জিরোনা: রিয়াল–বার্সাও যাদের পেছনে পড়েছে
৯৩ বছর ধরে কেউ সেভাবে আলোচনা করেনি তাদের কথা। একটা সাধারণ ক্লাব হিসেবেই বিশ্ব ফুটবলে মানচিত্রের এক কোনায় পড়ে ছিল। এত এত বড় নামের ভিড়ে অবশ্য জিরোনার মতো নিতান্তই সাদামাটা একটি দলের দিকে তাকানোর সময় কোথায়! মানুষের দৃষ্টি সব সময় তাক করা থাকে ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অর্জনের দিকে, যা একেবারে অমূলকও নয়।
কিন্তু ফুটবলের চিরন্তন সৌন্দর্যের ভেতর লুকিয়ে থাকে কিছু অলৌকিক গল্পও। যা অনেক সময় ঘুচিয়ে দেয় বড়-ছোট কিংবা শক্তি-দুর্বলতার ব্যবধানও। ফুটবলের সেই অলৌকিক সৌন্দর্যেই লেস্টার সিটির মতো দল আবির্ভূত হয় প্রিমিয়ার লিগের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে। একই পথ ধরেই ৩৩ বছর পর লিগ জেতে নাপোলির মতো ক্লাব। সেই অলৌকিকতার কারণে এই মুহূর্তে লা লিগার পয়েন্ট টেবিলের দিকে তাকালে আপনি সবার ওপরে দেখবেন জিরোনার নাম।
ক্লাব ফুটবলের খবর নিয়মিত না রাখলে প্রথম দেখায় আপনার বিশ্বাস না–ও হতে পারে। তাই হয়তো চোখ কচলে দ্বিতীয়বার তাকাবেন। কিন্তু এরপরও শীর্ষে যে দলকে দেখবেন, সেটি বর্তমান চ্যাম্পিয়ন বার্সেলোনা নয়, নয় জুড বেলিংহামের রিয়াল মাদ্রিদও, এমনকি স্প্যানিশ ক্লাব ফুটবলের তৃতীয় পরাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়া আতলেতিকো মাদ্রিদও নয়। সেই দলের নাম জিরোনা। তা–ও এক বা দুই ম্যাচ পর নয়, ১৩ লিগ ম্যাচ শেষে শীর্ষে আছে দলটি।
এমন নয় যে রিয়াল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনা খারাপ খেলায় জিরোনা শীর্ষে উঠে এসেছে। নিজেদের সেরা ফুটবল খেলেই সবার ওপরে অবস্থান করছে কাতালান ক্লাবটি। ১৩ ম্যাচে ১১ জয়ের সঙ্গে আছে একটি ড্র ও একটি হার। একমাত্র হারটি রিয়ালের বিপক্ষে। এর আগে ১২ ম্যাচ শেষে জিরোনা যখন শীর্ষে ছিল, তখনই একাধিক রেকর্ড নিজেদের করে নিয়েছিল তারা। যেমন গত ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বার্সেলোনা, রিয়াল ও আতলোতিকোর বাইরে কোনো দল হিসেবে ১২ ম্যাচ শেষে শীর্ষে থাকার কৃতিত্ব দেখিয়েছে জিরোনা। এ ছাড়া ইতিহাসের চতুর্থ দল হিসেবে প্রথম ১৩ লিগ ম্যাচের ১১টিতেই জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছে জিরোনা। অন্যদের মধ্যে রিয়াল ৭ বার, বার্সেলোনা ৬ বার ও আতলেতিকো ২ বার এ কীর্তি গড়েছিল।
একের পর এক কীর্তি গড়ে চলা জিরোনা অবশ্য মাত্র চতুর্থবারের মতো স্প্যানিশ ফুটবলের শীর্ষ স্তরে খেলতে এসেছে। এমনকি ১৭ বছর আগেও আরও ৩৬৪টি আঞ্চলিক দলের সঙ্গে চতুর্থ স্তরে খেলেছিল জিরোনা। পুরোনো সেই দুঃস্বপ্নই যেন এখন জিরোনার জন্য রূপকথার গল্পের মতো। প্রশ্ন হচ্ছে, জিরোনার আকস্মিক এই সাফল্যের শিকড় আসলে কোথায়?
এই সাফল্য যতটা আকস্মিক মনে হচ্ছে, ততটা কিন্তু নয়। শুরুটা হয়েছিল ২০১৭ সালে ১ হাজার মাইল উত্তরে ইংল্যান্ডের শহর ম্যানচেস্টারের নীল অংশে। সে বছর জিরোনা ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল গ্রুপের (সিএফজি) অংশ হয়। সে মৌসুমে রিয়ালকে হারিয়ে চমকও সৃষ্টি করে তারা। এরপর ধীরে ধীরে সিটির পরামর্শ এবং সাংগঠনিক কাঠামোর সুফলও ভোগ করছে তারা।
জিরোনা সিটির খেলোয়াড়দের দ্বারাও বেশ লাভবান হয়েছে। সিটিতে প্রিমিয়ার লিগের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য তৈরি হওয়া অনেক খেলোয়াড়কে পেপ গার্দিওলার মানদণ্ডে উতরাতে না পারায় বিক্রি করে দেওয়া হয় অন্য ক্লাবে। তেমন খেলোয়াড়কে কিনেও সুফল পেয়েছে জিরোনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় স্ট্রাইকার টাটি ক্যাস্টেলানোসের কথা। গত মৌসুমে জিরোনার হয়ে ১৪ গোল করেন ক্যাস্টেলানোস। যাঁকে জিরোনা ধারে এনেছে নিউইয়র্ক সিটি এফসি থেকে। নিউইয়র্ক সিটিও সিএফজির আরেকটি ক্লাব। পরে তাঁকে অবশ্য লাৎসিও কিনে নিয়েছে ২০ মিলিয়ন ইউরোতে। জিরোনার বর্তমান দলেও এমন অনেক খেলোয়াড় আছেন, যাঁদের সরাসরি সংযোগ আছে সিটির সঙ্গে।
১৯ বছর বয়সী ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার সাভিও, যিনি এ মৌসুমে ৩ গোলের সঙ্গে ৪ গোলে সহায়তাও করেছেন। এই তরুণ এসেছেন সিএফজির আরেকটি ক্লাব ট্রয়েস থেকে। ব্রাজিলিয়ান রাইটব্যাক ইয়ান কোটো তো সরাসরি ম্যান সিটি থেকেই এসেছেন। একইভাবে আগ্রাসী মিডফিল্ডার ইয়াংগেল হেরেরাও সিটি থেকে একাধিক ক্লাবে ধারে খেলে এসেছেন জিরোনাতে। এখন পর্যন্ত ৪ গোল করেছেন ইয়াংগেল।
আর সব শেষে বলতে হয় অ্যালেইক্স গার্সিয়ার কথা। সিটি থেকে আসা আরেকজন, যিনি সম্ভবত জিরোনার এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ও। সিটির হয়ে ২০১৫-১৭ সাল পর্যন্ত ৯ ম্যাচে খেলা গার্সিয়া জিরোনার হয়ে নিজের সেরা ছন্দে আছেন। ফাইনাল থার্ডে বল স্পর্শ এবং পাস দেওয়ায় লা লিগায় শীর্ষে আছেন এই স্প্যানিয়ার্ড। এমনকি মাঠের বাইরেও জিরোনায় আছে সিটির দারুণ সংযোগ। বর্তমানে ক্লাবটির নির্বাহী সভাপতির নাম পেরে গার্দিওলা, যিনি সম্পর্কে পেপ গার্দিওলার ভাই। নানাবিধ এই সংযুক্তির কারণেই জিরোনার ফুটবল-দর্শনে প্রতিফলিত হয় সিটির প্রভাব। যেখানে দলটিকে আক্রমণাত্মক ফুটবল এবং ইনভার্টেড ফুলব্যাকদের ব্যবহার করে পজেশনভিত্তিক ফুটবল খেলতে দেখা যায়।
এরপরও জিরোনাকে পুরোপুরি সিটি ২.০ ভাবা ভুল হবে। আর সিএফজি সংযুক্তি তাদের সাফল্যের একটি কারণ হলেও একমাত্র নয়। এই ক্লাবে দুজন স্থানীয় ব্যক্তির দারুণ প্রভাব আছে, যাঁদের ব্যক্তিত্ব ও ফুটবল–দর্শন ক্লাবটিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। যাঁর একজন হলেন ক্লাব সভাপতি দেলফি গেলি। যিনি জিরোনা, বার্সেলোনা ও আতলেতিকো মাদ্রিদের হয়ে খেলেছেন। এরপর ২০১৫ সালে প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়ে নতুন যাত্রা শুরু করেন জিরোনায়।
আর অন্যজন হলেন স্পোর্টিং ডিরেক্টর কুইকে কারসেল। ২০১৪ সাল থেকে যিনি ক্লাবের সঙ্গে আছেন। ক্লাবের জন্য খেলোয়াড় বাছাইয়ে তাঁর বিচক্ষণতা দারুণ ভূমিকা রেখেছে জিরোনার বিকাশে। অল্প বাজেটে ক্লাবের জন্য কার্যকর সব খেলোয়াড়কে বাছাই করেছেন কারসেল, যা ক্লাবকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের একাধিক ক্লাব থেকে বেশ কিছু খেলোয়াড় নিয়ে এসেছেন তিনি, যা দলকে দারুণভাবে লাভবান করেছে।
আর সর্বোপরি বলতে হবে জিরোনার কোচ মাইকেলের কথা। ২০২১ সালের গ্রীষ্মে দায়িত্ব নিয়ে জিরোনাকে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে শীর্ষ লিগে নিয়ে আসেন এই স্প্যানিশ কোচ। তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে দলকে দারুণভাবে দাঁড় করান মাইকেল। একইভাবে স্থানীয় প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের সঙ্গে মেধাবী আন্তর্জাতিক ফুটবলারদের দারুণ একটি সমন্বয় তৈরি করেন তিনি। রীতিমতো অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টরের মতো পুরো দলটিকে পরিচালনা করেন মাইকেল।
চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত জিরোনার সবকিছু ঠিকঠাক পথেই এগিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রাখলে দারুণ কিছু করতে পারে তারা। দলটিকে নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ কোচ কার্লো আনচেলত্তি বলেছেন, ‘জিরোনার জন্য সবকিছু ভালোভাবেই এগোচ্ছে। এটা মনে রাখা দরকার যে তারা ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় খেলছে না এবং প্রতিটি ম্যাচেই জয়ের জন্য খেলবে তারা। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে দলটি লা লিগার চ্যাম্পিয়নশিপের জন্যই লড়াই করবে।’
তবে দুর্দান্ত গতিতে এগোলেও সামনের দিনগুলোতে জিরোনার জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে তাদের অনভিজ্ঞতা। বড় শিরোপা অর্জনের কোনো ইতিহাস যে নেই। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে তাদের ওপরে উঠে আসতে পারে রিয়াল-বার্সার মতো পরাশক্তিরা। কিন্তু এরপরও লিগের প্রথম ১৩ ম্যাচে জিরোনা যে রোমাঞ্চ উপহার দিয়েছে, তা অনেক দিন মনে রাখার মতোই। আর শেষ পর্যন্ত লেস্টারের মতো রূপকথা লিখে ফেললে সেটা তো ফুটবলের চিরকালীন রূপকথারই অংশ হয়ে যাবে।