শিরোপা নির্ধারণে কেমন প্রভাব ফেলবে জানুয়ারির দলবদল
ক্লাব ফুটবলে দল পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে দলবদল। ক্লাবগুলোও চোখ রাখে একটি কার্যকরী দলবদলের দিকে। একটি কার্যকরী দলবদল বদলে দিতে পারে কোনো দলের ভাগ্যও। গত গ্রীষ্মের দলবদলের দিকে ফিরে তাকালেই প্রভাবটা বোঝা যেতে পারে। কাসেমিরোকে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে নিয়ে এসে দলের পরিস্থিতি বদলে ফেলেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
মাঠের খেলা হোক কিংবা দলীয় স্পিরিট—সব জায়গাতেই এই প্রভাব ছিল স্পষ্ট। অতীতে জানুয়ারির দলবদলে দলগুলো সাধারণত অতটা খরচ করত না, যতটা গ্রীষ্মে করত। তবে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে। এবারের জানুয়ারির দলবদলে দেখা মিলেছে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে খেলোয়াড় বেচাকেনার চিত্র। যদিও ইউরোপের অন্য লিগগুলোর তুলনায় প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো এ দিকটাতে অনেক বেশি এগিয়ে ছিল।
চেলসি যেমন এনজো ফার্নান্দেজকে কিনতে গিয়ে দলবদলের ব্রিটিশ রেকর্ড তছনছ করে ফেলেছে। দলবদলে প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ সব দলেই দেখা মিলেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু রদবদলের। এই দলবদলগুলো মৌসুমের বাকি সময়েও পয়েন্ট তালিকায় এবং ইউরোপীয় মঞ্চে ফেলতে পারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব।
দলবদলের শেষ দিনে ম্যানচেস্টার সিটি ছেড়ে ধারে বায়ার্ন মিউনিখ গিয়ে চমকে দিয়েছেন জোয়াও কানসেলো। ম্যান সিটি কোচ পেপ গার্দিওলার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানোর জেরেই মূলত ক্লাব ছাড়তে হলো এই পর্তুগিজ ডিফেন্ডারকে। ২০১৯ সালে দলে আসর পর থেকে সিটির লেফটব্যাক পজিশনে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠেন কানসেলো। কিন্তু চলতি মৌসুমে খেলার সুযোগ কম পাওয়ায় ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারেননি এই পর্তুগিজ।
দল এবং গার্দিওলার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে পড়ায় তাঁকে ধরে রাখার চেষ্টা করেনি সিটি। শেষ পর্যন্ত ৬১ মিলিয়ন পাউন্ডে কেনার সুযোগ রেখে তাঁকে দলে টেনে নিয়েছে বায়ার্ন। কানসেলো না থাকায় সিটিকে এখন নাথান একে এবং রিকো লুইসের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করতে হবে। তবে বড় ম্যাচে তাঁরা কানসেলোর বিকল্প হতে পারবেন কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তবে লুইসের চেয়ে একের ওপরই যে গার্দিওলা অনেক বেশি নির্ভর করবেন সে কথা বলাই যায়। সম্প্রতি এই ডাচ ডিফেন্ডারকে নিয়ে গার্দিওলা বলেছেন, ‘কেউ নাথানকে নিয়ে কথা বলছে না। বর্তমানে লেফটব্যাক হিসেবে সে আমাদের প্রত্যাশার বেশি কিছু দিচ্ছে।’
একের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে গার্দিওলা চাইলে তাঁকে সেন্টারব্যাক হিসেবেও খেলাতে পারেন। পাশাপাশি দলের প্রয়োজনে গোল করা এবং গোলে সহায়তা করা, দুদিকেই ভূমিকা রাখার সামর্থ্য আছে তাঁর। তবে ডিফেন্সিভ লাইনে একে কানসেলোর বিকল্প হয়ে উঠতে না পারলে তা মৌসুমের বাকি সময়ে সিটির জন্য বিপদের কারণ হতে পারে।
গার্দিওলা–কানসেলো দ্বন্দ্বের বড় সুবিধাটা পাবে বায়ার্ন মিউনিখ। লিগে শীর্ষে থাকলেও তাদের সেই অবস্থান সুনিশ্চিত নয়। চ্যাম্পিয়নস লিগেও বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে ‘বাভারিয়ান পরাশক্তি’দের সামনে। সেই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ডিফেন্সিভ লাইনে বায়ার্নকে বাড়তি শক্তি দেবেন কানসেলো।
প্রায় দুই দশক পর প্রিমিয়ার লিগ জয়ের স্বপ্ন দেখছে আর্সেনাল। প্রত্যেক পজিশনেই দলের খেলোয়াড়েরা আছেন দারুণ ছন্দে। তবে সেটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকছে না দলটি। দলের খেলায় প্রভাব রাখতে পারে, এমন আরও কিছু খেলোয়াড় তারা জানুয়ারির দলবদলেই দলে ভিড়িয়েছে।
যেখানে ব্রাইটন থেকে আসা লেয়ান্দ্রো ট্রসার এবং চেলসি থেকে নিয়ে আসা জর্জিনিও উল্লেখযোগ্য। দলে জায়গা পেতে ট্রসারকে লড়তে হবে গ্যাব্রিয়েল মার্তিনেল্লি এবং বুকায়ো সাকার সঙ্গে। নিজের সেরা ছন্দে ছুটছেন সাকা, তাই মার্তিনেল্লির জন্য চ্যালেঞ্জটা কঠিনই হবে। তবে একই পজিশনের জন্য খেলোয়াড়দের এই লড়াই সুবিধা দেবে আর্তেতা ও আর্সেনালকে।
দুই বছর আগে চেলসির চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন জর্জিনিও। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চেলসিতে নিজেকে হারিয়ে খুঁজেছেন এই ইতালিয়ান মিডফিল্ডার। বেশ আগে থেকে তাঁর চেলসি ছাড়াটা অনুমেয় ছিল। শেষ পর্যন্ত স্টামফোর্ড ব্রিজ ছেড়ে আর্সেনালে গেলেন জর্জিনিও। আর্তেতার সঙ্গে বোঝাপড়াটা জমে উঠলে মিডফিল্ডে জর্জিনিওর উপস্থিতি ‘গানার’দের শিবিরে দারুণ গতির সঞ্চার করবে। যা মৌসুমের বাকি সময়ে বাকি দলগুলোর সমস্যা আরও বাড়াতে পারে।
জানুয়ারির দলবদলে টাকার বস্তা নিয়ে মাঠে নেমেছিল চেলসি। মিখাইল মুদরিক, জোয়াও ফেলিক্স, বেনোয়া বাদিয়াশিল এবং এনজো ফার্নান্দেজের মতো প্রতিশ্রুতিশীল ও তারকা দলে ভিড়িয়েছে ব্লুজরা। বর্তমানে প্রিমিয়ার লিগে বেশ ভুগছে গ্রাহাম পটারের দল। পয়েন্ট তালিকায় অবস্থান ১০ নম্বরে। লিগ শিরোপা জয়ের আশা একরকম শেষ। এখন চেলসির লক্ষ্য হতে পারে ঘুরে দাঁড়িয়ে সেরা চারে মৌসুম শেষ করা। পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগেও যত দূর সম্ভব এগোনো। তবে ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট’ হলে চেলসিকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু হারাতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চাকরি নিয়ে সংশয়ে পড়তে পারেন পটারও।
জানুয়ারির দলবদলে খুব একটা হাত খোলেনি শিরোপা লড়াইয়ে থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইডেট। গত গ্রীষ্মে কাসেমিরোকে নিয়ে এসে তাঁর ফল দারুণভাবে উপভোগ করছে ‘রেড ডেভিল’রা। যেভাবে মৌসুমটা তারা পরিচালনা করতে চেয়েছিল, সেটা পুরোপুরিই সফল। জানুয়ারিতে তাই হয়তো বাড়তি খরচের ঝুঁকিতে যেতে চায়নি তারা।
বেসিকতাস থেকে আনা ডাচ তারকা ভাউগ ভেগহোর্স্ট নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পথে আছেন। আর একেবারে শেষ মুহূর্তে তারা চমক দেখিয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ থেকে মার্সেল সাবিটজেরকে ধারে নিয়ে এসে। মিডফিল্ড ও ফরোয়ার্ড দুই জায়গাতেই এক্স–ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন এই অস্ট্রিয়ান তারকা; যা মৌসুমের বাকি সময়ে ইউনাইটেডকে দিতে পারে বাড়তি সুবিধা।
প্রিমিয়ার লিগের আরেক পরাশক্তি লিভারপুলের জন্য দলবদলটা হতাশারই বলা যায়। দলের মাঝমাঠে সমস্যা থাকলেও তারা মূলত দলে এনেছে আক্রমণভাগের খেলোয়াড় কোডি গাপকো। এখন পর্যন্ত নিজেকে ‘অল রেড’ শিবিরে মানিয়ে নিতে পারেননি ডাচ তারকা। জানুয়ারির দলবদল লিভারপুলের বাকি মৌসুমের পারফরম্যান্সে বড় পার্থক্য আনার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ মৌসুমের আশা ছেড়ে দিয়ে লিভারপুল হয়তো এখন আগামী মৌসুম নিয়েই বেশি ভাবছে।
হেক্টর বেলেরিনকে নিয়ে আসা এবং গাভিকে মূল দলের খেলোয়াড় হিসেবে নিবন্ধিত করাকে জানুয়ারির দলবদলে বার্সার বড় সাফল্য বলা যায়। তবে এই দলবদল মাঠের পারফরম্যান্সে বড় কোনো পার্থক্য গড়বে কি না পরিষ্কার নয়। জানুয়ারিতে বড় অঙ্কের খরচের পথে হাঁটেনি রিয়াল মাদ্রিদও। চলমান দল নিয়েই শিরোপা ধরে রাখার লড়াইয়ে নামবে ‘লস ব্লাঙ্কোস’।