এমন একটা ম্যাচ রিপোর্ট কবে দেখব

১৯৯১ সালে প্রি অলিম্পিক বাছাইপর্বে মালয়েশিয়াকে হারানোর সেই ম্যাচ রিপোর্ট,ছবি: সংগৃহীত

এমন এক বিজয়ের খবর আমরা আবার কবে পড়ব!

খবরটা বিদেশি পত্রিকার বলেই আলাদাভাবে চোখ আটকে গিয়েছিল। আরও বিশেষ মনে হয়েছিল সেটি বাংলাদেশের ফুটবলের বিজয়ের খবর বলেই। ফুটবলের বিজয়ের খবর তো বাংলাদেশের সংবাদকর্মীরা নিজেরাই সচরাচর লিখতে পারেন না। ভিনদেশি পত্রিকায়, ভিনদেশি সাংবাদিকের লেখা বিজয়ের ম্যাচ রিপোর্ট তো আরও বেশি বিরল!

প্রতিবেদনটি মালয়েশিয়ার পত্রিকা স্ট্রেইট টাইমসের। সময়টা ১৯৯১, জুলাই মাসের ৮ তারিখ। আগের দিন কুয়ালালামপুরের মারদেকা স্টেডিয়ামে প্রি–অলিম্পিক বাছাইয়ের এশিয়া অঞ্চলের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার অনূর্ধ্ব–২৩ দল। সে ম্যাচে ৪৩ মিনিটে ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবের দেওয়া গোলে মালয়েশিয়াকে ১–০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ।

সে ম্যাচে মামুন জোয়ার্দারের ক্রস থেকে মালয়েশিয়ার এক ডিফেন্ডার ও গোলকিপারের মাঝখান দিয়ে লাফিয়ে দারুণ এক হেডে গোল করেছিলেন নকীব। সেই গোলটির বর্ণনা ইংরেজি পত্রিকা স্ট্রেইট টাইমস দিয়েছিল এভাবে,

‘Bangladesh scored the goal when they launched a lightning raid on the right flank in the 43rd minute. Winger Mamun Joarder out paced left back Wong Kok Sum and sent in cross. Striker Imtiaz Ahmed Nakib out jumped Gahazali Ismail to head the ball past goal keeper Chong Kim Boon...’

‘...Bangladesh thoroughly deserved that goal because their speed and confidence on the ball outshone the predictable play put up by Malaysia.’

১৯৮২ দিল্লি এশিয়াডে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে বাদল রায়ের জয়সূচক গোল।
ছবি: সংগৃহীত

১৯৯১ সালে প্রি–অলিম্পিক বাছাইপর্বে বাংলাদেশের গ্রুপে মালয়েশিয়া ছাড়াও ছিল দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল আর কুয়ালালামপুরে দুই লেগের খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সিউল পর্বে ভিয়েতনাম থাকলেও কুয়ালালামপুর পর্বে ভিয়েতনাম নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। বাংলাদেশ দুই পর্বেই ফিলিপাইনকে হারিয়েছিল। কুয়ালালামপুরে স্কোরলাইন ছিল ৩–০, সিউলে যা ৮-০। ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব একাই হ্যাটট্রিকসহ ৫ গোল করেছিলেন। যেটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেকোনো পর্যায়ে কোনো ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ গোল।

মালয়েশিয়ার বিপক্ষে অবশ্য প্রথম লেগে ১–০ গোলে হেরে গিয়েছিল বাংলাদেশ।

তো, ৩১ বছর পর হঠাৎ এই প্রসঙ্গের অবতারণা কেন!

কারণ, বাংলাদেশের ফুটবলে এমন দৃশ্যপট এখন প্রায় বিরল এক ঘটনা। এ দেশের ফুটবলে ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবের মতো একজন গোলস্কোরার বিরল। আজ থেকে ৩১ বছর আগে মামুন জোয়ার্দারের ক্রস থেকে নকীব যেভাবে মালয়েশিয়ার রক্ষণের মাথার ওপর দিয়ে হেড করে গোলে বল পাঠিয়েছিলেন, এমন দৃশ্য ফুটবলপ্রেমীরা শেষ কবে দেখেছেন; সেটি মনে করতে পারবেন না। গত শনিবার এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের ফরোয়ার্ডরা যেভাবে একের পর এক গোল মিস করেছেন, তাতে স্ট্রেইট টাইমসে প্রকাশিত নকীবের সেই গোলের বর্ণনা স্মৃতিকাতরতার চেয়ে আক্ষেপই তৈরি করে বেশি।

তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগে একটা গোলের জন্য হন্যে ছিল দল। একটি গোল পেলেও সেটিতে খুব লাভ হয়নি। ম্যাচ থেকে ভালো কিছু তুলে নিতে পারেনি হাভিয়ের কাবরেরার দল। কিন্তু সে ম্যাচে কেবল ‘ভালো কিছু’ নয়, ‘দারুণ কিছু’ই পেতে পারত বাংলাদেশ। সে সুযোগও তৈরি হয়েছিল বারবার। তুর্কমেনিস্তান ম্যাচের পর অনেকেই আক্ষেপ করে বলেছেন, ভালো একজন গোলস্কোরার থাকলে তুর্কমেনিস্তানের বিপক্ষে একাধিক গোলেই জেতার কথা বাংলাদেশের।

ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবের মতো একজন স্ট্রাইকার এখন কোথায়?
ফাইল ছবি

গোল করতে না পারার সমস্যা ৩০ বছর আগে ছিল—তা বললে অন্যায় হবে। কিন্তু তখন অন্তত ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব, শেখ মোহাম্মদ আসলাম কিংবা রিজভি করিম রুমিদের মতো কেউ ছিলেন, যাঁরা প্রতি ম্যাচে না হোক অন্তত মাঝেমধ্যে গোল করতে পারতেন। অতীতে বাংলাদেশের ম্যাচগুলোর স্কোরলাইনে ঘুরেফিরে এঁদের নামই দেখা যায়। কিন্তু এখন, এমন কাউকে দেখা যায় না, যিনি নিয়মিত স্কোরলাইনে নাম তুলতে পারেন। সে জন্যই তো এখন বাংলাদেশ দলে একজন ‘সুনীল ছেত্রী’কে খুঁজে বেড়ান ফুটবলপ্রেমীরা। সুনীল ছেত্রীর মতো কেউ না হলেও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া ‘নাইজেরীয়’ এলিটা কিংসলিও জাতীয় ফুটবল দলে এক আরাধ্য নাম।

বাংলাদেশ এক সময় নিয়মিত গোল পেয়েছে রিজভি করিম রুমির কাছ থেকে
ছবি: সংগৃহীত

আজ সন্ধ্যায় এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে ম্যাচ। ১৯৯১ সালে প্রি–অলিম্পিক ফুটবলে নকীবের গোলে সেই জয়টি ছিল অনূর্ধ্ব–২৩ পর্যায়ের। সেটিকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হিসেবে ধরা হয় না। ১৯৯৯ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু কাপে সবশেষ মালয়েশিয়ার একটি দলকে ১–০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। গোল করেছিলেন মিজানুর রহমান ডন। তবে সেই দলটি জাতীয় দল ছিল, না অনূর্ধ্ব–২৩, সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা আছে।

সে হিসেবে ১৯৮২ সালের দিল্লি এশিয়ান গেমসেই মালয়েশিয়ার বিপক্ষে শেষ জয়টি এসেছে বাংলাদেশের। ২–১ গোলের সেই জয়ে বাংলাদেশের হয়ে গোল দুটি করেছিলেন বাদল রায় ও আশিস ভদ্র। এরপর ১৯৮৩ সালে মারদেকা কাপ, আর ১৯৯৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে দুটি ম্যাচে মালয়েশিয়ার কাছে হেরেছে বাংলাদেশ। তবে আশার কথা, মালয়েশিয়ার বিপক্ষে তাদের মাটিতেই সবশেষ দুই দেখায় বাংলাদেশ হারেনি। ২০১২ আর ২০১৫ সালে সবশেষ দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ ড্র হয়েছিল যথাক্রমে ১–১ ও গোলশূন্যভাবে।

আজ কুয়ালালামপুরের বুকিত জলিল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দলের কেউ ‘ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব’, ‘বাদল রায়’ কিংবা ‘আশিস ভদ্র’ হয়ে উঠলে আরও একটা দারুণ গল্প তৈরি হয়ে যায়।