আর্জেন্টিনা যে কারণে ভালো ডিফেন্ডার পায় না
>ফেবারিট তকমাধারীদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল রক্ষণ আর্জেন্টিনা দলের। কেন তাদের রক্ষণে এত ফাটল? কেন আর্জেন্টিনা থেকে উঠে আসে না ভালো মানের ডিফেন্ডার?
রাশিয়া বিশ্বকাপ তো বটেই, কয়েক বছর ধরেই আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা তাদের রক্ষণভাগ। ২০১৪ বিশ্বকাপে জোড়াতালি দিয়ে আলেজান্দ্রো সাবেলা ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই, এক মার্কোস রোহো ছাড়া এবারের বিশ্বকাপে সেই দলের কোনো ডিফেন্ডারই অবশিষ্ট নেই।
রক্ষণভাগের সমস্যা যে আর্জেন্টিনার ঐতিহ্যগত, সেটিও বলা যাবে না। যে দেশ থেকে এসেছেন ড্যানিয়েল প্যাসারেলা, ওস্কার রুগেরি, লুইস মন্টি, রবার্তো আয়ালা, হাভিয়ের জানেত্তি, হুয়ান পাবলো সরিন, লুইস গ্যালভান, হোসে লুইস ব্রাউন, হোসে সিউসিফোর মতো বিশ্বমানের ডিফেন্ডার, সেই আর্জেন্টিনায় কয়েক বছর ধরেই ডিফেন্ডারের স্রোতটা ক্ষীণ।
তবে একেবারেই যে হুট করে এ রকমটা ঘটেছে, সেটি বলা যাবে না। অনেক দিন ধরে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল, আর্জেন্টিনা ফুটবল বিশ্বমানের ডিফেন্ডার সংকটে পড়তে যাচ্ছে। আর এ জন্য দায়ী তাদের ঘরোয়া ফুটবল।
আর্জেন্টিনার ইতিহাস সেরা ডিফেন্ডারদের অধিকাংশই আর্জেন্টিনার ঘরোয়া লিগে খেলে নিজেদের বিশ্বমানের হিসেবে প্রমাণ করেছেন। ১৯৭৮ বিশ্বকাপ ও ১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী দলের প্রত্যেক ডিফেন্ডারই ছিলেন বিশ্বমানের। তখন ইউরোপিয়ান ঘরোয়া ফুটবল এবং লাতিন আমেরিকান ঘরোয়া ফুটবলে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। ফুটবল এত বড় বাণিজ্যও হয়ে ওঠেনি তখন।
ফুটবল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যলক্ষ্মী হয়ে উঠল নব্বইয়ের দশক থেকে। মূলত ইউরোপে। ইউরোপের ফুটবলে খেলা মানেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকার গরিব-মধ্যবিত্ত পরিবারের ফুটবল প্রতিভাগুলো হয়ে উঠতে শুরু করল সোনার ডিম পাড়া হাঁস। এর সবচেয়ে বড় কুফলে ভুগছে আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনার ফুটবলে দিনে দিনে আর্থিক সংকট আরও বেড়েছে। ক্লাবগুলো আরও বেশি করে নির্ভরশীল হয়েছে খেলোয়াড় রপ্তানিতে। ইউরোপের ক্লাবগুলোতে খেলোয়াড় বেচাই এখন আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলোর মূল লক্ষ্য। মূল বাণিজ্য। স্বাভাবিকই একজন ফরোয়ার্ডের দাম বেশি। ডিফেন্ডারদের দাম কম। এ কারণে আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলোর সর্বস্ব বিনিয়োগ থাকে আক্রমণভাগের প্রতিভাগুলোর পেছনে। মনোযোগ সেখানে। যার প্রভাব শুধু ডিফেন্ডার নয়; মিডফিল্ডার সংকটেও পড়েছে।
কয়েক বছর ধরেই আর্জেন্টিনা সবচেয়ে বেশি ফুটবলার রপ্তানি করছে। আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলোর মূল বাণিজ্যই এখন এটা। আর্জেন্টিনা কম বয়সী প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের আঁতুড়ঘর, যে কারণে প্রতিবছরই ক্লাবগুলো ইউরোপে খেলোয়াড় জোগান দিতে পারে। সেই খেলোয়াড় বিক্রির টাকা দিয়েই ক্লাবগুলো নিজেদের টিকিয়ে রাখে। উঠতি ফুটবলারের অভিভাবকেরাও চান সন্তান যেন আক্রমণভাগের ফুটবলার হয়ে ওঠে।
এসব ক্ষেত্রে সাধারণত বয়সভিত্তিক দলগুলোর কোচরা বড় ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা উঠতি প্রতিভাগুলোর ভবিষ্যৎ গতিপথ ঠিক করে দেন। এমন ভূরি ভূরি নজির আছে, আক্রমণভাগে খেলতে উৎসাহী খেলোয়াড়কে শৈশবে ডিফেন্ডার বানিয়ে দিয়েছেন কোচ। আবার ডিফেন্ডারকে মিডফিল্ডার বা ফরোয়ার্ডও বানিয়েছেন। এখানেও ক্লাবগুলোর অর্থলিপ্সা ভোগাচ্ছে আর্জেন্টিনাকে।
আর্জেন্টিনার প্রতিবেশী দেশগুলোর বয়সভিত্তিক ফুটবল কাঠামোতে ফেডারেশনের প্রভাব বেশি বলে সেখানে জাতীয় দলের স্বার্থের ব্যাপারটিও ভেবে রাখা হয়। এই দায়িত্ব ছিল আর্জেন্টিনার ফুটবল সংস্থার। সত্যি বলতে, গত তিন বছরে তিন সভাপতির মধ্য দিয়ে যাওয়া এএফএ এখন নিজেই দেউলিয়া। বিতর্ক হতে পারে জানার পরও ইসরায়েলে তারা প্রীতিম্যাচ খেলতে রাজি হয়েছিল টাকার অঙ্কটা লোভনীয় ছিল বলে। আর্জেন্টিনার ঘরোয়া ফুটবলে অর্থ সংকটের এই দুষ্টচক্র দেশটির জাতীয় দলকে করে তুলেছে বিপন্ন।
যুব বিশ্বকাপে সবচেয়ে সফল দল আর্জেন্টিনা। রেকর্ড ৬ বার যুব বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছে তারা। ২০০৭ সালে জিতেছিল সর্বশেষ। ২০০৭ সালের পর গত ৫ আসরে দুবার তারা বাছাইপর্ব পেরোতে পারেনি। দুবার বাদ পড়েছিল প্রথম রাউন্ডে। ১৯৯৩ সালে কোপা আমেরিকার পর আন্তর্জাতিক ফুটবলে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছিল ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে সোনা জিতে। সেই আর্জেন্টিনা এখন অলিম্পিক ফুটবলেও কোয়ালিফাই করতে পারে না। আর্জেন্টিনার বয়সভিত্তিক দলটাই হয়ে গেছে এলোমেলো। যার পেছনেও আছে ক্লাব ফুটবলের এই নৈরাজ্য।
ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোতে খেলা আর্জেন্টিনার বর্তমান দলের খেলোয়াড়দের তালিকা দেখুন। বিশ্বকাপ স্কোয়াডের ডিফেন্ডারদের মধ্যে কেউই বিশ্বমানের নন। কেবল এক নিকোলাস ওটামেন্ডি ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে নিয়মিত খেলেন। ফেদেরিকো ফাজিও রোমায় খেলেন ঠিকই, এক ম্যাচ খেললে পরের পাঁচ ম্যাচ বসে থাকতে হয়। মার্কোস রোহো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেললেও দলে সুযোগ পান কেবল প্রথম পছন্দের কোনো ডিফেন্ডার চোটে পড়লেই। গ্যাব্রিয়েল মার্কাদো সেভিয়ার মতো দলেও নিয়মিত সুযোগ পান না। এদুয়ার্দো সালভিও, নিকোলাস টাগলিয়াফিকো, মার্কাস একুনারা খেলেন ইউরোপের মাঝারি সারির ক্লাবগুলোতে। এই রক্ষণভাগ নিয়েই বিশ্বকাপ খেলতে এসেছে আর্জেন্টিনা।
অথচ দলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা একেকজন নিজেদের ক্লাবের সেরা তারকা। লিওনেল মেসির কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। ম্যানচেস্টার সিটির মূল স্ট্রাইকার সার্জিও আগুয়েরো, ইতালির সেরা ক্লাব জুভেন্টাসের দুই মূল ভরসা আর্জেন্টিনার গঞ্জালো হিগুয়েইন ও পাওলো দিবালা, পিএসজির অন্যতম সেরা তারকা অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া আগে খেলেছেন রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো ক্লাবে। ইন্টার মিলান অধিনায়ক স্ট্রাইকার মাউরো ইকার্দি তো আর্জেন্টিনা দলে সুযোগই পাননি।
আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগের সঙ্গে রক্ষণভাগের আকাশ-পাতাল তফাত স্পষ্ট। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের বিখ্যাত একটি উক্তি রয়েছে, ‘আক্রমণ আপনাকে ম্যাচ জেতাবে, রক্ষণ জেতাবে শিরোপা।’ অসাধারণ আক্রমণভাগ দিয়ে না হয় দু-এক ম্যাচ জেতা গেল, শিরোপা জেতানোর মতো দৃঢ় রক্ষণভাগই যে আর্জেন্টিনার নেই। গত বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনা ফাইনাল পর্যন্ত পার হয়েছিল রক্ষণে ভর করেই।
আর্জেন্টিনার দুশ্চিন্তা তাই শুধু এবারের বিশ্বকাপ নয়, আগামীর বিশ্বকাপও!