‘স’তে সালাউদ্দিন, ‘স’তে সমালোচনা
বাংলাদেশের কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদদের মধ্যে তাঁর নামটা ওপরের দিকেই থাকবে। দ্বিমত প্রকাশের জন্য নিশ্চয়ই নড়েচড়ে বসেছেন অনেকে। ২০০৮ সালে বাফুফে সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৩ বছরে কাজী সালাউদ্দিনের প্রশংসা শোনা গেছে কদাচিৎই। বরং সালাউদ্দিন মানেই যেন বিতর্ক। অবস্থা এমন যে, কেউ বলতেই পারেন—‘স’তে সালাউদ্দিন, ‘স’তে সমালোচনা। তারপরও সালাউদ্দিনের পরিচয় দিতে গিয়ে আগে ‘কিংবদন্তি’ বলা কেন!
ফুটবল মাঠের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতির আসনে স্বস্তিতে থাকেন না কখনোই। অথচ কী আশ্চর্য! রাজনীতির চাদরে মোড়ানো বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বলতে গেলে তিনিই একমাত্র ফেডারেশন সভাপতি, যিনি খেলাটা মাঠে খেলে এসেছেন। রাজনীতির সাতে–পাঁচেও নেই।
সভাপতি হতে হলে সাবেক খেলোয়াড় হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। তবে সাবেক খেলোয়াড় সভাপতি হলে একটা বাড়তি গ্রহণযোগ্যতা তো তৈরিই হয়ই। তার ওপর আবার সালাউদ্দিনের মতো কিংবদন্তি খেলোয়াড়। কিন্তু সালাউদ্দিন কি সেই গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছেন?
উত্তরে ‘না’ ধ্বনিটাই জোরালো শোনা যাবে নিশ্চিত। বরং ট্র্যাজেডি এই— সভাপতি হিসেবে যে খেলার ফেডারেশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এক সময় মাঠে নিজে সেই খেলাটা খেললেও, সেই খেলায় দেশকে নেতৃত্ব দিলেও আজ ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিসমাজে তিনিই সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত। দেশের সাধারণ ক্রীড়ানুরাগী থেকে শুরু করে সতীর্থ সাবেক ফুটবলার, অন্য ফেডারেশনের সভাপতি, এমনকি দেশের ক্রীড়ামন্ত্রীও সুযোগ পেলেই সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেন সালাউদ্দিনকে। বাংলাদেশের আর কোনো ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিকে এতটা সমালোচনা সহ্য করতে হয় না।
বাফুফে সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগের বহিষ্কারাদেশ আরও একবার এনে দিয়েছে সে উপলক্ষ। ফিফার রায়ের কোথাও সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তবু স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রশ্নটা উঠে যাচ্ছে যে, বাফুফে সভাপতির প্রশ্রয় না পেলে এত অনিয়মের জঞ্জাল কিভাবে জমা হয়! বাফুফে সভাপতি হিসেবে এটা তো তাঁর জন্য বড় এক প্রশাসনিক ব্যর্থতাই।
সালাউদ্দিন নিজেও সেই দায় এড়াচ্ছেন না। কাল বিকালে বাফুফে ভবনে সভাপতির কক্ষে প্রসঙ্গটা উঠতেই সালাউদ্দিন বললেন, ‘অবশ্যই। দায় তো আমাকেই নিতে হবে।’
কিন্তু এই যে পেছনে বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ার রেখেও বাফুফে সভাপতি হিসেবে তিনি এতটা বিতর্কিত, সেটা কি ব্যথিত করে না সালাউদ্দিনকে? সেই প্রশ্নও করা হয়েছিল তাঁকে। সালাউদ্দিন এবারও আত্মসমর্পণই করলেন, ‘অবশ্যই করে। এটা কখনোই ভালো অনুভূতি দেয় না।’
তবে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁকে নিয়ে কেন এত সমালোচনা, ‘আমার এখানে (বাফুফে) সবকিছু উন্মুক্ত। যে কেউ আসতে পারে। যার যেভাবে খুশি সমালোচনা করে। আমি কিচ্ছু বলি না। অন্যান্য অনেক ফেডারেশনেও অনেক সমস্যা আছে। সেগুলো নিয়ে কেউ কিছু বলে না।’
বাফুফে সভাপতি হিসেবে সালাউদ্দিনের অর্জনও কি নেই? এক সময় মাঠের খেলাটা অনিয়মিত হয়ে পড়লেও তাঁর সময়ে সেটি নিয়মিত হয়েছে। খেলোয়াড়েরা খেলার মধ্যে থেকেছেন। পারফরম্যান্স যেমনই হোক, জাতীয় দল নিয়মিত পেয়েছে বিদেশি কোচিং স্টাফ। দেশের বাইরে প্রস্তুতি ক্যাম্প করছে জাতীয় দল, এক সময় যা ভাবাও যেত না। মেয়েদের ফুটবলে যে অভাবনীয় সাফল্য সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়, সেটির পেছনেও আছে সালাউদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতা। তা সভাপতি হিসেবে যেমন, ব্যক্তিগতভাবেও।
পাল্টা প্রশ্ন আসতেই পারে—মেয়েরা ভালো করছে, কিন্তু ছেলেদের ফুটবলে তো উন্নতির কোনো রেখা ফুটিয়ে তুলতে পারছেন না সালাউদ্দিন। সে প্রশ্নেরও উত্তর আছে তাঁর কাছে, ‘মেয়েরা ভালো করছে, কারণ এই মেয়েদের আমরা দীর্ঘদিন একসঙ্গে রেখে অনুশীলন করিয়েছি। ওরা আমাদের অধীনে থাকে। ক্লাবের খেলার সময় মাস দুয়েকের জন্য ছাড়া হয়, এরপর আবার আমাদের কাছে চলে আসে। ছেলেদের ফুটবলে সে সুযোগ নেই। তারা বছরের বেশিরভাগ সময় ক্লাবের অধীনেই থাকে।’
সালাউদ্দিনের অর্জন নিয়েও নিশ্চয়ই ভিন্নমত আছে। না থাকলেও বাফুফে সভাপতি হিসেবে দিনে দিনে তাঁকে ঘিরে সমালোচনার পাহাড় এতটাই উঁচু হয়েছে যে, তাঁর যা কিছু ভালো, সেসবও ঢাকা পড়ে যায় তার আড়ালে। বাংলাদেশের ফুটবলে তাই এটাই বাস্তব—‘স’তে সালাউদ্দিন, ‘স’তে সমালোচনা।