অবসরে সালার ৯ নম্বর জার্সি, আর কোন ক্লাব জার্সি অবসরে পাঠিয়েছে এভাবে?
>উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার এমিলিয়ানো সালার সম্মানে ৯ নম্বর জার্সি আর অন্য কাউকে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফরাসি ক্লাব নঁতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নঁতের হয়ে এই জার্সি পরেই খেলতেন সালা। নঁতের মতো আর কোন কোন ক্লাব কত নম্বর জার্সিকে অবসরে পাঠিয়েছে? কেনই-বা পাঠিয়েছে? আসুন দেখে নেওয়া যাক!
তেমন কারিকুরি না পারলেও, ডি-বক্সে ক্ষিপ্র ও কার্যকরী এক গোলশিকারি ছিলেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার এমিলিয়ানো সালা। আক্রমণভাগের এক প্রান্ত থেকে কোনো সতীর্থ ডিবক্সে ক্রস পাঠালে হেড করে হোক, বা পা দিয়ে শট করে হোক, বলটা প্রতিপক্ষের জালে জড়াতেন তিনি। এমনকি নিজের জীবনের শেষ গোলটাও এভাবে ক্রসে মাথা ঠেকিয়ে করেছেন। এ মৌসুমে নঁতের হয়ে ১৯ ম্যাচ খেলে ১২ গোল করেছেন তিনি। নঁতের হয়ে ক্যারিয়ারে ১৪৪ ম্যাচে ৪৮ গোল করা সালার এই ক্ষিপ্রতা দেখেই তাঁকে দলে আনতে চেয়েছিল ইংলিশ ক্লাব কার্ডিফ সিটি। কার্ডিফ সিটিতে যোগ দেওয়ার পথে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো এই স্ট্রাইকারের জার্সি নম্বরকে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নঁতে।
তবে শুধু নঁতেই নয়, নিজেদের সাবেক খেলোয়াড়কে সম্মান জানিয়ে অনেক ক্লাবই সেই খেলোয়াড়ের ব্যবহার করা জার্সি নম্বরকে অবসরে পাঠিয়েছে। তারা মনে করেছে, উক্ত খেলোয়াড় ওই নম্বরের জার্সি পরে ক্লাবের হয়ে যা কিছু করেছেন, সেই কীর্তি টপকানো সম্ভব নয়। বা কেউ কেউ নঁতের মতো শুধুমাত্র তাদের মৃত খেলোয়াড়কে সম্মান জানানোর জন্যই জার্সি নম্বরকে অবসরে পাঠিয়েছে, ক্লাবের হয়ে সেই খেলোয়াড় তেমন কিছু করুক বা না করুক। আসুন দেখে নেওয়া যাক, আধুনিক ফুটবলে কোন কোন ক্লাব তাদের কত নম্বর জার্সিকে অবসরে পাঠিয়েছে, আর অবসরে পাঠানোর পেছনে কারণই বা কি ছিল।
ম্যানচেস্টার সিটি ও লেন্স
নঁতের মতো খেলোয়াড় হারানোর যন্ত্রণায় পুড়েছে ম্যানচেস্টার সিটিও। ২০০২-০৩ মৌসুমে ফরাসি ক্লাব লিওঁ থেকে ধারে ক্যামেরুনের মিডফিল্ডার মার্ক-ভিভিয়েন ফোকে দলে এনেছিল ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটি, পরতে দিয়েছিল ২৩ নম্বর জার্সি। সিটির হয়ে বেশ খেলছিলেন তিনি, ৩৫ ম্যাচে ৯ গোল করে ফেলেছিলেন তিনি। ক্যামেরুন জাতীয় দলেরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন ফো, দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন ২০০৩ কনফেডারেশনস কাপের সেমিতে। কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেই সেমিফাইনাল খেলতে গিয়ে ৭২ মিনিটে মাঠে লুটিয়ে পড়েন ফো। স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে এসে ৪৫ মিনিট ফো এর চেতনা ফেরানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা, কিন্তু ব্যর্থ হন। হৃদ্রোগের কাছে হেরে ফুটবল মাঠ থেকেই বিদায় নেন ফো। ফো এর সম্মানে ২৩ নম্বর জার্সি অবসরে পাঠায় সিটি। ফো এর সাবেক ক্লাব লেন্সও তাদের ১৭ নম্বর জার্সিটাকে এ কারণেই অবসরে পাঠায়, যে জার্সি পরে লেন্সের মাঠ মাতাতেন ফো।
ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেড
বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তি ইংলিশ সেন্টারব্যাক ববি মুর ওয়েস্ট হামে খেলে গেছেন ক্যারিয়ারের অধিকাংশ সময়। মুরের মৃত্যুর পর ৬ নম্বর জার্সিকে শোকেসে তুলে রাখে ওয়েস্ট হাম। ক্যানসারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে মাত্র ২০ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া অস্ট্রেলিয়ার তরুণ স্ট্রাইকার ডাইলান টোম্বাইডসের সম্মানে ৩৮ নম্বর জার্সি আর অন্য কাউকে না দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়েছে তারা।
এস্পানিওল
দানি জার্কের কথা মনে আছে? ২০১০ বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করে জার্সি খুলে মৃত বন্ধু জার্কের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছিলেন আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা। স্পেনের হয়ে বয়সভিত্তিক দলগুলোতে জার্কের সঙ্গে খেলতেন ইনিয়েস্তা, সেখান থেকে বন্ধুত্বের শুরু, পরে ইনিয়েস্তা বার্সেলোনায় চলে আসলেও বার্সেলোনা শহরের আরেক ক্লাব এস্পানিওলের প্রেমে পড়ে যান জার্ক, সেখানেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খেলে গেছেন তিনি। ২০০৯ সালে বান্ধবীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন জার্ক, মারা যান সঙ্গে সঙ্গে। জার্ককে সম্মান জানিয়ে ২১ নম্বর জার্সিকে অবসরে পাঠায় এসপানিওল।
রিয়াল বেতিস
২০১১ সালে নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার অংশ হিসেবে ডাক্তারের কাছে যান স্প্যানিশ ডিফেন্ডার মিকি রুকি। আগে লিভারপুলের হয়ে খেলা এই ডিফেন্ডারের অন্ত্রে ক্যান্সার ধরা পড়ে তখন। রুকির চিকিৎসার জন্য কার্লেস পুয়োলের মতো কিংবদন্তিরা এগিয়ে এলেও লাভ হয়নি। এক বছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করার পর হেরে যান তিনি। রুকির সম্মানে ২৬ নম্বর জার্সি অবসরে পাঠায় বেতিস।
ভলফসবুর্গ
২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান বেলজিয়ামের তরুণ তারকা মিডফিল্ডার জুনিয়র মালান্দা। সে সময়ে তিনি জার্মান ক্লাব ভলফসবুর্গের হয়ে খেলতেন। মালান্দার মৃত্যুর পরে ১৯ নম্বর জার্সিকে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ক্লাবটি।
ক্যালিয়ারি ও ফিওরেন্টিনা
গত বছর ঘুমের মধ্যেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ইতালির সেন্টারব্যাক ডেভিডে আসতোরি। ইতালির লিগের বেশ জনপ্রিয় এই তারকার সম্মানে ১৩ নম্বর জার্সিকে শোকেসে তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় আসতোরির সাবেক দুই ক্লাব ক্যালিয়ারি ও ফিওরেন্টিনা।
বেনফিকা
২০০৪ সালে বেনফিকার হয়ে খেলতে খেলতেই মাঠে লুটিয়ে পড়েন হাঙ্গেরি জাতীয় দলের স্ট্রাইকার মিকলোস ফেহের। ফেহেরের সম্মানে বেনফিকার হয়ে ২৯ নম্বর জার্সিটা এখন আর কেউ পরে না।
বেইজিং এন্টারপ্রাইজ
আইভরি কোস্টের এই মিডফিল্ডারকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ভক্তরা ভালো চিনে থাকবেন। নিউক্যাসল ইউনাইটেডের হয়ে আট বছর খেলে ২০১৭ সালে পাড়ি জমান চিনের ক্লাব বেইজিং এন্টারপ্রাইজে। সেখানে এক ম্যাচের আগে অনুশীলন করতে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই তারকা। তার সম্মানে ২৪ নম্বর জার্সিকে অবসরে পাঠায় বেইজিং এন্টারপ্রাইজ।
বেথলেহেম বেংথলাং এফসি
গোল করার পর উদ্যাপন করতে গিয়ে মারা যান বেথেলহেমের ভারতীয় স্ট্রাইকার পিটার বিয়াকসাংজুয়ালা। তাঁর সম্মানে ২১ নম্বর জার্সি আর কাউকে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বেথলেহেম।
অরলান্ডো পাইরেটস
২০১৪ সালে ডাকাতদের গুলিতে প্রাণ হারান দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলের গোলরক্ষক সেনজো মেইওয়া। তার সম্মানে ১ নম্বর জার্সিকে অবসরে পাঠায় তার ক্লাব অরল্যান্ডো পাইরেটস।
এ তো গেল মৃত খেলোয়াড়দের সম্মানে ক্লাবগুলোর জার্সি নম্বর অবসরে পাঠানোর কথা। সে খেলোয়াড় ক্লাব কিংবদন্তি হোক বা না হোক। ক্লাব কিংবদন্তি হয়ে নিজ নিজ ক্লাবের হয়ে পরা জার্সি অবসরে পাঠিয়েছেন পাওলো মালদিনি (এসি মিলান, জার্সি নম্বর ৩), ফ্রাঙ্কো বারেসি (এসি মিলান, জার্সি নম্বর ৬) হাভিয়ের জানেত্তি (ইন্টার মিলান, জার্সি নম্বর ৪), জিয়াচিন্তো ফাচেত্তি (ইন্টার মিলান, জার্সি নম্বর ৩) রোজারিও চেনি (সাও পাওলো, জার্সি নম্বর ০১), রবার্তো ব্যাজিও (ব্রেসিয়া, জার্সি নম্বর ১০), ফেরেঙ্ক পুসকাস (হনভেদ, জার্সি নম্বর ১০), লুইজি রিভা (ক্যালিয়ারি, জার্সি নম্বর ১১), ডিয়েগো ম্যারাডোনা (নাপোলি, জার্সি নম্বর ১০), ইয়োহান ক্রুইফ (আয়াক্স আমস্টারডাম, জার্সি নম্বর ১৪), পেলে (নিউ ইয়র্ক কসমস, জার্সি নম্বর ১০), হেনরিক লারসন (হেলসিংবোর্গস, জার্সি নম্বর ১৭), দারিও সরনা (শাখতার দোনেস্ক, জার্সি নম্বর ৩৩), জিয়ানফ্রাঙ্কো জোলা (চেলসি, জার্সি নম্বর ২৫), আলেসান্দ্রো লুকারেল্লি (পারমা, জার্সি নম্বর ৬)। নিজেদের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় জর্জ উইয়াহকে সম্মান জানানোর জন্য লাইবেরিয়ার জাতীয় দল তাদের ১৪ নম্বর জার্সিকেই অবসরে পাঠিয়েছে আবার। উইয়াহ এখন রাজনীতির ময়দানে সফল হয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি হিসেবে।
তা ছাড়া অনেক ক্লাব আছে, যারা তাদের সমর্থকদের ‘দ্বাদশ’ খেলোয়াড় বলে মনে করে। এ কারণে সমর্থকদের সম্মানে ১২ নম্বর জার্সিকে অবসরে পাঠিয়েছে একাধিক ক্লাব। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - বায়ার্ন মিউনিখ, বরুশিয়া মনশেনগ্লাডবাখ, আটালান্টা, জেনোয়া, লাৎসিও, পারমা, পালের্মো, তুরিনো, ফেইনুর্দ, পিএসভি আইন্দহোভেন, স্পোর্টিং লিসবন, জেনিত সেইন্ট পিটার্সবার্গ, সিএসকেএ মস্কো, পোর্টসমাউথ, ওয়ের্ডার ব্রেমেন, ফ্ল্যামেঙ্গো, অ্যাটলেটিকো মিনেইরো, স্পার্তা প্রাগ, গেঙ্ক, লেন্স, রেঞ্জারস, রেড স্টার বেলগ্রেড, এফসি বাসেল, বেসিকতাস, ফেনেরবাচে প্রমুখ।