পারে রিয়াল মাদ্রিদ। কেননা, ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী ফরোয়ার্ডকে বহুদিন ধরেই কেনার চেষ্টা করছে বার্সার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবটি। এই চেষ্টাটা তারা কেন করছে, এমবাপ্পে তার আরও একটি প্রমাণ রাখলেন কাল রাতে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি ঘুরছে। প্রায় উড়ন্ত গতিতে এগিয়ে যাওয়া এমবাপ্পেকে পেছন থেকে তাঁর জার্সি টেনে ধরে থামানোর চেষ্টা করছেন বার্সা ডিফেন্ডার জেরার্ড পিকে। ছবিটি এক অর্থে এমবাপ্পের কাছে বার্সা ডিফেন্ডারদের ভোগান্তির নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।
পিএসজি তারকার গতি, ড্রিবলিং ও ঠান্ডা মাথার ফিনিশিংয়ের সামনে দাঁড়াতে পারেননি ক্লেঁম লংলে, পিকে, দেস্ত ও আলবাদের গড়া রক্ষণভাগ। প্রথমার্ধে একটি ও বিরতির পর আরও দুটি গোল আদায় করে নেন তিনি।
লংলে-কে কাটিয়ে তাঁর প্রথম গোলটি ছিল চোখ ধাঁধানো, পরের গোলটি ছিল ১০ গজ দূরত্ব থেকে সুযোগসন্ধানী এবং শেষটি ছিল কোনাকুনি জায়গা থেকে নিখুঁত বাঁকানো শটে গোলের প্রদর্শনী।
চোটের কারণে নেইমার ছিলেন না। বার্সার বিপক্ষে তাই এমবাপ্পের দিকে তাকিয়ে ছিল পিএসজি।
ফরাসি তারকা শুধু দলের এ প্রত্যাশাই পূরণ করেননি, এর পাশাপাশি কিংবদন্তিদের মুখ দিয়ে বের করেছেন, মেসির কাছ থেকে শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাটন তিনি নিয়ে নিলেন কি! গ্যারি লিনেকারের টুইট, ‘এমবাপ্পের হ্যাটট্রিক। আমরা সম্ভবত শ্রেষ্ঠত্ব হাতবদল হতে দেখছি।’
মেসিকে নিজের মাঠে এভাবে একক নৈপুণ্যের সামনে পর্যুদস্ত হতে শেষ কবে দেখা গিয়েছিল, সেটি গবেষণার বিষয়। অন্তত পরিসংখ্যান বলছে, মেসি বার্সার মূল দলে খেলা শুরুর পর চ্যাম্পিয়নস লিগে তাঁদের ঘরের মাঠে আর কেউ হ্যাটট্রিক করতে পারেননি।
২৪ বছর আগে ১৯৯৭ সালে ডায়নামো কিয়েভের হয়ে সর্বশেষ এ নজির গড়েছিলেন আন্দ্রে শেভচেঙ্কো। সব মিলিয়ে এটি চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সার বিপক্ষে তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে হ্যাটট্রিকের নজির—১৯৯৭ সালে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের হয়ে হ্যাটট্রিক করেছিলেন কলম্বিয়ার সাবেক স্ট্রাইকার ফাউস্তিনো অ্যাসপ্রিয়া।
কালকের মঞ্চটা ছিল নকআউট পর্বের। এমন জায়গায় নেইমারের অনুপস্থিতিতে সব চাপ নিজের কাঁধে নিয়ে হ্যাটট্রিক করার মধ্য দিয়ে এমবাপ্পে প্রমাণ করেছেন, মেসি-রোনালদোদের কাতারে থাকার জন্যই তাঁর মাঠে নামা।
পরিসংখ্যানও বলছে, চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্বে বার্সার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করা প্রথম খেলোয়াড়ও এমবাপ্পে। অথচ দুই বছর ধরে চ্যাম্পিয়নস লিগ নকআউট পর্বে তিনি গোল পাননি! কিন্তু এমন সময়ে গোল পেলেন যখন বড় দরকার ছিল পিএসজির। বড় মাপের খেলোয়াড়েরা যেমন হয়ে থাকেন আর কি!
তবে নিজেকে এই এক ম্যাচের পারফরম্যান্স দিয়ে বিচার করছেন না এমবাপ্পে। বাকিদেরও এভাবে বিচার করতে মানা করেছেন পিএসজি তারকা, ‘এক ম্যাচ দিয়ে আমার ভবিষ্যৎ ঠিক করে ফেললে সেটা বোকামি হবে। আমি এখানে (পিএসজি) সুখেই আছি। এমন ম্যাচ আরও সন্তুষ্টি এনে দেয়। পিএসজির জার্সি আমি হৃদয় দিয়েই পরে থাকি। তবে মনে রাখতে হবে, আমরা এখনো কিছুই জিততে পারিনি।’ আগামী মৌসুম শেষে পিএসজির সঙ্গে এমবাপ্পের বর্তমান চুক্তির মেয়াদ ফুরোবে।
চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে ঘরের মাঠে এর আগে কখনোই টানা দুই ম্যাচে হারেনি বার্সা। গ্রুপপর্বে আগের ম্যাচে তারা ৩-০ গোলে হেরেছিল জুভেন্টাসের কাছে। জোড়া গোল করেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
পরের ম্যাচে সেই বার্সার-ই বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করলেন রোনালদোকে আদর্শ মানা এমবাপ্পে। ফরাসি তারকার আত্মবিশ্বাস কতটা উঁচুতে তার একটি উদাহরণ দিয়েছেন পিএসজি কোচ মরিসিও পচেত্তিনো, ‘কাল (পরশু) অনুশীলনে সে জানতে চেয়েছিল, ক্যাম্প ন্যু-তে কখনো জিতেছি কি না? বললাম, একবার জিতেছি। সে উত্তর দিল, আগামীকাল আমরা দ্বিতীয় জয় তুলে নেব।’
মেসি, রোনালদো, নেইমার...বড় মাপের খেলোয়াড়েরা যেমন হয়ে থাকেন আর কি!