আবাহনী–মোহামেডান ফাইনালের স্মরণীয় ৫
আবাহনী–মোহামেডানের ম্যাচ মানেই একসময় ছিল তীব্র উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ। এই ম্যাচ মানেই ছিল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া একটা দেশ। দর্শক–সমর্থকদের স্নায়ুক্ষয়ী অপেক্ষা। কানায় কানায় পূর্ণ স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে উত্তাপ। পাড়ায়, মহল্লায় বাড়ির ছাদে দুই দলের পতাকার প্রদর্শন। ম্যাচের দিন স্টেডিয়াম পাড়ায় সকাল থেকে অঘোষিত কারফিউ। বিকেলে জনস্রোত। কালোবাজারিদের হাঁকডাক; একই সঙ্গে অজানা এক শঙ্কা, আতঙ্ক। সেই দিন গেছে, একেবারেই গেছে। আবাহনী–মোহামেডান নিয়ে এই প্রজন্ম আগ্রহ হারিয়েছে। হালের ফুটবলপ্রেমীদের মানসপট থেকে কীভাবে যেন হারিয়ে গেছে এর রোমাঞ্চ। আবাহনী–মোহামেডান দ্বৈরথ এখন আর আগুন ঝরায় না, উৎকণ্ঠা তৈরি করে না। সমর্থকদের স্নায়ুক্ষয় দূরের কথা, সামান্য আগ্রহও তৈরি করে না। এই দুই দলের লড়াই তাই এখন কেবলই স্মৃতি।
আজ ফেডারেশন কাপের ফাইনাল। ১৪ বছর পর মুখোমুখি দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় দুই নাম আবাহনী ও মোহামেডান। কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে আজ বিকেলে এই ম্যাচ একটা প্রজন্মকে স্মৃতিকাতর করবেই। অতীতের সেই দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে হাল প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য এই লেখায় তুলে আনা হলো এই দুই দলের ‘ফাইনালের’ কিছু স্মরণীয় স্মৃতি...
মিরপুর স্টেডিয়ামের প্রথম ‘ফাইনালে’ জয়ী আবাহনী
১৯৮৮ সালের ফেডারেশন কাপের ফাইনাল। মিরপুর স্টেডিয়াম তখন সবে নির্মিত হয়েছে। ফেডারেশন কাপ দিয়েই উদ্বোধন হয়েছিল স্টেডিয়ামটির। মিরপুর স্টেডিয়ামটি সে সময় ২ নম্বর জাতীয় স্টেডিয়াম হিসেবে পরিচিত ছিল। এক নম্বর জাতীয় স্টেডিয়াম ছিল বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম (তখনকার ঢাকা স্টেডিয়াম)। এটি নির্মিত হয়েছিল ফুটবলের জন্য। পরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম নিয়ে ফুটবল আর ক্রিকেটের দড়ি–টানাটানির কারণে ক্রিকেট বোর্ডকে মিরপুর স্টেডিয়াম দিয়ে দেওয়া হয়। এখন তো এটি ‘হোম অব ক্রিকেট’। সেই মাঠেরই প্রথম আবাহনী–মোহামেডান দ্বৈরথে জিতেছিল আবাহনী। সেদিন মিরপুর স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় ভরা। মোহামেডান তখন দুর্দান্ত দল। দলে দুই ইরানি ফুটবলার—রেজা নালজেগার ও ভিজেন তাহিরি। থাইল্যান্ড থেকেও নিয়ে আসা হলো রান্নাচাই নামের জাতীয় দলের এক ফুটবলারকে। নাইজেরিয়ান এমেকা ইজিউগোও দলে ছিলেন। যদিও তাঁকে শৃঙ্খলার কারণে সেদিন খেলাননি ইরানি কোচ নাসের হেজাজি। বিদেশি খেলোয়াড়ে ঠাসা মোহামেডানের বিপরীতে আবাহনী ছিল কিছুটা দুর্বল। দলে কেবল দুই শ্রীলঙ্কান—পাকির আলী ও প্রেমলাল। এ ম্যাচটা মোহামেডান সমর্থকদের স্তব্ধ করে দিয়ে জিতে যায় আবাহনী। গোল করেছিলেন ফখরুল ইসলাম কামাল। ঢাকার ফুটবলে যিনি পরিচিত ছিলেন এফআই কামাল নামে।
আবাহনী–মোহামেডান যখন যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন
১৯৮২ ফেডারেশন কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল আবাহনী ও মোহামেডান। ঢাকা স্টেডিয়ামে ৯০ মিনিটের স্নায়ুক্ষয়ী লড়াইয়ে গোল পায়নি কোনো দলই। অতিরিক্ত সময় কিংবা টাইব্রেকারে গেলে দর্শক হাঙ্গামার ‘ঝুঁকি’ বাড়তে পারে, এমন কারণে সেবার দুই দলকেই যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়েছিল। আবাহনী–মোহামেডান লড়াইয়ের ইতিহাসে যুগ্ম চ্যাম্পিয়নের ঘটনা সেবারই প্রথম।
দর্শকদের বিশৃঙ্খলা, পণ্ড হয়ে গেল ফাইনাল
১৯৮৪ সালে ফেডারেশন কাপে আবাহনী–মোহামেডান ফাইনাল উত্তেজনার ঢেউ তুলেছিল। শ্বাসরুদ্ধকর সেই লড়াইয়ে মাঠে দুই দলই ছিল সমানে সমান। কিন্তু এই লড়াই উত্তেজনা ছড়িয়েছিল ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে ছিল প্রচুর দর্শক। গ্যালারিতে যেন ঠাঁই মিলছিল না। ম্যাচের এক পর্যায়ে কাঁটাতারের বেড়া টপকে হাজার হাজার দর্শক মাঠে ঢুকে পড়লে খেলা পণ্ড হয়ে যায়। ওই সময় স্কোরলাইন ছিল ১–১। মোহামেডানের পক্ষে গোল করেছিলেন মোস্তফা কামাল, আবাহনীর পক্ষে শেখ মোহাম্মদ আসলাম।
মোহামেডানের ‘হিরো’র নাম মোস্তাকিম
১৯৯০ সালের ফেডারেশন কাপের ফাইনাল মোহামেডানের জন্য স্মরণীয়। মিরপুর স্টেডিয়ামের ম্যাচে মোহামেডান রিজভি করিম রুমির পেনাল্টি থেকে করা গোলে ১–০ গোলে পিছিয়ে ছিল অনেকটা সময়। নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে সেই গোল শোধ করে দিয়েছিলেন মোস্তাকিম ওয়াজেদ। মোহামেডান সমর্থকদের জন্য মোস্তাকিমের সেই গোলটি ছিল পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। তরুণ মোস্তাকিম খুব নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন না মোহামেডানের। সেই গোলে খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। ১১৩ মিনিটে আবার জাদু দেখান মোস্তাকিম। নিজের দ্বিতীয় গোলটি করে হয়ে যান মোহামেডানের নায়ক।
এক থ্রোতেই সর্বনাশ মোহামেডানের
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল দেশের উপকূলীয় অঞ্চল। সেই ঘূর্ণিঝড়ের দুর্গত মানুষের সাহায্যে ঢাকা ও কলকাতার ছয় প্রধান ক্লাবকে নিয়ে আয়োজিত হয়েছিল একটি ক্লাব টুর্নামেন্ট। বিটিসি ক্লাব কাপ নামে পরিচিত সেই টুর্নামেন্টে ঢাকার দর্শকেরা উপভোগ করেছিলেন কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগান ও কলকাতা মোহামেডানের সঙ্গে ঢাকার আবাহনী, মোহামেডান ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের জোর লড়াই। সেমিফাইনালে ইস্ট বেঙ্গলকে হারিয়ে আবাহনী, মোহনবাগানকে হারিয়ে ঢাকা মোহামেডান জায়গা করে নিয়েছিল ফাইনালে।
আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে এগিয়ে চলা ফাইনালে মোহামেডানের প্রাধান্য অবশ্য একটু বেশিই ছিল। তবে সাদা–কালোদের সর্বনাশ হয় আবাহনীর আলমগীর হাসানের এক অতিমানবীয় থ্রোতে। সে সময় ঢাকার ফুটবলে আলমগীর লম্বা থ্রোর জন্য বিখ্যাত ছিলেন। আবাহনীর গোলেরই বড় এক উৎস ছিল রাইটব্যাক আলমগীরের লম্বা থ্রো। বিটিসি ক্লাব কাপের ফাইনালে ম্যাচের শেষ দিকে আলমগীরের সেই থ্রো উড়ে আসে মোহামেডানের গোলমুখে। জটলার মধ্যে তাতে শুধু মাথাই ছুঁইয়েছিলেন আবাহনীর ফরোয়ার্ড গোলাম গাউস। তাঁর হেড গোলরক্ষক সাঈদ হাসান কাননকে বোকা বানিয়ে জড়িয়ে যায় জালে। ওই এক গোলেই নির্ধারিত হয় ম্যাচের ফল।