‘মেসি মেসি’ শুনলেই কেন খেপে যান রোনালদো
‘যাঁরা আমাকে পছন্দ করেন, তাঁদের মেসিকে ঘৃণা করতে হবে না।’
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। গত সেপ্টেম্বরেই এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন পর্তুগিজ সংবাদমাধ্যম ‘রেকর্ড’কে। রোনালদো তখন ইউরো বাছাইয়ের প্রস্তুতি নিতে পর্তুগালে। দেশের মাটিতে দেশের সংবাদমাধ্যমে দেশের মানুষের উদ্দেশে করা রোনালদোর মন্তব্যটি তখন বেশ সাড়া ফেলেছিল। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে রোনালদোর সেই কথা জায়গা পেয়েছিল পারস্পরিক সম্মানের দৃষ্টান্ত হিসেবে।
কিন্তু সেই একই ব্যক্তিকে ঘিরে এবার ‘৩৬০ ডিগ্রি’ উল্টো প্রশ্ন। অন্যদের মেসিকে ঘৃণা না করতে বলা রোনালদো নিজেই কি আর্জেন্টাইন তারকাকে অপছন্দ করেন? করলে কেন করেন? প্রশ্নটা জোরালো হয়ে ওঠার সাম্প্রতিক কারণ—মেসির নামে স্লোগান শুনে রোনালদোর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা। যার জেরে দৃষ্টিকটু প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে তিনি এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা এবং ৩০ হাজার রিয়াল আর্থিক জরিমানার কবলেও পড়েছেন।
আল শাবাব দর্শকদের প্রতি বাজে অঙ্গভঙ্গির কারণে নিষেধাজ্ঞা ও জরিমানার শাস্তি হওয়াটা রোনালদোর ক্যারিয়ারের নতুন এক দিক। এর আগে শেষবার নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। প্রিমিয়ার লিগের দল এভারটনের এক সমর্থকের ফোন ভাঙায় তাঁকে দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এফএ)। ওই ঘটনার পরপরই ইউনাইটেড ছেড়ে দেওয়ায় সে নিষেধাজ্ঞার শাস্তি কাটিয়েছিলেন সৌদি আরবে গিয়ে। গত বছর আল নাসরের হয়ে তাঁর অভিষেকে বিলম্ব হয়েছিল দর্শকের ফোন ভাঙার ওই ঘটনার জেরেই। সেবার এবং এবার, দুটি ঘটনাই দর্শকের সঙ্গে অসদাচরণ হলেও উৎসটা ভিন্ন। এবারের ঘটনার কেন্দ্রে যেমন ‘মেসি’ নামের উপস্থিতি।
সৌদি আরবের লিগে যোগ দেওয়ার পর এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবারই মাঠে মেসির নামে স্লোগান শুনেছেন রোনালদো। প্রথম দিকে ব্যাপারটি পাত্তা দিতে চাননি। এড়িয়ে গেছেন। এমনকি আল হিলালের বিপক্ষে ম্যাচের পর একবার তাঁকে ত্যক্ত করতে থাকা দর্শকদের উদ্দেশে উড়ন্ত চুমুও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, তাঁর উদ্দেশে দর্শকদের ‘মেসি মেসি’ স্লোগানে রোনালদোর মেজাজ চড়েছে। কোনোবার মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করার ইশারা করেছেন, কখনো আবার ক্ষোভ মেটাতে বোতলে কিংবা শূন্যে লাথি ছুড়েছেন।
মেসির নাম শুনে রোনালদোর মেজাজ চড়ে যাওয়ার ঘটনা কিন্তু সৌদি আরবেই প্রথম দেখা যাচ্ছে না। মেসি বার্সেলোনায় থাকতে রোনালদোর সঙ্গে তাঁর দ্বৈরথের শুরুটা হয় ২০০৯ সালে, তাঁর রিয়াল মাদ্রিদে যোগদানের মাধ্যমে। এর পর থেকেই মেসি, রোনালদো উভয়ের সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকদের একটি প্রশ্ন ছিল প্রায় অবধারিত, ‘কে সেরা?’ এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর মেসি বেশির ভাগ সময়ই এড়িয়ে গেছেন।
কিন্তু ২০১১ সালে রোনালদো কোনো রাখঢাক না রেখে সগৌরবে বলে বসেন, তিনি মেসির চেয়ে সেরা। মূলত তখন থেকেই দর্শকেরা রোনালদোর উদ্দেশে মেসির নামে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ২০১৪ সালে পর্তুগালের গিমারেসে জাতীয় দলের অনুশীলনেও ‘মেসি মেসি’ শুনতে হয়েছিল রোনালদোকে। এ নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে রোনালদো তখন বলেছিলেন, ‘আমি ওদের খেলোয়াড়ের চেয়ে ভালো বলেই এভাবে চিৎকার করে।’ (সূত্র: মার্কা)
২০১১ সালে মেসি যখন হ্যাটট্রিক ব্যালন ডি’অর জেতেন, রোনালদোর হাতে ওঠে সর্বোচ্চ গোলদাতার ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু পুরস্কার। নিজের পুরস্কারটিকে এগিয়ে রাখতে গিয়ে রোনালদো এমনও মন্তব্য করেন যে, ‘এই গোল্ডেন বুটটা আমি মেসির (ব্যালন ডি’অর) পুরস্কারের সঙ্গে বদলাতে চাইব না। কারণ, আমার পুরস্কারটা অন্যের ভোটের ওপর নির্ভর করে না।’ (সূত্র: এই পাইস)। তবে পরের বছর মেসি চতুর্থ ব্যালন ডি’অর স্বর কিছুটা নরম করেন রোনালদো। সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেসির সঙ্গে দ্বৈরথ প্রশ্নে তিনি নিজেকে ক্লান্ত উল্লেখ করে বলেন, ‘পোরশের সঙ্গে ফেরারির তুলনা চলে না। কারণ, ইঞ্জিন ভিন্ন। একজন বার্সেলোনার জন্য সেরাটা দেয়, অপরজন রিয়াল মাদ্রিদের জন্য...শেষ পর্যন্ত লোকেই সিদ্ধান্ত নেবে কে সেরা। তবে এই মুহূর্তে...আমার মনে হয় আমিই এগিয়ে (হাসি)।’
রোনালদো এগিয়ে—এ কথা যদি তিনি না–ও বলতেন, তবু শুধু পোরশে ও ফেরারির উদাহরণ দিয়েও একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। পোরশে ও ফেরারি—দুটিই অভিজাত ও বিলাসবহুল গাড়ি। কিন্তু রেসিং বিবেচনায় ফেরারি বেশি জনপ্রিয়—রোনালদো অনুচ্চারে হয়তো এই কথাটাই বোঝাতে চেয়েছেন।
এর কয়েক মাস পর ইউরোর ম্যাচে ডেনিশ দর্শকদের দুয়ো শোনার পর সরাসরিই মেসির নাম টেনে আনেন রোনালদো। ২০১১ কোপা আমেরিকায় মেসির আর্জেন্টিনার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়ার কথা তুলে পর্তুগিজ তারকা বলেন, ‘গত বছর এই সময়ে সে কোথায় ছিল জানো? সে তার নিজের দেশেই কোপা আমেরিকা থেকে ছিটকে গেছে। এটা কি বাজে নয়?’ (সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান)। ২০১৪ বিশ্বকাপে মেসির গোল্ডেন বল জেতা নিয়ে পর্তুগিজ টিভিকে রোনালদো বলেছিলেন, ‘সত্যি কথা বললে ওরা আমাকে জেলে ছুড়ে মারবে।’
এভাবেই দিনে দিনে মেসির সঙ্গে দ্বৈরথটাকে জনপরিসরের আলোচনায় ঝাঁজালো পর্যায়ে নিয়ে যান রোনালদো। যা তীব্র হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত ও দলগত সাফল্যে নিজেকে তিনি আরও উচ্চতায় তোলার কারণেও। ২০১৩ থেকে ২০১৭—এই পাঁচ বছরের মধ্যে চারবার ব্যালন ডি’অর জেতেন রোনালদো। ২০১৬ সালে ইউরো জিতে আন্তর্জাতিক ফুটবল সাফল্যে মেসিকে ছাড়িয়েও যান। তবে শুরুর দিকের মতো চাঁছাছোলা মন্তব্য পরে অনেকটাই কমে এসেছিল। ২০১৯ ব্যালন ডি’অরের অনুষ্ঠানে দুজন প্রথমবারের মতো পাশাপাশি বসেন। এমনকি ভবিষ্যতে সময়-সুযোগ পেলে ডিনারে যাওয়ার কথাও জানান সংবাদমাধ্যমে।
রোনালদো ২০১৮ সালে রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়লে লা লিগায় দুজনের দ্বৈরথ থেমে যায়। ২০২১ সালে বার্সেলোনা ছেড়ে যান মেসিও। তবে একই বছরে মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা আর ২০২২ সালে ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে তুলে সাফল্যে অনেকটাই রোনালদোর চেয়ে এগিয়ে যান। মেসি কাতারে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে তোলার সপ্তাহখানেক পরই ইউনাইটেড ছেড়ে সৌদি আরবের লিগে যাওয়ার কথা জানান রোনালদো। মেসির বিশ্বকাপ জয় এবং রোনালদোর ইউরোপ ত্যাগে অনেকেই দুজনের ক্যারিয়ারের উপসংহার দেখে ফেলেছিলেন।
কিন্তু সৌদি আরবের ঘরোয়া ফুটবলে ৩৮ পেরিয়েও নিজেকে চেনা ছন্দে তুলে ধরতে শুরু করেন রোনালদো। গোলের পর গোলে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে রাখতে সক্ষমও হন। ওদিকে মেসিও পিএসজি ছেড়ে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের এমএলএসের দল ইন্টার মায়ামিতে। ২০১৮ সালে রোনালদোর মাদ্রিদ ছাড়ার মাধ্যমে যে দ্বৈরথের শেষ দেখে ফেলেছিলেন অনেকে, সেটিই ফিরে আসে ভিন্ন রূপে, সৌদি লিগ বনাম যুক্তরাষ্ট্রের লিগে।
গত বছরের জুলাইয়ে মেসি যখন মায়ামির হয়ে অভিষেকের অপেক্ষায়, তখনই রোনালদো মন্তব্য করে বসেন, যুক্তরাষ্ট্রের লিগের চেয়ে সৌদি আরবের লিগ ভালো। (সূত্র: আ বোলা)। পরে আরেক সাক্ষাৎকারে এমনও বলেন যে ক্ষেত্রবিশেষে ফ্রান্সের লিগ আঁর চেয়েও ভালো সৌদি প্রো লিগ। মেসিকে কেন্দ্র করে রোনালদোর সর্বশেষ আলোচিত মন্তব্যটি আসে এ বছরের জানুয়ারিতে। মেসির অষ্টম ব্যালন ডি’অর জয়কে ইঙ্গিত করে রোনালদো দুবাইয়ে গ্লোব সকার অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের পর বলেন, ‘ব্যালন ডি’অর আর ফিফা দ্য বেস্ট বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে। এই পুরস্কারগুলোতে আমার আর আস্থা নেই।’ (রেকর্ড)
এই যে বছরের পর বছর ধরে রোনালদোর নিজেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মেসির চেয়ে এগিয়ে রাখার চেষ্টা, এর কারণটা...